নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
মাক্কী বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা (الحالة المتحيرة للجيش المكى)

প্রত্যুষে কুরায়েশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হেযাম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরায়েশ সেনা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর টিলার সম্মুখস্থ পানির হাউযের দিকে অগ্রসর হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হ’ল। একমাত্র হাকীম পান করেননি। তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি পাক্কা মুসলিম হয়ে যান। এ ঘটনাকে স্মরণ করে হাকীম বিন হেযাম শপথ করার সময় সর্বদা বলতেন لاَ وَالَّذِي نَجَّانِي يَوْمَ بَدْرٍ ‘ঐ সত্তার কসম! যিনি আমাকে বদরের দিন রক্ষা করেছেন’। ঘটনাটি বহু পূর্বেকার তালূত বাহিনীর ঘটনার সাথে তুলনীয়। সেদিন যারা নদীর পানি পান করেছিল, তাদের কেউই তালূতের সাথে জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হ’তে পারেনি’।[1]

কুরায়েশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বোকামিতে দুঃখে-ক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তারা মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ও সংখ্যা নিরূপণের জন্য ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারোহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শো বা তার কিছু কমবেশী হবে’। তবে আরেকটু সময় দাও, আমি দেখে আসি, ওদের পিছনে কোন সাহায্যকারী সেনাদল আছে কি-না। সে আবার ছুটলো এবং বহু দূর ঘুরে এসে বলল, ওদের পিছনে কাউকে দেখলাম না। তবে সে বলল,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ: الْبَلاَيَا تَحْمِلُ الْمَنَايَا ... لَيْسَ مَعَهُمْ مَنَعَةٌ وَلاَ مَلْجَأٌ إلاَّ سُيُوفُهُمْ ‘হে কুরায়েশগণ, বিপদ এসেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। ... তাদের সাথে কোন শক্তি নেই বা কোন আশ্রয় নেই কেবল তাদের তরবারি ছাড়া’। অতএব واللهِ مَا أَرَى أَنْ يُقْتَلَ رَجُلٌ مِنْهُمْ حَتّى يَقْتُلَ رَجُلاً مِنْكُمْ ... فَرُوا رَأْيَكُمْ ‘আল্লাহর কসম, তোমাদের একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত তাদের একজন নিহত হবে না’। ... অতএব তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’।[2] তার এ রিপোর্ট শুনে হাকীম বিন হেযাম বয়োজ্যেষ্ঠ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহর কাছে এসে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার ব্যাপারে বুঝাতে লাগলেন। তিনি রাযী হ’লেন। এমনকি ইতিপূর্বে নাখলা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে রজবের শেষ দিনে হারাম মাসে নিহত আমর ইবনুল হাযরামীর রক্তমূল্য তিনি নিজ থেকে দিতে চাইলেন। উৎবা বললেন, সমস্যা হ’ল ইবনুল হানযালিয়াহকে নিয়ে (আবু জাহলের মায়ের নাম ছিল হানযালিয়াহ)। তুমি তার কাছে যাও।

অতঃপর উৎবা দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায় তোমাদের কোন গৌরব নেই। কেননা তাতে তোমরা তোমাদের চাচাতো ভাই বা খালাতো ভাই বা মামাতো ভাইয়ের বা নিজ গোত্রের লোকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখবে, যা তোমাদের কাছে মোটেই পসন্দনীয় হবে না।فَارْجِعُوا وَخَلُّوا بَيْنَ مُحَمَّدٍ وَبَيْنَ سَائِرِ الْعَرَبِ ‘অতএব তোমরা ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে মেরে ফেলে, তবে সেটা তাই-ই হবে, যা তোমরা চেয়েছিলে। আর যদি তা না হয়, তাহ’লে সে তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এজন্য যে, তোমরা তার সাথে সেরূপ ব্যবহার করোনি, যেরূপ তোমরা চেয়েছিলে’।

এদিকে হাকীম বিন হেযাম আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিজের ও উৎবার মতামত ব্যক্ত করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। এতে আবু জাহল ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, انتفخَ واللهِ سَحْرُهُ ‘আল্লাহর কসম! উৎবার উপরে মুহাম্মাদের জাদু কার্যকর হয়েছে’।كَلاَّ واللهِ لاَ نَرْجِعُ حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে একটা ফায়ছালা করে দেন’। তিনি বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝলাম যে, উৎবার পুত্র আবু হুযায়ফা যে মুসলমান হয়ে হিজরত করে আগে থেকেই মুহাম্মাদের দলে রয়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে সে নিহত হবে, সেই ভয়ে উৎবা যুদ্ধ না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে’।

হাকীমের কাছ থেকে আবু জাহলের এইসব কথা শুনে উৎবার বিচারবুদ্ধি লোপ পেল। তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠলো। ক্ষুব্ধ চিৎকারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। ওদিকে আবু জাহল ‘আমের ইবনুল হাযরামীকে গিয়ে বললেন, দেখছ কি! তোমার ভাই আমরের রক্তের প্রতিশোধ আর নেওয়া হ’ল না। ঐ দেখ কাপুরুষ উৎবা পালাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ শুরু কর’। একথা শোনা মাত্র ‘আমের তার সারা দেহে ধুলো-বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নাখলা যুদ্ধে নিহত ভাই ‘আমর ইবনুল হাযরামীর নামে واعَمْراه واعَمْراه (হায় আমর! হায় আমর!) বলে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে মুশরিক শিবিরে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। রণোন্মত্ত কুরায়েশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ছুটে চলল।[3] হাকীম বিন হেযামের সকল প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে গেল কেবলমাত্র আবু জাহলের হঠকারিতা ও ধূর্তামির কারণে।[4]

এ সময় রাসূল (ছাঃ) লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী‘আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إنْ يُطِيْعُوهُ يَرْشُدُوْا ‘যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহ’লে তারা সঠিক পথে থাকতো’ (ইবনু হিশাম ১/৬২১)। অর্থাৎ যদি তারা উৎবাহর কথামত মক্কায় ফিরে যেত, তাহ’লে তাদের মঙ্গল হ’ত। এর মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬২২; আল-বিদায়াহ ৩/২৬৮; সূরা বাক্বারাহ ২/২৪৯ আয়াত।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৬২২; সনদ জাইয়িদ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।

[3]. ইবনু হিশাম ১/৬২৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৬৯।

[4]. তারীখু ত্বাবারী ২/৪৪৩, ৪২৪-২৫; সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।