নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
মাদানী বাহিনীর অবস্থান ও পরামর্শ সভা (موقف الجيش المدنى وجلسة الاستشار)

আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার নিরাপদে নিষ্ক্রমন এবং আবু জাহলের নেতৃত্বে মাক্কী বাহিনীর দ্রুত ধেয়ে আসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাফরানে (ذَفرَان) অবস্থানকালেই অবহিত হন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে তিনি মদীনা থেকে ৬৮ কি. মি. দক্ষিণে ‘রাওহা’ (الرَّوْحَاء)-তে অবতরণ করে উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৭ আয়াত)। কেননা তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে মদীনা থেকে বের হননি।

মুহাজিরগণের মধ্যে হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাদের মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، امْضِ لِمَا أَرَاكَ اللهُ فَنَحْنُ مَعَكَ، واللهِ لاَ نَقُولُ لَكَ كَمَا قَالَتْ بَنُو إسْرَائِيلَ لِمُوسَى: اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقاتِلاَ، إِنَّا هَاهُنا قاعِدُونَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও গিয়ে যুদ্ধ কর! আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বরং আমরা বলব, اِذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إنَّا مَعَكُمَا مُقَاتِلُونَ ‘আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধরত থাকব’।فَوَ الَّذِيْ بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَوْ سِرْتَ بِنَا إلَى بِرْكِ الْغِمَادِ لَجَالَدْنَا مَعَكَ مِنْ دُونِهِ حَتَّى تَبْلُغَهُ ‘সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে ‘বারকুল গিমাদ’[1] পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। মিক্বদাদের এই জোরালো বক্তব্য শুনে আললাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই প্রীত হ’লেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন’(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[2]

সংখ্যালঘু মুহাজিরগণের উপরোক্ত তিন নেতার বক্তব্য শোনার পর সংখ্যাগুরু আনছারদের পরামর্শ চাইলে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনছারগণ কেবল (মদীনা) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে। জেনে রাখুন, আমি আনছারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে চান সেখানে আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে চান আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুন- সর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবুও আমরা আপনার সাথেই থাকব।لَوْ اسْتَعْرَضْتَ بِنَا هَذَا الْبَحْرَ فَخُضْتَهُ لَخُضْنَاهُ مَعَكَ ‘যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব’। مَا تَخَلَّفَ مِنَّا رَجُلٌ وَاحِدٌ، فَسِرْ بِنَا عَلَى بَرَكَةِ اللهِ ‘আমাদের একজন লোকও পিছিয়ে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন’। সা‘দের উক্ত কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হ’লেন ও উদ্দীপিত হয়ে বললেন, سِيرُوا عَلَى بَرَكَةِ اللهِ وَأَبْشِرُوا، فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدْ وَعَدَنِي إحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ واللهِ لَكَأَنِّي الْآنَ أَنْظُرُ إلَى مَصَارِعِ الْقَوْمِ‘আল্লাহর রহমতের উপর তোমরা বেরিয়ে পড়ো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দু’টি দলের কোন একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলো দেখতে পাচ্ছি’।[3]

একথাটি কুরআনে এসেছে এভাবে,

وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ- (الأنفال ৭-৮)

‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে। আর তোমরা কামনা করছিলে যে, যাতে কোনরূপ কণ্টক নেই, সেটাই তোমাদের ভাগে আসুক (অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে তোমরা জয়ী হও)। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে (প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) সত্যে পরিণত করতে এবং কাফিরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপাচারীরা এটাকে অপছন্দ করে’ (আনফাল ৮/৭-৮)

পরামর্শ সভায় আবু আইয়ূব আনছারীসহ কিছু ছাহাবী বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় এবং এই অপ্রস্ত্তত অবস্থায় যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেননা তাঁরা এসেছিলেন বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য, বড় ধরনের কোন যুদ্ধ করার জন্য নয়। কিন্তু আল্লাহ এতে নাখোশ হয়ে আয়াত নাযিল করেন,

كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِنْ بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيْقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَكَارِهُوْنَ- يُجَادِلُوْنَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُوْنَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنْظُرُوْنَ- (الأنفال ৫-৬)-

‘যেমনভাবে তোমাকে তোমার গৃহ থেকে তোমার পালনকর্তা বের করে এনেছেন সত্য সহকারে। অথচ মুমিনদের একটি দল তাতে অনীহ ছিল’। ‘তারা তোমার সাথে বিবাদ করছিল সত্য বিষয়টি (অর্থাৎ যুদ্ধ) প্রকাশিত হওয়ার পর। তাদেরকে যেন মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তারা যেন তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে’।[4] অর্থাৎ অসত্যকে প্রতিহত করার জন্য ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নবীকে তার পালনকর্তা যেভাবে মদীনার গৃহ থেকে বের করে এনেছেন, তেমনিভাবে তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্ত্ততির জন্য এখন যা কিছু করছেন, সবই আল্লাহর হুকুমে করছেন। অতএব তোমাদের উচিত তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করা। এভাবে আল্লাহ কোনরূপ পূর্ব ঘোষণা ও প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি ছাড়াই উভয় বাহিনীকে মুখোমুখি করে দিলেন। যার মধ্যে ছিল তাঁর একটি অত্যন্ত দূরদর্শী পরিকল্পনা। যেমন আল্লাহ বলেন,

إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لاَخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولاً لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘স্মরণ কর, যখন তোমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্নভূমিতে। যদি তোমরা উভয় দল আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ হ’তে, তাহ’লে (সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে) তোমরা সে ওয়াদা রক্ষায় মতবিরোধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হয় সে যেন (ইসলামের) সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে বেঁচে থাকে সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’ (আনফাল ৮/৪২)

পরামর্শ সভায় সবধরনের মতামত আসতে পারে। এটা কোন দোষের ছিল না। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে এই সামান্যতম ভীরুতাকেও আল্লাহ পসন্দ করেননি। তাই উপরোক্ত ধমকিপূর্ণ আয়াত নাযিল হয়। যা ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান শতগুণে বৃদ্ধি করে। তিরমিযী, হাকেম, আহমাদ প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, বদর যুদ্ধে কাফেররা পরাজিত হবার পর রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হ’ল যে, আমাদের কেবল বাণিজ্য কাফেলার বিষয়ে বলা হয়েছিল। এর বেশী কিছু নয়। তখন ঐ ব্যক্তিকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে আববাস বলেন, (তখন তিনি বন্দী ছিলেন), আল্লাহ তাঁকে ওয়াদা করেছিলেন দু’টি দলের একটি সম্পর্কে (আনফাল ৭) এবং সেটি আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি ঠিক বলেছ’।[5]

পরামর্শ সভায় যুদ্ধে অগ্রগমনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আবু লুবাবাহ ইবনু আব্দিল মুনযিরকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয়। অতঃপর কাফেলার মূল পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনায় প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)-কে। ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দু’জনেরই মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস বিন আবু ছা‘ছা‘আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) অথবা হুবাব ইবনুল মুনযির। উভয় পতাকাই ছিল কালো রংয়ের। আর সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)।[6]

[1]. বারকুল গিমাদ : এটির অবস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, স্থানটি ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত। কেউ বলেছেন, হিজরের শেষ প্রান্তে। তবে সুহায়লী বলেন, আমি কোন একটি তাফসীরের কিতাবে দেখেছি যে, এটি হাবশার একটি শহর (ইবনু হিশাম ১/৬১৫, টীকা-১)। তাফসীর ইবনু কাছীর সূরা আনফাল ৮ আয়াতের টীকায় বলা হয়েছে, এটি হল মক্কার আগে পাঁচ দিনের দূরত্বে সাগরের তীরবর্তী স্থান।

[2]. আহমাদ হা/১৮৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০।

[3]. ইবনু হিশাম ১/৬১৫; আহমাদ হা/১৮৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০; তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৭২০ সনদ ছহীহ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৮ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।

[4]. আনফাল ৮/৫-৬; ঐ, তাফসীর ইবনে কাছীর; ফাৎহুল বারী হা/৩৭৩৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; হায়ছামী বলেন, ত্বাবারাণী বলেছেন, সনদ হাসান।

[5]. তিরমিযী হা/৩০৮০; হাকেম হা/৩২৬১; আহমাদ হা/২০২২; আরনাঊত্ব বলেন, ইকরিমা থেকে সিমাক-এর বর্ণনায় ‘ইযতিরাব’ রয়েছে। এতদসত্ত্বেও হাদীছটি ইমাম তিরমিযী ‘হাসান ছহীহ’ বলেছেন। হাকেম ‘ছহীহ’ বলেছেন। যাহাবী তা সমর্থন করেছেন। ইবনু কাছীর ‘জাইয়িদ’ বলেছেন। তবে আলবানী সনদ ‘যঈফ’ বলেছেন। সনদ যঈফ হ’লেও ঘটনা ছিল বাস্তব। আর তা ছিল এই যে, কাফের পক্ষ পরাজিত হয়েছিল।

[6]. আর-রাহীক্ব ২০৪-০৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২-১৩; আল-বিদায়াহ ৩/২৬০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৬।