মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের পত্র প্রেরণ। উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ তখনও ইসলাম কবুল করেননি। রাসূল (ছাঃ)-এর আগমনের কারণে ইয়াছরিবের নেতৃত্ব লাভের মোক্ষম সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি ছিলেন মনে মনে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি তার এই ক্ষোভটাকেই কুরায়েশরা কাজে লাগায় এবং নিম্নোক্ত ভাষায় কঠোর হুমকি দিয়ে তার নিকটে চিঠি পাঠায়।-
إِنَّكُمْ آوَيْتُمْ صَاحِبَنَا وَإِنَّا نُقْسِمُ بِاللهِ لَتُقَاتِلُنَّهُ أَوْ لَتُخْرِجُنَّهُ أَوْ لَنَسِيرَنَّ إِلَيْكُمْ بِأَجْمَعِنَا حَتَّى نَقْتُلَ مُقَاتِلَتَكُمْ وَنَسْتَبِيحَ نِسَاءَكُمْ
‘তোমরা আমাদের লোকটিকে (মুহাম্মাদকে) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ও তাকে বের করে দিবে নতুবা আমরা তোমাদের উপরে সর্বশক্তি নিয়ে হামলা করব। তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব ও নারীদের হালাল করব’।[1]
এই পত্র পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দ্রুত তার সমমনাদের সাথে গোপন বৈঠকে বসে গেল। কিন্তু সংবাদ রাসূল (ছাঃ)-এর কানে পৌঁছে গেল। তিনি সরাসরি তাদের বৈঠকে এসে হাযির হ’লেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি দেখছি কুরায়েশদের হুমকিকে তোমরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছ। অথচ এর মাধ্যমে তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, কুরায়েশরা তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। أَتُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا أَبْنَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ ‘তোমরা কি তোমাদের সন্তান ও ভাইদের সাথে (অর্থাৎ মুসলমানদের সাথে) যুদ্ধ করতে চাও’? রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে এ বক্তব্য শুনে বৈঠক ভেঙ্গে গেল ও দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।[2] যদিও আব্দুল্লাহর অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলতে থাকল। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুনাফিক ও ইহূদীদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে থাকেন। যাতে হিংসার আগুন জ্বলে না ওঠে।
(২) আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় যান ও কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের অতিথি হন। উমাইয়ার ব্যবস্থাপনায় দুপুরে নিরিবিলি ত্বাওয়াফ করতে দেখে আবু জাহল তাকে ধমকের সুরে বলেন, أَلاَ أَرَاكَ تَطُوفُ بِمَكَّةَ آمِنًا، وَقَدْ أَوَيْتُمُ الصُّبَاةَ؟ ‘তোমাকে দেখছি মক্কায় বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করছ। অথচ তোমরা ধর্মত্যাগী লোকগুলোকে আশ্রয় দিয়েছ! ... আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবু ছাফওয়ানের (উমাইয়া বিন খালাফের) সাথে না থাকতে, তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না’। একথা শুনে সা‘দ চীৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, তুমি আমাকে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমি তোমার জন্য এর চেয়ে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবো। আর তাতে মদীনা হয়ে তোমাদের ব্যবসায়ের রাস্তা বন্ধ হবে’।[3]
(৩) কুরায়েশ নেতারা ও তাদের দোসররা হর-হামেশা তৎপর ছিল মুহাজিরগণের সর্বনাশ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রায়ই বিনিদ্র রজনী কাটাতেন। এক রাতে তিনি বললেন,لَيْتَ رَجُلاً صَالِحًا مِنْ أَصْحَابِىْ يَحْرِسُنِى اللَّيْلَةَ ‘যদি আমার ছাহাবীগণের মধ্যে যোগ্য কেউ এসে আমাকে রাতে পাহারা দিত’! আয়েশা (রাঃ) বলেন, এমন সময় হঠাৎ অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে? জবাব এল, আমি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কি উদ্দেশ্যে আগমন? সা‘দ বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে আমার অন্তরে ভয় উপস্থিত হ’ল। তাই এসেছি তাঁকে পাহারা দেবার জন্য। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন ও ঘুমিয়ে গেলেন। এমনকি আমরা তাঁর নাক ডাকানোর শব্দ শুনতে পেলাম’।[4] এরপর থেকে এরূপ পাহারাদারীর ব্যবস্থা নিয়মিত চলতে থাকে। যতক্ষণ না নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়- وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ‘আল্লাহ তোমাকে লোকদের হামলা থেকে রক্ষা করবেন’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)। উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ انْصَرِفُوْا عَنِّى فَقَدْ عَصَمَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ‘হে লোক সকল! তোমরা ফিরে যাও! মহান আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন’।[5] কুরায়েশদের অপতৎপরতা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধেই ছিল না; বরং সাধারণ মুহাজির মুসলমানের বিরুদ্ধেও ছিল। আর এটাই স্বাভাবিক।
[2]. আবুদাঊদ হা/৩০০৪; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক্ব হা/৯৭৩৩, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৩৯৫০ ‘মাগাযী’ অধ্যায় ২ পরিচ্ছেদ।
[4]. বুখারী হা/৭২৩১; মুসলিম হা/২৪১০ (৪০); মিশকাত হা/৬১০৫।
[5]. তিরমিযী হা/৩০৪৬, সনদ হাসান ‘তাফসীর’ অধ্যায়।