নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
গৃহ থেকে গুহা -কিছু ঘটনা (من الدار إلى الغار : بعض الحادثات)

মক্কা ত্যাগকালে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতিক্রিয়া(تأثير الرسول صـ عند مغادرة مكة) :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন হাজূনে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসী ও বায়তুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, وَاللهِ إِنَّكِ لَخَيْرُ أَرْضِ اللهِ وَأَحَبُّ أَرْضِ اللهِ إِلَى اللهِ وَلَوْلاَ أَنِّى أُخْرِجْتُ مِنْكِ مَا خَرَجْتُ ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জনপদ ও আল্লাহর নিকট আল্লাহর মাটিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাটি। যদি আমাকে তোমার থেকে বের করে না দেওয়া হ’ত, তাহ’লে আমি বেরিয়ে যেতাম না’।[1]

এ প্রসঙ্গে যে আয়াতটি নাযিল হয় তা নিম্নরূপ-

وَكَأَيِّنْ مِّنْ قَرْيَةٍ هِيَ أَشَدُّ قُوَّةً مِّنْ قَرْيَتِكَ الَّتِيْ أَخْرَجَتْكَ أَهْلَكْنَاهُمْ فَلاَ نَاصِرَ لَهُمْ-

‘যে জনপদ তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তার চাইতে কত শক্তিশালী জনপদকে আমরা ধ্বংস করেছি। অতঃপর তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৩)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আয়াতটি হিজরতকালে মক্কা ত্যাগের সময় নাযিল হয়।[2]

গুহার মুখে শত্রুদল(الأعداء على الغار) :

রাসূল (ছাঃ)-কে না পেয়ে কুরায়েশরা চারিদিকে অনুসন্ধানী দল পাঠায় এবং ঘোষণা করে যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও আবুবকরকে বা দু’জনের কাউকে জীবিত বা মৃত ধরে আনবে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেওয়া হবে।[3] সন্ধানী দল এক সময় ছওর গিরিগুহার মুখে গিয়ে পৌঁছে। এ সময়কার অবস্থা আবুবকর (রাঃ) বর্ণনা করেন এভাবে যে,نَظَرْتُ إِلَى أَقْدَامِ الْمُشْرِكِينَ عَلَى رُؤُوسِنَا وَنَحْنُ فِى الْغَارِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَهُمْ نَظَرَ إِلَى قَدَمَيْهِ أَبْصَرَنَا تَحْتَ قَدَمَيْهِ فَقَالَ يَا أَبَا بَكْرٍ مَا ظَنُّكَ بِاثْنَيْنِ اللهُ ثَالِثُهُمَا ‘গুহায় থাকা অবস্থায় আমি আমাদের মাথার উপরে তাদের পাগুলি দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি তাদের কেউ নীচের দিকে তাকায়, তাহ’লে আমাদেরকে তার পায়ের নীচে দেখতে পাবে। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, দু’জন ধারণা করছ কেন? আল্লাহ আছেন তৃতীয় হিসাবে’।[4] বিষয়টির বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে-

إِلاَّ تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَار إِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا فَأَنزَلَ اللهُ سَكِيْنَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُوْدٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِيْنَ كَفَرُواْ السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌِ- (التوبة ৪০)-

‘যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিষ্কার করেছিল দু’জনের হিসাবে। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিল। যখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তার সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখোনি। আর আল্লাহ কাফেরদের শিরকী কালেমা নীচু করে দিলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহর তাওহীদের কালেমা সদা উন্নত। আল্লাহ হ’লেন পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)

রক্তপিপাসু শত্রুকে সামনে রেখে ঐ সময়ের ঐ নাযুক অবস্থায় لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا (চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন), এই ছোট্ট কথাটি মুখ দিয়ে বের হওয়া কেবলমাত্র তখনই সম্ভব, যখন একজন মানুষ সম্পূর্ণরূপে কায়মনোচিত্তে নিজেকে আল্লাহর উপরে সোপর্দ করে দেন। দুনিয়াবী কোন উপায়-উপকরণের উপরে নির্ভরশীল ব্যক্তির পক্ষে এরূপ কথা বলা আদৌ সম্ভব নয়।

বস্ত্ততঃ একথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সংকটকালে আরও কয়েকবার বলেছেন। এখানে ‘অদৃশ্য বাহিনী’ বলতে ফেরেশতাগণ হ’তে পারে কিংবা অন্য কোন অদৃশ্য শক্তি হ’তে পারে, যা মানুষের কল্পনার বাইরে। মূলতঃ সবই আল্লাহর বাহিনী। সবচেয়ে বড় কথা, সারা পাহাড় তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর গুহা মুখে পৌঁছেও তারা গুহার মধ্যে খুঁজল না, এমনকি নীচের দিকে তাকিয়েও দেখল না। তাদের এই মনের পরিবর্তনটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল সরাসরি গায়েবী মদদ এবং রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম মো‘জেযা। আল্লাহ বলেন, وَمَا يَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّكَ إِلاَّ هُوَ ‘তোমার প্রভুর সেনাবাহিনীর খবর তোমার প্রভু ব্যতীত কেউ জানে না’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩১)। আর একারণেই হাযারো প্রস্ত্ততি নিয়েও অবশেষে কুফরীর ঝান্ডা অবনমিত হয় ও তাওহীদের ঝান্ডা সমুন্নত হয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল’ (নাহল ১৬/১২৮)

[1]. তিরমিযী হা/৩৯২৫; আহমাদ হা/১৮৭৩৯, সনদ ছহীহ।

[2]. তাফসীর ত্বাবারী ২৬/৩১ পৃঃ হা/৩১৩৭২। নাযিলের কারণ অংশটুকু বাদে হাদীছ ছহীহ; তাহকীক তাফসীর কুরতুবী হা/৫৫১১ সূরা মুহাম্মাদ ১৩ আয়াত।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ إِنَّكَ أَخْرَجْتَنِيْ مِنْ أَحَبِّ الْبِلاَدِ إِلَيَّ فَأَسْكِنِّيْ أَحَبَّ الْبِلاَدِ إِلَيْكَ فَأَسْكَنَهُ اللهُ الْمَدِيْنَةَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় জনপদ থেকে বের করে এনেছ। অতএব তুমি আমাকে তোমার সর্বাধিক প্রিয় স্থানে বসবাস করাও। অতঃপর আল্লাহ তাকে মদীনাতে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন’ (হাকেম হা/৪২৬১, ৩/৪)। হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল। বরং ছহীহ হাদীছ এই যে, তিনি হাজূনে দাঁড়িয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে (তিরমিযী হা/৩৯২৫; হাদীছ ছহীহ)। ইবনু আব্দিল বার্র মালেকী বলেন, আমি বিস্মিত হই ছহীহ হাদীছ ছেড়ে কিভাবে মানুষ মওযূ‘ হাদীছের ভিত্তিতে এভাবে তাবীল করতে পারে’। অথচ এটি প্রসিদ্ধ যে, মালেকীগণ মক্কার উপরে মদীনাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন (মা শা-‘আ ৮৩-৮৪ পৃঃ)।

[3]. ইবনু হিশাম ১/৪৮৯, বুখারী হা/৩৯০৬।

[4]. বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৮১; মিশকাত হা/৫৮৬৮।