নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’তেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হ’ত, তাহ’লে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে লূতের কওমের মত গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম কবুল করা হ’তে পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قَالُوْا اللهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ- (الأنفال ৩২-৩৩)-
‘আর স্মরণ কর, যখন তারা প্রার্থনা করেছিল, যদি এই ব্যক্তি (মুহাম্মাদ) সত্য (নবী) হয়ে থাকে তোমার পক্ষ হতে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপর আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর অথবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও’। ‘অথচ আল্লাহ কখনো তাদের উপর শাস্তি নাযিল করবেন না যতক্ষণ তুমি (হে মুহাম্মাদ!) তাদের মধ্যে অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যতক্ষণ তারা (অর্থাৎ মক্কার দুর্বল মুসলিমরা) ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে’।[1]
অথচ একবার গযব নেমে এলে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। যেমন পূর্ববতী নবীগণের অবাধ্য উম্মতসমূহের অবস্থা হয়েছে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিজ উম্মতের জন্য সেটা কখনোই চাননি।
আয়াত দু’টির মর্মকথা (مغزى الآييتين المذكورتين) :
প্রথম আয়াতে কাফের নেতাদের একটি কূট কৌশল বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করার কারণে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? অথচ তারা ভালভাবেই জানত যে, আল্লাহ তার বান্দাদের বুঝার ও তওবা করার অবকাশ দিয়ে থাকেন। প্রতিটি অপরাধের কারণে যখন-তখন গযব নাযিল করে তাদের ধ্বংস করেন না। যেমন আল্লাহ ফেরাঊনের মত দুরাচারকেও অন্যূন বিশ বছরের মত সময় দিয়েছিলেন এবং নানা প্রকার গযব নাযিল করেও যখন সে তওবা করেনি, তখন তাকে সদলবলে ডুবিয়ে মারেন। মক্কার কাফিররাও ভেবেছিল যেহেতু গযব নাযিল হচ্ছে না, অতএব আমরা ঠিক পথে আছি। মুহাম্মাদ নিজে ধর্মত্যাগী হয়েছে এবং সে আমাদের জামা‘আতের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
বস্ত্ততঃ যুগে যুগে কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা নিজেদেরকে সঠিক এবং সংস্কারবাদী নেতাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে দাবী করেছে। মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ফেরাঊন তার লোকদের একই কথা বলে বুঝিয়েছিল যে,وَمَا أَهْدِيْكُمْ إِلاَّ سَبِيْلَ الرَّشَادِ ‘আমি তোমাদেরকে সর্বদা কেবল মঙ্গলের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৯)। আর মূসা (আঃ) সম্পর্কে সে বলল,وَإِنِّيْ لاَظُنُّهُ كَاذِباً ‘আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি’ (মুমিন/গাফের ৪০/৩৭)। সে ধর্ম রক্ষা ও দেশে শান্তি রক্ষার দোহাই দিয়ে তাকে হত্যা করার অজুহাত সৃষ্টি করে বলেছিল,ذَرُوْنِيْ أَقْتُلْ مُوْسَى وَلْيَدْعُ رَبَّهُ إِنِّيْ أَخَافُ أَنْ يُّبَدِّلَ دِيْنَكُمْ أَوْ أَنْ يُّظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ ‘তোমরা আমাকে ছাড়, আমি মূসাকে হত্যা করব। ডাকুক, সে তার রবকে। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনকে পরিবর্তন করে দেবে এবং সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৬)। মক্কার নেতারা একই কথা বলেছিল। তারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘ছাবেঈ’ (صابئ) অর্থাৎ ‘ধর্মত্যাগী এবং ‘কাযযাব’ (كذَّاب) অর্থাৎ ‘মহা মিথ্যাবাদী’ এবং ‘সমাজে বিভক্তি সৃষ্টিকারী’ বলেছিল।[2] আর সেকারণ তারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
যুগে যুগে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের সত্যিকারের সেবকদের বিরুদ্ধে একই অপবাদ ও একই কূট কৌশল অবলম্বন করে। তারাও আল্লাহর গযব সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হওয়াকে তাদের সত্যতার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং সমাজ সংস্কারক দ্বীনদার আলেমদের অত্যাচারিত হওয়াকে তাদের ভ্রান্ত হওয়ার প্রমাণ হিসাবে যুক্তি পেশ করে থাকে।
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! তুমি তাদের মধ্যে অবস্থান করবে অথবা তোমার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আমরা তাদের উপর গযব নাযিল করব না। কারণ একজন নবী বা ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সকল বিশ্ববাসীর চাইতে বেশী। এ কারণেই হাদীছে এসেছে,لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِى الأَرْضِ اللهُ اللهُ ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।[3]
বস্ত্ততঃ ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের উপরে সে গযবই নাযিল হয়েছিল। কেননা যে দুনিয়ার লোভে তারা ইসলামকে সত্য জেনেও তার বিরোধিতায় জীবনপাত করেছিল, সেই দুনিয়াবী নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সবই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় মক্কা বিজয়ের দিন এবং সেদিন তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়। নিজেদের জীবদ্দশায় বিনা যুদ্ধে এরূপ মর্মান্তিক পতন প্রত্যক্ষ করা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী শাস্তি নয় কি? বরং আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণে নিহত হওয়ার চাইতে এটিই ছিল কুরায়েশ নেতাদের জন্য আরও কঠিন গযব ও হৃদয়বিদারক শাস্তি। যুগে যুগে সত্য এভাবেই বিজয়ী হয়েছে। আজও হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। প্রয়োজন কেবল ঈমানদার ও নিঃস্বার্থ নেতা এবং যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দল।
আল্লাহর সান্ত্বনা বাণী (كلماة الةسلية من الله تعالى) :
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلاَ تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلاَّ سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلاَغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلاَّ الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ‘অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল (তোমার পূর্বেকার) দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর অবিশ্বাসীদের জন্য (শাস্তি প্রার্থনায়) ব্যস্ততা প্রদর্শন করো না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তা সেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে। সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দিবসের কিছুক্ষণের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটি তাদের জন্য খবর পৌঁছানো হ’ল মাত্র। আর পাপাচারী সম্প্রদায় ব্যতীত কেউ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় কি?’(আহক্বাফ ৪৬/৩৫)।
[2]. ইবনু হিশাম ১/২৬৭; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮২, ৯৭।
[3]. মুসলিম হা/১৪৮; আহমাদ হা/১৩৮৬০ ‘মুসনাদে আনাস’; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিৎনাসমূহ’ অধ্যায়, ৭ অনুচ্ছেদ।