কা‘বাগৃহের কারণে মক্কা ছিল সমগ্র আরব ভূখন্ডের ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সেকারণ খ্রিষ্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। এক সময় ইয়ামনের খ্রিষ্টান নরপতি আবরাহা নিজ রাজধানী ছান‘আতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কা‘বাগৃহের আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ্জ করার নির্দেশ জারী করেন। কিন্তু জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। বরং কে একজন গিয়ে তার ঐ নকল কা‘বাগৃহে (?) পায়খানা করে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি প্রায় ৬০ হাযার সৈন্য ও হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করেন কা‘বাগৃহকে ধ্বংস করার জন্য। অবশেষে আল্লাহর গযবে তিনি নিজে তার সৈন্য-সামন্ত সহ ধ্বংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায় এবং এ ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জন্মের মাত্র ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। বস্ত্ততঃ এটা ছিল শেষনবীর আগমনের আগাম শুভ সংকেত (الْإِرْهَاصُ) মাত্র। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ঘটনার পরে মক্কাবাসীগণ দশ বছর যাবৎ পূর্ণ তাওহীদবাদী ছিল এবং মূর্তিপূজার শিরক পরিত্যাগ করেছিল’।[1]
সমগ্র আরব উপদ্বীপে মক্কা ছিল বৃহত্তম নগরী এবং মক্কার অধিবাসী ও ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ছিল সবার উপরে। হারাম শরীফের উচ্চ মর্যাদার কারণে তাদের মর্যাদা আপামর জনগণের মধ্যে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাদেরকে সমীহ করত।
এটাই যেখানে বাস্তবতা, সেখানে এই যুগটিকে ‘জাহেলী যুগ’(الْأَيَّامُ الْجَاهِلِيَّةُ) কেন বলা হয়? এর কারণ সম্ভবতঃ এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারী এবং তাওহীদপন্থী হওয়া সত্ত্বেও শিরকে লিপ্ত হয়েছিল। তারা আল্লাহর বিধান সমূহকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তিপূজার মত নিকৃষ্টতম শিরকের প্রবর্তন করেছিল। তারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে চিনতে পেরেও তাঁকে অস্বীকার করেছিল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় জাহেলিয়াত ও সবচেয়ে বড় মূর্খতা। আর একারণেই ‘জ্ঞানের পিতা’ আবুল হাকাম-কে ‘মূর্খতার পিতা’ আবু জাহল লকব দেওয়া হ’ল।[2] বস্ত্ততঃ ইসলামের বিরোধী যা কিছু, সবই জাহেলিয়াত। আল্লাহ বলেন,أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ ‘তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিচার-ফায়ছালা কামনা করে? অথচ দৃঢ় বিশ্বাসীদের নিকট আল্লাহর চাইতে উত্তম ফায়ছালাকারী আর কে আছে?’ (মায়েদাহ ৫/৫০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَاءِ جَهَنَّمَ ‘যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে মানুষকে আহবান করে, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত’।[3] উল্লেখ্য যে, জাহেলী আরবী সাহিত্যের ইতিহাস ইসলাম আগমনের পূর্বে দেড়শ’ বছরের বেশী নয় (সীরাহ ছহীহাহ ১/৭৯)। এক্ষণে আমরা মক্কায় জাহেলিয়াত প্রসারের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করব।-
[2]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৯৫০-এর আলোচনা, ‘মাগাযী’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ ৭/৩৩১ পৃঃ।
[3]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪; সনদ ছহীহ।