দশ জন বিমাতা ভাই মিলে ইউসুফকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিল। তারা একদিন পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর কাছে এসে ইউসুফকে সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আনন্দ ভ্রমণে যাবার প্রস্তাব করল। তারা পিতাকে বলল যে, ‘আপনি তাকে আগামীকাল আমাদের সাথে প্রেরণ করুন। সে আমাদের সঙ্গে যাবে, তৃপ্তিসহ খাবে আর খেলাধূলা করবে এবং আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব’। জবাবে পিতা বললেন, আমার ভয় হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে, আর কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে’। ‘তারা বলল, আমরা এতগুলো ভাই থাকতে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে, তাহ’লে তো আমাদের সবই শেষ হয়ে যাবে’ (ইউসুফ ১২/১২-১৪)। উল্লেখ্য যে, কেন‘আন অঞ্চলে সে সময়ে বাঘের প্রাদুর্ভাব ছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখাত বর্ণিত হয়েছে যে, ইয়াকূব (আঃ) পূর্বরাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়ের উপরে আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশে ইউসুফ খেলা করছে। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তাদের মধ্যকার একটি বাঘ এসে তাকে মুক্ত করে দেয়। অতঃপর ইউসুফ মাটির ভিতরে লুকিয়ে যায়’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন যে, উক্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইয়াকূব (আঃ) তার দশ পুত্রকেই দশ ব্যাঘ্র গণ্য করেছিলেন। কিন্তু তাদের কাছে রূপকভাবে সেটা পেশ করেন। যাতে তারা বুঝতে না পারে (কুরতুবী)।
যাইহোক ছেলেদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি রাযী হলেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যাতে তারা ইউসুফকে কোনরূপ কষ্ট না দেয় এবং তার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখে। অতঃপর তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র ইয়াহুদা বা রুবীল-এর হাতে ইউসুফকে সোপর্দ করলেন এবং বললেন, তুমিই এর খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য সকল ব্যাপারে দেখাশুনা করবে। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছেই শয়তানী চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠলো। তারা ইউসুফকে হত্যা করার জন্য প্রস্ত্তত হ’ল। তখন বড় ভাই ইয়াহুদা তাদের বাধা দিল এবং পিতার নিকটে তাদের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কিন্তু শয়তান তাদেরকে আরও বেশী যেদী করে তুলল। অবশেষে বড় ভাই একা পেরে না উঠে প্রস্তাব করল, বেশ তবে ওকে হত্যা না করে বরং ঐ দূরের একটা পরিত্যক্ত কূয়ায় ফেলে দাও। যাতে কোন পথিক এসে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাতে তোমাদের দু’টো লাভ হবে। এক- সে পিতার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে ও তোমরা তখন পিতার নিকটবর্তী হবে। দুই- নিরপরাধ বালককে হত্যা করার পাপ থেকে তোমরা বেঁচে যাবে।
ভাইদের এই চক্রান্তের কথা আল্লাহ ব্যক্ত করেছেন নিম্নোক্তভাবে-
لَقَدْ كَانَ فِيْ يُوسُفَ وَإِخْوَتِهِ آيَاتٌ لِّلسَّائِلِيْنَ، إِذْ قَالُواْ لَيُوْسُفُ وَأَخُوْهُ أَحَبُّ إِلَى أَبِيْنَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّ أَبَانَا لَفِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ، اقْتُلُواْ يُوسُفَ أَوِ اطْرَحُوْهُ أَرْضاً يَخْلُ لَكُمْ وَجْهُ أَبِيكُمْ وَتَكُوْنُواْ مِن بَعْدِهِ قَوْماً صَالِحِيْنَ، قَالَ قَآئِلٌ مَّنْهُمْ لاَ تَقْتُلُواْ يُوْسُفَ وَأَلْقُوْهُ فِي غَيَابَةِ الْجُبِّ يَلْتَقِطْهُ بَعْضُ السَّيَّارَةِ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ- (يوسف ৭-১০)-
‘নিশ্চয়ই ইউসুফ ও তার ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্য রয়েছে নিদর্শনাবলী’ (৭)। ‘যখন তারা বলল, অবশ্যই ইউসুফ ও তার ভাই আমাদের পিতার কাছে আমাদের চাইতে অধিক প্রিয়। অথচ আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ শক্তি বিশেষ। নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তিতে রয়েছেন’ (৮)। ‘তোমরা ইউসুফকে হত্যা কর অথবা তাকে কোথাও ফেলে আস। এতে শুধু তোমাদের প্রতিই তোমাদের পিতার মনোযোগ নিবিষ্ট হবে এবং এরপর তোমরাই (পিতার নিকটে) যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকবে’ (৯)। ‘তখন তাদের মধ্যেকার একজন (বড় ভাই) বলে উঠল, তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না, বরং ফেলে দাও তাকে অন্ধকূপে, যাতে কোন পথিক তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়, যদি একান্তই তোমাদের কিছু করতে হয়’ (ইউসুফ ১২/৭-১০)।
বড় ভাইয়ের কথায় সবাই একমত হয়ে ইউসুফকে কূয়ার ধারে নিয়ে গেল। এ সময় তারা তার গায়ের জামা খুলে নিল। নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায় যে, এ সময় ৬/৭ বছরের কচি বালক ইউসুফ তার ভাইদের কাছে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু শয়তান তাদেরকে হিংসায় উন্মত্ত করে দিয়েছিল। এই কঠিন মুহূর্তে ইউসুফকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তার নিকটে অহী নাযিল করেন। নিঃসন্দেহে এটি নবুঅতের অহী ছিল না। কেননা সাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে আল্লাহ কাউকে নবী করেন না। এ অহী ছিল সেইরূপ, যেরূপ অহী বা ইলহাম এসেছিল শিশু মূসার মায়ের কাছে মূসাকে বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেবার জন্য (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯)।
এ সময়কার মর্মন্তুদ অবস্থা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে,
فَلَمَّا ذَهَبُوْا بِهِ وَأَجْمَعُوْا أَن يَجْعَلُوْهُ فِيْ غَيَابَةِ الْجُبِّ وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُم بِأَمْرِهِمْ هَـذَا وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ- (يوسف ১৫)-
‘যখন তারা তাকে নিয়ে চলল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হ’ল, এমতাবস্থায় আমি তাকে (ইউসুফকে) অহী (ইলহাম) করলাম যে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিত করবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবে না’ (ইউসুফ ১২/১৫)।
ইমাম কুরতুবী বলেন যে, কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই অথবা পরে ইউসুফকে সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দিয়ে এ অহী নাযিল হয়েছিল। ইউসুফকে তার ভাইয়েরা কূপে নিক্ষেপ করল। সেখানেও আল্লাহ তাকে সাহায্য করলেন। তিনি কূয়ার নীচে একখন্ড পাথরের উপরে স্বচ্ছন্দে বসে পড়লেন। বড় ভাই ইয়াহুদা গোপনে তার জন্য দৈনিক একটা পাত্রের মাধ্যমে উপর থেকে খাদ্য ও পানীয় নামিয়ে দিত এবং দূর থেকে সর্বক্ষণ তদারকি করত।