৭৫ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ৮টি আয়াতে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে, এটি ইবরাহীমের শিশুকালে জ্ঞান-বুদ্ধির বয়স হবার সময়কার ঘটনা, নাকি নবী হবার পরের তর্কানুষ্ঠান, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু জারীর (মৃঃ ৩১০ হিঃ) প্রথমোক্ত মত পোষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে আলী ইবনে ত্বালহার সূত্রে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনা পেশ করেছেন। তবে এই বর্ণনাটির সনদ যঈফ।[7]
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব (৮৫-১৫০ হিঃ) বর্ণিত কিছু অলৌকিক ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে, যা উক্ত মতকে সমর্থন করে। যেমন বাদশাহ নমরূদ যখন জানতে পারেন যে, অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যে তার রাজ্য হারানোর কারণ হবে, তখন তিনি নবজাতক সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করেন। ইবরাহীমের মা তখন একটি পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে ইবরাহীমকে প্রসব করেন এবং ইবরাহীম একাকী সেখানে বড় হন। ইবরাহীমের এক আঙ্গুল দিয়ে দুধ বের হ’ত, এক আঙ্গুল দিয়ে মধু বের হ’ত ও এক আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হ’ত। এভাবে তিনি সেখানে তিন বছর কাটান। তারপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এসে মাকে বলেন, আমার প্রভু কে? মা বললেন, নমরূদ। তিনি বললেন, নমরূদের প্রভু কে? তখন মা তাকে চড় মারলেন এবং তিনি বুঝলেন এটিই হ’ল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে বাদশাহ নমরূদ আগেই স্বপ্ন দেখেছেন। সুদ্দী, যাহহাক প্রমুখের বরাতে কাসাঈ স্বীয় ক্বাছাছুল আম্বিয়ার মধ্যে এ ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)। অতঃপর ইবরাহীম গুহা থেকে বের হয়ে প্রথম তারকা দেখলেন, তারপর চন্দ্র দেখলেন, তারপর সূর্য দেখলেন। অতঃপর সবকিছুর ডুবে যাওয়া দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রকৃত পালনকর্তা তিনি, যিনি এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন (কুরতুবী)। ইবনু জারীর দলীল এনেছেন ইবরাহীমের একথা দ্বারা, যেখানে তিনি বলেছেন, لَئِن لَّمْ يَهْدِنِي رَبِّي لأكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ، ‘যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ না দেখান, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আন‘আম ৬/৭৭)।
ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) বলেন, বরং সঠিক কথা এই যে, ইবরাহীমের উপরোক্ত ঘটনা ছিল তার কওমের সাথে একটি তর্কানুষ্ঠান মাত্র। এটি কখনোই তার শিশুকালের ঘটনা নয় এবং তিনি ক্ষণিকের তরেও কখনো মুশরিক হননি। কেননা তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتاً لِلّهِ حَنِيفاً وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একটি উম্মত এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও একনিষ্ঠ। আর তিনি কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (নাহল ১৬/১২০)। তাছাড়া প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, خَلَقْتُ عبادى حُنَفَاءَ ‘আমি আমার বান্দাদের সৃষ্টি করি আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হিসাবে’।[8] সাধারণ মানবশিশু যদি এরূপ হয়, তাহ’লে শিশু ইবরাহীম কেন মুশরিক হবেন? আর এটা যে কওমের নেতাদের সাথে তাঁর একটি তর্কানুষ্ঠান ছিল, তার বড় প্রমাণ এই যে, ৮০ নং আয়াতে বলা হয়েছে وَحَآجَّهُ قَوْمُهُ ‘তাঁর কওম তাঁর সাথে বিতর্ক করল’। তাছাড়া তর্ক শেষে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ، ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (আন‘আম ৬/৭৮)।
বলা বাহুল্য তারকা পূজারী নেতাদের সাথে ইবরাহীম (আঃ)-এর বিতর্কের ঘটনাটি কুরআন অত্যন্ত উঁচুমানের আলংকরিক ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে, যা একটি বাস্তব ও অতুলনীয় বাণীচিত্রের রূপ ধারণ করেছে। যেমন ইবরাহীম (আঃ) উক্ত নেতাদের বলছেন, তোমাদের ধারণা অনুযায়ী ধরে নিলাম আকাশের ঐ নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য সকলেই ‘আমার রব’। কিন্তু ওরা যে ডুবে গেল। যারা নিজেরা ডুবে যায়, তারা আমাকে বা তোমাদেরকে কিভাবে রক্ষা করবে? অতএব আমি তোমাদের শিরকী আক্বীদা হ’তে মুক্ত। আমি এদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ও অনুগত রইলাম। তোমরাও এদিকে ফিরে এসো। যেমন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ মুশরিকদের ডেকে বলবেন, أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنتُمْ تَزْعُمُونَ ‘তোমাদের ধারণা অনুযায়ী আমার শরীকরা কোথায়? (ক্বাছাছ ২৮/৬২)। অর্থাৎ তোমাদের দাবী অনুযায়ী ওরা আমার শরীক। অথচ আল্লাহর কোন শরীক নেই।
[8]. মুসলিম ‘জান্নাত’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫৩৭১ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ৮ অনুচ্ছেদ।