সীন-লাম-ফা একটি ধাতু, যা আগে যাওয়া বা অগ্রণী হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে।[১] তাই এই সালাফ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলঃ যে আগে গেছে বা অগ্রণী হয়েছে। এটি ‘সালেফ’ শব্দের বহুবচন। আর তার বহুবচন হয় আসলাফ, সুলুফ ও সুল্লাফ।
আত্মীয় বা অন্য কিছুর আপনার প্রত্যেক পূর্ববর্তী ও অগ্রণীর জন্য উক্ত শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ থেকেই মহান আল্লাহর বাণী,
فَجَعَلْنَاهُمْ سَلَفًا وَمَثَلًا لِّلْآخِرِينَ
“পরবর্তীদের জন্য আমি ওদেরকে অতীত নমুনা ও দৃষ্টান্ত করে রাখলাম।” (যুখরুফ : ৫৬)।
ইমাম বাগবী (রাহিমাহুল্লাহ) তার তফসীর গ্রন্থে (৭/২ ১৮তে) উক্ত আয়াতের তফসীরে বলেছেন, “সালাফ হল বিগত বাপ-দাদাগণ। সুতরাং আমি তাদেরকে পূর্ববর্তী বা অতীত করলাম, যাতে পরবর্তীগণ তাদের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। এই (গত হওয়ার) অর্থেই মহান আল্লাহর বাণী,
وَأَن تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا
“(হারাম করা হয়েছে) দুই ভগিনীকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা গত হয়ে গেছে, তা (ধর্তব্য নয়)। নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (নিসাঃ ২৩)
অর্থাৎ, তোমাদের যে কর্ম গত হয়ে গেছে, তা ধর্তব্য নয়। বলা বাহুল্য, ব্যতিক্রান্ত হল পাপটা, কর্মের বৈধতা নয়। বলা হয়, অমুকের সম্মানীয় সলফ আছে। অর্থাৎ, অগ্রবর্তী বাপদাদা আছে।[২]
অবশ্য হাফেয ইবনুল আষীর ও আল্লামা ইবনে মনযূর (সালাফের অর্থে) বয়স ও মর্যাদায় অগ্রবর্তী বা অগ্রণী হওয়ার ব্যাপারকে নির্দিষ্ট করেছেন।
ইবনে মনযূর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, অনুরূপ সলফ হল, বাপদাদা ও আত্মীয়দের মধ্য থেকে যারা বয়স ও মর্যাদায় আপনার উর্ধে, যারা আপনার অগ্রবর্তী হয়েছে (বা আপনার আগে গুজরে গেছে)। এই কারণে তাবেঈনদের পুরোভাগের প্রাথমিক দলকে ‘সলফে সালেহ’ বলে নামকরণ করা হয়েছে।[৩]
এই অর্থের প্রতি নির্দেশ করে বুখারী-মুসলিমের একটি হাদীস, যাতে একটি কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, একদা কন্যা ফাতেমাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এলে নবী (সা.) তাকে দেখে স্বাগত জানালেন এবং বললেন, 'আমার কন্যার শুভাগমন হোক। অতঃপর তিনি তাকে নিজের ডান অথবা বাম পাশে বসালেন। তারপর তিনি তাকে কানে কানে গোপনে কিছু বললেন। ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) জোরেশোরে কাঁদতে আরম্ভ করল। সুতরাং তিনি তার অস্থিরতা দেখে পুনর্বার তাকে কানে কানে কিছু বললেন। ফলে (এবার) সে হাসতে লাগল। (আয়েশা বলেন,) অতঃপর আমি ফাতেমাকে বললাম, 'রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের মাঝে (তাদেরকে বাদ দিয়ে) তোমাকে গোপনে কিছু বলার জন্য বেছে নেওয়া সত্ত্বেও তুমি কাঁদছ?’ তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন উঠে গেলেন, তখন আমি তাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাকে কী বললেন? সে বলল, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর গোপন কথা প্রকাশ করব না।
অতঃপর রাসুলল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করলে আমি ফাতেমাকে বললাম, তোমার প্রতি আমার অধিকার রয়েছে। তাই আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি যে, তুমি আমাকে বল, রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাকে কী বলেছিলেন? সে বলল, 'এখন বলতে কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহর রসূল (সা.) প্রথমবারে কানাকানি করার সময় আমাকে সংবাদ দিয়েছিলেন যে, জিবরীল (আঃ) প্রত্যেক বছর একবার করে কুরআন শোনান। কিন্তু এখন তিনি দু’বার শুনালেন। সুতরাং আমি বুঝতে পারছি যে, আমার মৃত্যু সন্নিকটে। সুতরাং তুমি (হে ফাতেমা!) আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধারণ করো। (فإن نعم السلف أنا لك) কেননা, আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রগামী।” সুতরাং আমি (এ কথা শুনে) কেঁদে ফেললাম, যা তুমি দেখলে। অতঃপর তিনি আমার অস্থিরতা দেখে দ্বিতীয়বার কানে কানে বললেন, “হে ফাতেমা! তুমি কি এটা পছন্দ কর না যে, মুমিনদের নারীদের তুমি সর্দার হবে অথবা এই উম্মতের নারীদের সর্দার হবে?” সুতরাং (এমন সুসংবাদ শুনে) আমি হাসলাম, যা তুমি দেখলে।” (বুখারী ৬২৮৫, শব্দাবলী মুসলিমের ৬৪৬৭নং)
হাফেয নাওয়াবী (রাহিমাহুল্লাহ) সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে (১৬/৭) নবী (সা.)-এর উক্তি (فإن نعم السلف أنا لك) এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, 'সালাফঃ অগ্রগামী। এর অর্থ হল আমি তোমার পূর্বে গমনকারী, তুমি পরে আমার কাছে আগমন করবে।”
এ হল সলফ’ এর আভিধানিক অর্থ।
[২]. রাগেব আসফাহানী, মুফরাদাত ৪২০পৃঃ
[৩]. লিসানুল আরাব ৯/ ১৫৯, ইবনুল আমীরের বক্তব্য দেখুনঃ আন-নিহায়াহ