প্রিয় রসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, লোক তার জন্য দন্ডায়মান হোক সে যেন তার বাসস্থান জাহান্নামে করে নেয়।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)
আনাস (রাঃ) বলেন, 'তাদের (সাহাবাদের) নিকট রসূল (সা.) অপেক্ষা অন্য কেউই প্রিয়তম ছিল না। তা সত্ত্বেও তারা যখন তাকে দেখতেন তখন তার জন্য উঠে দাঁড়াতেন না। যেহেতু তারা জানতেন যে, তিনি তা অপছন্দ করেন।” (সহীহ তিরমিযী)
১। উক্ত হাদীসদ্বয় হতে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি কোন মজলিসে প্রবেশের সময় তার জন্য লোকেরা প্রত্যুত্থান করুক একথা পছন্দ ও কামনা করে সে জাহান্নাম প্রবেশের সম্মুখীন হয়। সাহাবাগণ রসূল (সা.)-কে অতিশয় ভালোবাসতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাকে দেখলে উঠে দন্ডায়মান হতেন না। কারণ তার জন্য উঠে দন্ডায়মান হওয়া তার নিকট যে অপছন্দনীয় তা তাঁরা জানতেন।
২। লোকেরা কিছু ব্যক্তিবর্গের জন্য উঠে দন্ডায়মান হওয়াটাকে অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছে, বিশেষ করে শায়খ যখন দর্স দেবার জন্য অথবা কোন স্থান যিয়ারতের জন্য প্রবেশ করেন, তদনুরূপ শিক্ষক যখন ক্লাসরুমে প্রবেশ করেন, তখন দেখা মাত্রই ছাত্রবৃন্দ তার সম্মানার্থে উঠে দন্ডায়মান হয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ খাড়া হতে না-ই চায়, তাহলে শিক্ষক ও গুরুর প্রতি তার বেআদবী ও অসম্মান দরুন তাকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়।
শায়খ ও শিক্ষকের সম্মানার্থে প্রত্যুত্থানের উপর তাদের নীরবতা এবং প্রত্যুত্থান করতে অসম্মত ছাত্রকে তিরস্কার করা এ কথারই দলীল যে, তাঁরা ঐ প্রত্যুত্থান ও দন্ডায়মান হওয়াকে মনে মনে পছন্দ করেন ও চান। যার ফলে তারা নিজেদেরকে জাহান্নামের সম্মুখীন করে তুলেন।
পক্ষান্তরে যদি তারা ঐ আদব পছন্দ না করতেন অথবা নিন্দনীয় জানতেন তাহলে নিশ্চয় তাঁরা তাঁদের ছাত্রদেরকে তা শিক্ষা দিতেন এবং তার পর হতে তাঁদের জন্য আর প্রত্যুত্থান না করতেই আদেশ দিতেন ও দন্ডায়মান হতে নিষেধকারী হাদীসসমূহ তাদের সামনে ব্যাখ্যা করতেন।
আলেম অথবা প্রবেশকারীর জন্য পুনঃপুনঃ উঠে দাঁড়ানো উভয়ের অন্তরে ঐ অভ্যাসের প্রেম সৃষ্টি করে ফেলে। ফলে যদি তার জন্য কেউ খাড়া না হয়, তাহলে মনে যেন কেমন ক্ষুন্নতা অনুভব করে। আর ঐ প্রত্যুত্থানকারীরা আগন্তুকের জন্য প্রত্যুত্থান-প্রেমের উপর শয়তানের সহায়ক হয়। অথচ নবী (সা.) বলেন, “তোমাদের ভায়ের বিরুদ্ধে শয়তানের সহযোগী হয়ো না।” (বুখারী)
৩। বহু লোক বলে থাকে, আমরা শায়খ বা শিক্ষকের জন্য দন্ডায়মান হই তাঁদের ইমের সম্মানার্থে। কিন্তু আমরা তাদেরকে বলব যে, তোমরা কি রসূল (সা.) -এর ইলম ও তাঁর প্রতি সাহাবাবর্গের আদব ও সম্মান প্রদর্শনে। সন্দেহ পোষণ কর? কই তা সত্ত্বেও তারা তো তাঁর জন্য দন্ডায়মান হননি। পরন্তু ইসলাম প্রত্যুত্থান ও কিয়াম দ্বারা সম্মান প্রদর্শন গণ্য করেনি। সম্মান তো আনুগত্য, আজ্ঞাপালন, সালাম (অভিবাদন) ও মুসাফা (করমর্দন) এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়।। এ বিষয়ে কবি শওকীর কথা স্বীকার্য নয়ঃ
‘উঠে দন্ডায়মান হও শিক্ষকের জন্য
ও তার পরিপূর্ণ সম্মান প্রদর্শন কর,
কারণ শিক্ষক প্রায় রসূল (সা.) হওয়ার কাছাকাছি!” যেহেতু এ কথা বিচ্যুতিহীন রসূল (সা.)-এর বাণীর পরিপন্থী, যিনি দন্ডায়মান হওয়াকে অপছন্দ করেছেন। আর যে ব্যক্তি তা পছন্দ করে, সে পছন্দ তার জাহান্নাম যাবার কারণ হবে।
৪। কোন কোন মজলিসে অবস্থান করে অধিকাংশ লক্ষ্য করেছি, সেখানে। একজন ধনবান প্রবেশ করলে তার জন্য লোকেরা প্রত্যুত্থান করে। কিন্তু পরক্ষণেই কোন দরিদ্র প্রবেশ করলে তার জন্য কেউ উঠে দাড়ায় না। এই দ্বিমুখো ব্যবহারের ফলে দরিদ্রের মনে ধনী এবং মজলিসে উপবিষ্ট সকল মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি হয়। পরিশেষে মুসলিম সমাজে পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা-দ্বেষ ও ঘৃণা অবস্থায়ী হয়ে যায়, যা হতে ইসলাম নিষেধ করেছে। আর এর মূল কারণ হয় ঐ কিয়াম বা প্রত্যুত্থান। পক্ষান্তরে যার জন্য লোকে উঠে দাড়ায় না সেই দরিদ্র ঐ ধনী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ হতে পারে, যার সম্মানার্থে লোকে উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। যেহেতু আল্লাহ বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেযগার (সংযমী) ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। (সূরা হুজরাত ১৩ আয়াত)
৫। হয়তো কেউ বলতে পারে যে, যদি আমরা আগন্তুকের জন্য খাড়া না হই, তাহলে সম্ভবতঃ সে উপবিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি মনে মনে ক্ষুন্ন হবে। (তাই তার মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে দাঁড়াতে হয়)। কিন্তু আমরা তাকে বলব, ঐ আগন্তুকের জন্য আমরা ব্যাখ্যা করব যে, তার । প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেম আমাদের অন্তরে বিদ্যমান। (কিন্তু তা প্রত্যুত্থান দ্বারা আমরা। প্রকাশ করতে পারি না। কারণ আমরা এ বিষয়ে (এবং সর্ববিষয়ে) রসূল (সা.) এর অনুকরণ করি, যিনি নিজের জন্য প্রত্যুত্থান (কারো উঠে দাঁড়ানোকে)
অপছন্দ করতেন এবং তাঁর সাহাবাবর্গেরও অনুসরণ করি, যারা তার উদ্দেশ্যে প্রত্যুত্থান করতেন না। আর আমরা আগন্তুকের জন্য জাহান্নাম প্রবেশকেও অপছন্দ করি।
৬। কিছু ওলামাদের হয়তো বলতে শুনবেন যে, রসূলের কবি হাসান বলেছিলেন, “প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হওয়া আমার জন্য ফরয।” তো একথা সঠিক ও শুদ্ধ নয়। ইবনে বাত্তাহ হাম্বলীর ছাত্র কি সুন্দরই না বলেছেন,
“আমাদের অন্তঃকরণ যদি বিশুদ্ধ হয়।
দেহকে কষ্ট না দিয়ে, তবে তাই যথেষ্ট।
তোমার ভাইকে এমন অভ্যর্থনা করার ভার দিওনা।
যাতে সে তোমার জন্য অবৈধ কর্মকে বৈধ করে ফেলে।
আমরা প্রত্যেকেই নিজ সুহৃদের প্রীতিতে আস্থাবান
তবে আবার আমাদের ক্ষোভ ও দুঃখ কিসে ?”