শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদের (সউদী আরবের রাজধানী রিয়া থেকে প্রায় ৫০ কিমি পশ্চিমে) উয়াইনাহ শহরে ১১১৫ হিজরী সনে। জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স দশ বছর হওয়ার পূর্বেই কুরআন হিফয করেন। আপন পিতার নিকট হাম্বলী ফিকহ অধ্যয়ন করেন এবং দেশের বিভিন্ন শায়খদের নিকট হাদীস ও তফসীর পাঠ করেন। বিশেষ করে মদীনা নববিয়্যার উলামাদের নিকট (শরীয়তের জ্ঞান লাভ করেন)। কিতাব ও সুন্নাহ হতে তওহীদকে বুঝেন। অতঃপর তিনি নিজ দেশ নাজদে এবং যে সব দেশ তিনি ভ্রমণ করেন সেখানে শির্ক, কুসংস্কার, বিদআত এবং সঠিক ইসলামের পরিপন্থী কবরপূজা দেখে শঙ্কিত হলেন।
নিজ দেশের অনুঢ়া যুবতীদের। দেখলেন, তারা ষাড়া খজুর বৃক্ষের অসীলায় প্রার্থনা করছে, বলছে, 'ওহে যাড়া বনস্পতি! বছর না ঘুরতেই চাই আমি পতি!’ হিজাযে দেখলেন, সাহাবাব, আহলে বায়ত এবং রসূলের কবরসমূহ ভক্তির আতিশয্যে পবিত্ররূপে পুজিত হচ্ছে -যে ভক্তি ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। মদীনায় তিনি শুনলেন, আল্লাহর পরিবর্তে রসূল (সা.) প্লঃ-এর নিকট লোকে সাহায্য প্রার্থনা করছে; যা কুরআন ও রসূলের বাণীর পরিপন্থী। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ
অর্থাৎ, এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডেকো না; যা তোমার উপকারও। করে না এবং অপকারও করে না, কারণ এ করলে তুমি যালেম (মুশরিক)-দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা ইউনুস ১০৬ আয়াত)
রসূল (সা.) স্বীয় পিতৃব্য-পুত্রকে সম্বোধন করে বলেন, 'যখন কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী এবং তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।) শায়খ একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে এবং তওহীদ বরণ করে নিতে মানুষকে আহ্বান করতে আরম্ভ করলেন। যেহেতু আল্লাহই সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আর বাকী সকল সৃষ্টি নিজের ও অপরের অমঙ্গল দূরীকরণে অক্ষম। আর যেহেতু সালেহীন (আওলিয়া)র মহব্বত তাঁদের অনুসরণ করে প্রকাশ হয়, আল্লাহ ও নিজেদের মাঝে তাদেরকে অসীলা বা মাধ্যম মেনে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদেরকে আহবান করে নয়।
১. বাতিলপন্থীদের বিরোধিতাঃ যে তওহীদী দাওয়াতের গুরুভার শায়খ গ্রহণ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে বিদআতীরা প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াল। অবশ্য এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, যেহেতু তওহীদের দুশমনরা রসূল প্ল-এর যুগেও ঐ দাওয়াতের বিরোধিতা করেছিল। তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল,
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ
অর্থাৎ, ওকি সকল মাবুদকে একই মা'বুদ বানিয়ে নিয়েছে? এতো আশ্চর্যের ব্যাপার! (সূরা সাদ ৫ আয়াত)
শায়খের শত্রুরা তার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ শুরু করে দিল। তার প্রসঙ্গে মিথ্যা অপবাদ প্রচার করতে লাগল। তাকে হত্যা করে তার ঐ দাওয়াত হতে নিস্কৃতিলাভের জন্য ষড়যন্ত্র করল। কিন্তু আল্লাহ তার হিফাযত করলেন এবং তার জন্য এক সহায়ক নিযুক্ত করে দিলেন। যার ফলে হিজায ও অন্যান্য মুসলিম দেশে তওহীদী দাওয়াত প্রচার ও প্রসার লাভ করল। কিন্তু অদ্যাবধি কিছু লোক সেই মিথ্যা অপবাদ প্রচারে ব্যস্ত। ওরা বলে, তিনি পঞ্চম আরো এক নতুন মহাব প্রবর্তন করেছেন, অথচ তার মযহাব হল। হাম্বলী। ওরা আরো বলে, ওয়াহাবীরা রসূলকে ভক্তি করে না বা ভালোবাসে না ও তার উপর দরূদ পড়ে না। অথচ শায়খ রাহেমাহুল্লাহ মুখতাসারু সীরাতির রসূল (ﷺ)” নামে এক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। যা এ কথারই দলীল যে, তিনি রসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসেন। ওা তার নামে আরো বিভিন্ন অপবাদ ও কুৎসা রটিয়ে থাকে, যে সম্পর্কে কাল কিয়ামতে ওদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি ওরা ইনসাফের সাথে উদার মনে তাঁর কিতাবসমূহ অধ্যয়ন। করত, তবে নিশ্চয় তাতে কেবল কুরআন, হাদীস ও সাহাবাবর্গের উক্তিই দেখতে পেত।
এক সত্যবাদী ব্যক্তি আমাকে জানান যে, এক আলেম তার দর্সে লোকদেরকে ওয়াহাবী থেকে সাবধান করতেন। উপস্থিতগণের মধ্য হতে এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের লিখা একটি পুস্তক লেখকের নাম সহ প্রথম পৃষ্ঠা ছিড়ে তাকে পড়তে দিলেন। তিনি তা পড়ে পছন্দ করলেন। অতঃপর যখন লেখক সম্পর্কে জানলেন তখন তিনি তার প্রশংসা করতে লাগলেন।
২। হাদীসে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম ও ইয়ামানে বৰ্কত (প্রাচুর্য) দান কর।” সকলে বলল, আর আমাদের নজদে?” তিনি বললেন, “ওখান হতে শয়তানের শৃঙ্গ উদিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ইবনে হাজার আস্কালানী প্রভূতি ওলামাগণ উল্লেখ করেন যে, হাদীসে উল্লেখিত ঐ নজদ হল ইরাকের নজদ। সুতরাং ইরাকেই যত বড় বড় ফিতনা ফাসাদের প্রাদুর্ভাব ঘটে। হুসাইন বিন আলী , ওখানেই শহীদ হন। কিন্তু এর বিপরীত, কিছু লোক মনে করে উক্ত নজদ’ বলতে হিজাযের নজদ’কে বুঝানো হয়েছে। অথচ সেখানে কোন ফিতনাহ দেখা দেয়নি যেমন ইরাকে বহু ফিতনা দেখা দিয়েছে। বরং হিজাযের নজদ থেকে তো সেই তওহীদের সংস্কার সাধন হয়েছে যার কারণে বিশ্বজগৎ রচিত এবং যার কারণে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন।[১]
৩। কিছু ন্যায়পরায়ণ উলামা উল্লেখ করেন যে, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব হলেন হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ (ইসলামী সংস্কারক)। অনেকে তার প্রসঙ্গে বহু বই-পুস্তকও রচনা করেন। ঐ লেখকদের মধ্যে শায়খ আলী ত্বত্বাবী অন্যতম, যিনি ঐতিহাসিক আদর্শ ও প্রতিভাবান মহাপুরুষদের প্রসঙ্গে এক ধারাবাহিক পুস্তক রচনা করেছেন। যাদের মধ্যে তিনি শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এবং আহমদ বিন ইরফানের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি ঐ পুস্তকে ঐ কথাও উল্লেখ করেন যে, ভারতে তওহীদের আকীদা পৌছে মুসলিম হাজীগণের মাধ্যমে যারা মক্কায় হজ্জ করতে এসে ঐ আকীদায় প্রভাবান্বিত হয়ে দেশে ফিরেন।
পরে ইংরেজ ও ইসলাম-দুশমনরা ঐ আকীদার বিরুদ্ধে বাধ সাধে। কারণ ঐ আকীদায় তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেছিল। তাই অর্থলোভী স্বার্থপর (মুসলিম)দের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তাদের বদনাম করতে প্রয়াস চালায়। ফলে তওহীদের প্রতি আহবানকারী প্রত্যেক তওহীদবাদীর নাম (তুচ্ছভাবে) ওয়াহাবী রাখে[২] এবং এইরূপ বলে কোন অভিনব দ্বীন প্রবর্তক (বিদআতী) রূপে তাকে চিহ্নিত করতে চায়। যাতে মুসলিমরা তাদের মূল তওহীদের আকীদা থেকে ফিরে আসে, যে আকীদা তাদেরকে কেবল এক আল্লাহকে ডাকার প্রতি আহবান করে। কিন্তু সে নির্বোধরা একথা বুঝতে পারেনি যে, ওয়াহাবী” শব্দটি ‘আল-ওয়াহহাব’এর সহিত সম্বদ্ধ; যা আল্লাহর পবিত্র নামাবলীর অন্যতম নাম। (যার অর্থ মহাদা) যিনি তাকে (ওয়াহাবীকে) তওহীদ দান করেছেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
[২]. যা ইতিহাসে ওয়াহাবী আন্দোলন’ বলে সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ। (অনুবাদক)