অধিকাংশ বিদআতীরা দুর্বল হাদীসের উপর ভিত্তি করে বিদআত (আমল) করে থাকে। এই ধরনের হাদীস ব্যাপকভাবে প্রচার করে থাকে। এর দ্বারা তাদের লিখিত কিতাবের কলেবরও বৃদ্ধি করে থাকে অথচ ঠিক একই সময়ে বহু সংখ্যক সহীহ হাদীসকে রদ করে থাকে। তার উপর আমল করতে অজুহাত পেশ করে বলে, 'ঐ হাদীস অসূলের খেলাফ’, অথবা ওটা খবরে ওয়াহেদ ইত্যাদি। আর এই ধরনের খোঁড়া ওজরে কত সুন্নত বরং ওয়াজেব ত্যাগ করে বসে।।
আবার প্রতিবাদ করে যদি ওদেরকে বলা হয় যে, যে হাদীসের উপর ভিত্তি করে আমল করছেন তা তো যয়ীফ অথবা মওযু'। তখন ওরা তার প্রত্যুত্তরে এমন কথা বলে যা অর্থহীন। যেমন বলে যে, 'ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীসের উপর আমল চলবে’ ইত্যাদি। অথচ এ কথা শর্তহীন নয়। (দেখুনঃ তানবীহু উলিল আবসার)। “মুহাদ্দেসীন ও অসুলিইয়্যীনদেন নিকট যথাস্থানে নির্দিষ্ট শর্তাবলীর সহিত ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা যায়।” এই কথার উপর দুটি আপত্তিমূলক টিপ্পনী রয়েছে।
(১) এই উক্তি হতে অনেকেই সাধারণ’ বা ‘ব্যাপক অর্থ বুঝে থাকে। মনে করে যে, উক্ত আমলে উলামাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। অথচ এ রকমটা নয় বরং তাতে বিদিত মতভেদ বর্তমান যা বিভিন্ন হাদীসের পারিভাষিক (অসূলেহাদীসের) গ্রন্থ মূহে বিশদভাবে আলোচিত। যেমন আল্লামা শায়খ জামালুদ্দীন কাসেমী (রঃ) তার গ্রন্থ (কাওয়ায়েদুল হাদীসে) আলোচনা করেছেন। তিনি ১১৩ পৃষ্ঠায় ইমামগণের এক জামাআত থেকে নকল করেন যে, তাঁরা আদপে যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা ঠিক মনে করতেন না। যেমন, ইবনে মাঈন, বুখারী, মুসলিম, আবু বাকর ইবনুল আরাবী প্রভৃতিগণ। এঁদের মধ্যে ইবনে হাযম অন্যতম; তিনি তার গ্রন্থ আল-মিলাল অনিহাল’ এ বলেন, '(সেই হাদীস দ্বারা আমল সিদ্ধ হবে) যে হাদীসকে পূর্ব ও পশ্চিমের লোকেরা (অর্থাৎ, বহু সংখ্যক লোক) কিংবা সকলেই সকল হতে কিংবা বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত হতে নবী প্ল থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু যে হাদীসের বর্ণনা-সুত্রে কোন মিথ্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, কিংবা কোন অমনোযোগী গাফেল ব্যক্তি কিংবা কোন পরিচয়হীন অজ্ঞাত ব্যক্তি থাকে, তাহলে সেই হাদীস (যয়ীফ হওয়া সত্ত্বেও তার) দ্বারা কতক মুসলিম বলে থাকে (আমল করে থাকে)। অবশ্য আমাদের নিকট এমন হাদীস দ্বারা কিছু বলা (বা আমল করা), তা সত্য জানা এবং তার কিছু অংশ গ্রহণ করাও অবৈধ।
হাফেয ইবনে রজব তিরমিযীর ব্যাখ্যা-গ্রন্থে (২/১১২)তে বলেন, 'ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় যা উল্লেখ করেছেন তার প্রকাশ্য অর্থ এই বুঝায় যে, তরগীব ও তরহীবে (অনুপ্রেরণাদায়ক ও ভীতি সঞ্চারক)এর হাদীসও তার নিকট হতেই বর্ণনা করা হবে, যার নিকট হতে আহকাম (কর্মাকর্ম সম্পর্কিত)এর হাদীস বর্ণনা করা হয়। (অর্থাৎ যয়ীফ রাবী হতে যেমন আহকামের হাদীস বর্ণনা করা হয়। না, তেমনিই সেই রাবী হতে তরগীব ও তরহীবের হাদীসও বর্ণনা করা হবে না।)
এ যুগে অদ্বিতীয় মুহাদ্দেস আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, 'এই অভিমত ও বিশ্বাস রেখেই আমি আল্লাহর আনুগত্য করি এবং এই অভিমতের প্রতিই মানুষকে আহবান করি যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা আদপে আমল করা যাবে না, না ফাযায়েল ও মুস্তাহাব আমলে আর না অন্য কিছুতে। কারণ, যয়ীফ হাদীস কোন বিষয়ে অনিশ্চিত ধারণা জন্মায় মাত্র (যা নিশ্চিতরূপে রসুল প্লঃ-এর বাণী নাও হতে পারে।)* এবং আমার জানা মতে, উলামাদের নিকট এটা অবিসংবাদিত। অতএব যদি তাই হয়, তবে কিরূপে ঐ হাদীস দ্বারা আমল করার কথা বৈধ বলা যায়? অথচ আল্লাহ অজাল্লা তাঁর কিতাবে একাধিক স্থানে ধারণার নিন্দাবাদ করেছেন; তিনি বলেন,
وَمَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ ۖ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
অর্থাৎ, ওদের এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই, ওরা অনুমানের অনুসরণ করে অথচ সত্যের বিরুদ্ধে অনুমানের (ধারণার) কোন মূল্য নেই। (সূরা নাজ্ম ২৮ আয়াত)
আর আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, “তোমরা অনুমান (ধারণা) করা হতে বাঁচ। অবশ্যই অনুমান সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা।” (বুখারী ও মুসলিম)
জেনে রাখুন যে, আমি যে রায় এখতিয়ার করেছি তার প্রতিপক্ষের নিকট এই রায়ের বিপক্ষে) কিতাব ও সুন্নাহ থেকে কোন দলীল নেই। অবশ্য পরবর্তীযুগের কোন আলেম তার গ্রন্থ আল-আজবিবাতুল ফাযেলাহ’ তে এই মাসআলার উপর নির্দিষ্ট পরিচ্ছেদে (৩৬-৫৯পৃঃ) ওঁদের সমর্থনে (ও আমাদের এই অভিমতের বিরুদ্ধে) দলীল পেশ করার প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের সপক্ষে অন্ততঃপক্ষে একটিও এমন দলীল উল্লেখ করতে সক্ষম হননি, যা হুজতের। উপযুক্ত! হ্যাঁ, তবে কিছু এমন উক্তি তাঁদের কারো কারো নিকট হতে নকল করেছেন, যেগুলি উক্ত বিতর্ক ও সমীক্ষার বাজারে অচল।
এতদসত্ত্বেও ঐ সমস্ত উক্তির কিছু কিছুতে পরস্পর-বিরোধিতাও বিদ্যমান। যেমন, ৪১ পৃষ্ঠায় ইবনুল হুমাম হতে নকুল করেন, “গড়া নয় এমন যয়ীফ হাদীস দ্বারা ইস্তিহবাব প্রমাণিত হবে।” অতঃপর ৫৫-৫৬ পৃষ্ঠায় জালালুদ্দীন দাওয়ানী হতে নকল করেন, তিনি বলেছেন, এ কথা সর্বসম্মত যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা শরীয়তের আহকামে খামসাহ’ (অর্থাৎ ওয়াজেব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মকরূহ ও হারাম) প্রমাণিত হবে না এবং ওর মধ্যে ইস্তিহবাবও।
আমি (আলবানী) বলি, এ কথাটাই সঠিক। যেহেতু অনুমান দ্বারা আমল নিষিদ্ধ এবং যয়ীফ হাদীস অনিশ্চিত অনুমান বা ধারণা সৃষ্টি করে, যেমন পূর্বে আলোচিত
মোট কথা, ফাযায়েলে আমাল বলতে এমন আমল যার ফযীলত আছে, তা যয়ীফ হাদীসের উপর ভিত্তি করে করা যাবে না। করলে তা বিদআত বলে গণ্য। হবে। যেহেতু যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন আহকাম বা আমল (অনুরূপ কোন আকীদাও) সাব্যস্ত হয় না। তবে এমন আমল যা সহীহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে তার ফযীলত বর্ণনায় আমল করা যায়, তবে তারও শর্ত আছে যা পরে বলা হবে।
উদাহরণস্বরূপ, চারে নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মুসলিম) কিন্তু তার ফযীলত প্রসঙ্গে এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি ঐ নামায পড়বে তার পাপ সমুদ্রের ফেনার সমান হলেও ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি নিয়মিত বারো রাকআত চাশ্বের নামায পড়ে, তার জন্য আল্লাহ পাক বেহেস্তে এক সোনার মহল তৈরী করেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
আর এ দুটি হাদীসই যয়ীফ। চাশ্বের নামাযের এই ফযীলত বিশ্বাসে (ওঁদের মতে) তা ব্যবহার করা যায়। অনুরূপভাবে কুরবানী করা ও তার মর্যাদা কুরআন ও সুন্নাহতে প্রমাণিত তার ফযীলত বর্ণনায় (ওঁদের মতে কিছু শর্তের সাথে) কুরবানীর পশুর প্রত্যেক লোমের পরিবর্তে এক একটা নেকী--” এই হাদীস ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।।
এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, “শরীয়তে যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করা বৈধ নয়, যা সহীহ বা হাসান নয়। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল প্রভৃতি উলামাগণ ফাযায়েলে আমালে সাবেত (প্রমাণসিদ্ধ) বলে জানা না যায় এমন হাদীস বর্ণনা করাকে জায়েয বলেছেন, যদি তা (ঐ যয়ীফ হাদীস) মিথ্যা বলে জানা না যায় তবে।
অর্থাৎ, যখন জানা যাবে যে, আমল শরয়ী (সহীহ) দলীল দ্বারা বিধেয় এবং তার ফযীলতে এমন হাদীস বর্ণিত হয় যা মিথ্যা (মওযু’) বলে জানা যায় না, তাহলে (হাদীসে বর্ণিত) সওয়াব সত্য হতে পারে (এই বিশ্বাস করা যায়)। কিন্তু ইমামগণের কেউই এ কথা বলেননি যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন কিছুকে ওয়াজেব অথবা মুস্তাহাব করা যাবে। আর যে এ কথা বলে সে ইজমা’ (সর্ববাদীসম্মতি)র বিরোধিতা
করে। তদনুরূপ, কোন শরয়ী (সহীহ) দলীল ছাড়া কোন কিছুকে হারাম করাও অবৈধ। কিন্তু যদি (কোন সহীহ হাদীস দ্বারা) তার হারাম হওয়ার কথা বিদিত হয়। এবং ঐ কাজের কর্তার জন্য শাস্তি বা তিরস্কারের কথা কোন এমন (দুর্বল) হাদীসে বর্ণিত হয় - যা মিথ্যা বলে জানা না যায় - তবে তা (ঐ শাস্তির বিশ্বসে) বর্ণনা করা বৈধ। অনুরূপভাবে তরগীব ও তরহীবে ঐরূপ হাদীস বর্ণনা করা বৈধ হবে; যদি তা মিথ্যা (গড়া) বলে পরিচিত না হয়। কিন্তু এ কথা জানা জরুরী হবে যে, আল্লাহ এ বিষয়ে এই অজ্ঞাতপরিচয় হাদীস ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় (সহীহ) দলীলে তরগীব বর্ণনা করেছেন।
অনুরূপভাবে ইসরাঈলিয়াতও তরগীব ও তরহীবে বর্ণনা করা যায়, যদি তা মিথ্যা বলে বিদিত না হয় এবং যখন জানা যায় যে, ঐ বিষয়ে আল্লাহ পাক আমাদের শরীয়তে আদেশ দান করেছেন অথবা নিষেধ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র অপ্রমাণিত (অশুদ্ধ) ইসরাঈলিয়াত দ্বারা আমাদের শরীয়ত প্রমাণ করা হবে -এ কথা কোন। আলেম বলেন না। বরং ইমামগণ এই ধরণের কোন হাদীসকেই শরীয়তের বুনিয়াদ করেন না। আহমাদ বিন হাম্বল এবং তার মত কোন ইমামই শরীয়তে ঐ ধরনের হাদীসের উপর নির্ভর (ভিত্তি) করতেন না। যে ব্যক্তি নকল করে যে, আহমাদ। যয়ীফ হাদীসকে হুজ্জত (বা দলীল) করতেন; যে হাদীস সহীহ বা হাসান নয়, তবে নিশ্চয় সে তার সম্পর্কে ভুল বলে।” (আল কায়েন্নাতুল জালীয়াহ ৮২ পৃঃ, মজমুত্ম ফাতাওয়া ১/২৫ ১ নং)।
আল্লামা আহমাদ শাকের আল-বায়েষুল হাষীষ’ গ্রন্থে (১০১ পৃষ্ঠায়) বলেন, ‘আহমাদ বিন হাম্বল, আব্দুর রাহমান বিন মাহদী এবং আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রঃ) এর উক্তি, যখন আমরা হালাল ও হারামে (আহকামে) হাদীস বর্ণনা করি, তখন কড়াকড়ি করি এবং যখন ফাযায়েল ইত্যাদিতে বর্ণনা করি তখন শৈথিল্য করি-- আমার মতে -অল্লাহ আ’লাম- তাঁদের বলার উদ্দেশ্য এই যে, শৈথিল্য কেবল হাসান হাদীস গ্রহণে করতেন যা সহীহ’ এর দর্জায় পৌছে না। কারণ সহীহ ও হাসানের মাঝে পার্থক্যরূপ পরিভাষা তাঁদের যুগে স্পষ্ট স্থিত ছিল না। বরং অধিকাংশ পূর্ববর্তীগণ হাদীসকে কেবল সহীহ অথবা যয়ীফ (এই দুই প্রকার) বলেই মনে করতেন।
সুতরাং তাঁদের ঐ শৈথিল্য যয়ীফ হাদীস বর্ণনায় নয়, হাসান হাদীস বর্ণনায়।) আল্লামা আলবানী বলেন, 'আমার নিকট এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা রয়েছে, তাদের ঐ উল্লেখিত শৈথিল্য ইসনাদ (বর্ণনা সূত্র)সহ যয়ীফ হাদীস রেওয়ায়াত করার উপর মানা যায় - যেমন তাদের বর্ণনার ধারা ও প্রকৃতি; যে ইসনাদ সমূহের মাধ্যমে হাদীসের দুর্বলতা জানা সম্ভব হয়। সুতরাং কেবলমাত্র সনদ উল্লেখ করাই যথেষ্ট হয় এবং যয়ীফ’ বলে বিবৃত করার প্রয়োজন আর থাকে না। কিন্তু ঐ ধরণের হাদীস বিনা সনদে বর্ণনা করা যেমন পরবর্তীকালে উলামাগণের ধারা ও প্রকতি এবং তার। দুর্বলতা বর্ণনা না করা যেমন ওঁদের অধিকাংশের রীতি - এমন পদ্ধতি অবলম্বন। করা থেকে তাঁরা (ইমাম আহমাদ প্রভৃতিগণ) বহু ঊর্ধে এবং এ বিষয়ে তাঁরা আল্লাহকে অধিক ভয় করতেন। আর আল্লাহই অধিক জানেন।
(২) যে ব্যক্তি এ ধরণের কোন গ্রন্থ লিখেন যাতে চোখ বুজে সহীহ-যয়ীফ সবই সংকলন করেন এবং মনে করেন যে, কিছু শর্তের সাথে যয়ীফ হাদীস দ্বারা ফাযায়েলে আ’মালে আমল করা যায় তাঁর উচিত, গ্রন্থের ভূমিকায় সে বিষয়ে (সাধারণকে) সতর্ক করা এবং ঐ শর্তাবলী উল্লেখ করে (সেই অনু্যায়ী) আমল করতে সাবধান করা। যাতে পাঠকও অজান্তে গ্রন্থে উল্লেখিত প্রত্যেক হাদীসের উপর আমল এবং মুবাল্লেগও ঐ গ্রন্থ শুনিয়ে সকলকে আমল করার তাকীদ না করে বসে। ফলে সকলের অজান্তেই সকলে রসুলের বিরোধিতায় লিপ্ত না হয়ে পড়ে। সুতরাং ঐ শর্তগুলিকে জানা একান্ত জরুরী; বিশেষ করে তাদের জন্য যারা ফাযায়েলে যয়ীফকে ব্যবহার করে থাকে। যাতে যে কেউ ধংস হবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট জানার পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট জানার পর জীবিত থাকে। হাফেয সাখাবী ‘আল-কওলুল বাদী’ (১৯৫ পৃঃ)তে তার ওস্তাদ হাফেয ইবনে হাজার থেকে ঐ শর্তগুলি নকল করেছেন এবং তা নিম্নরূপঃ
(ক) হাদীস যেন খুব বেশী যয়ীফ না হয়। অথবা তার বর্ণনা সুত্রে যেন কোন মিথ্যাবাদী, মিথ্যায় কলঙ্কিত বা অভিযুক্ত এবং মারাত্মক ত্রুটি করে এমন ব্যক্তি না থাকে।
(খ) তা যেন (শরীয়তের) সাধারণ ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ একেবারে ভিত্তিহীন গড়া বা জাল হাদীস না হয়। (গ) এ হাদীস দ্বারা আমল করার সময় যেন তা প্রমাণিত (বা শুদ্ধ) হাদীস বলে। বিশ্বাস না রাখা হয়। যাতে নবী ধ্রু-এর সহিত সেই সম্পর্ক না জোড়া হয়; যা তিনি বলেননি। অতঃপর তিনি বলেন শেষোক্ত শর্ত দুটি ইবনে আব্দুস সালাম ও ইবনে দাক্বীকুল ঈদ হতে বর্ণিত এবং প্রথমোক্তের জন্য আলাঙ্গ বলেন, ‘তা সর্বদিসম্মত।
ইবনে হাজার (রঃ) তাঁর পুস্তিকা তাবয়ীনুল আজব’ এ বলেন, 'আহলে ইলমগণ ফাযায়েলে যয়ীফ হাদীস ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন; যদি তা গড়া না হয় বা খুব বেশী যয়ীফ না হয় -এ কথাটি প্রসিদ্ধ। কিন্তু এর সহিত এই শর্তও আরোপ করা উচিত যে, আমলকারী যেন ঐ হাদীসটিকে যয়ীফ বলেই বিশ্বাস রাখে (শুদ্ধ মনে না করে) এবং তা যেন প্রচার না করে। যাতে কেউ যেন যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করে যা শরীয়ত নয় তাকে শরীয়ত করে না বসে অথবা কোন জাহেল তাকে আমল করতে দেখে তা সহীহ সুন্নাত মনে না করে বসে।
এ বিষয়ে আবু মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুস সালাম প্রভৃতি উলামাগণ বিবৃতি দিয়েছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর রসূল ধ্রু-এর সেই বাণীর পর্যায়ভুক্ত না হয়ে পড়ে যাতে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আমার তরফ থেকে কোন এমন হাদীস বর্ণনা করে যার বিষয়ে সে মনে করে যে তা মিথ্যা, তাহলে সে (বর্ণনাকারী) মিথ্যাবাদীদের একজন।” (মুসলিম, সহীহুল জামে’৬১৯৯নং)
সুতরাং যে আমল করবে তার অবস্থা কি? আহকাম অথবা ফাযায়েলে (যয়ীফ) হাদীস দ্বারা আমল করায় কোন পার্থক্য নেই। (অর্থাৎ যদি যয়ীফ হাদীস দ্বারা আহকাম বা হালাল ও হারামে আমল না চলে তবে ফাযায়েলেও চলবে না। কারণ, (উভয়ের) সবটাই শরীয়ত।
আল্লামা আলবানী (রঃ) বলেন, 'এই সমস্ত শর্তাবলী খুবই সুন্ন ও গুরুত্বপুর্ণ। যদি যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমলকারীরা এর অনুগামী হয়, তাহলে তার ফল এই হবে যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমলের সীমা সংকীর্ণ হবে অথবা মূলেই আমল প্রতিহত হবে। এর বিররণ তিনভাবে দেওয়া যায়ঃ| প্রথমতঃ প্রথম শর্তটি নির্দেশ করে যে, যে হাদীসকে ভিত্তি করে আমল করার ইচ্ছা হবে সেই হাদীসটির প্রকৃত অবস্থা জানা ওয়াজেব। যাতে বেশী যয়ীফ হলে। তার দ্বারা আমল করা থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রত্যেক হাদীসের উপর এই জ্ঞান লাভ জনসাধারণের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। যেহেতু হাদীসশাস্ত্রবিদ উলামার সংখ্যা নেহাতই কম, বিশেষ করে বর্তমান যুগে। অর্থাৎ, (সেই উলামার সংখ্যা নগণ্য যাঁরা তথ্যানুসন্ধানকারী (সমস্ত হাদীসের সত্যাসত্য যাচাইকারী) গবেষণা ও সমীক্ষাকারী হাদীস বিশারদ, যাঁরা রসুল প্ল হতে শুদ্ধ প্রতিপাদিত হাদীস ব্যতীত লোকদের জন্য অন্য কোন হাদীস পরিবেশন ও বর্ণনা করেন না এবং যয়ীফ (তথা তার নিম্নমানের) হাদীসের উপর সকলকে সতর্ক ও সাবধান করে থাকেন। বরং এই গ্রুপের উলামা অল্পের চেয়ে কম। সুতরাং আল্লাহই সাহায্যস্থল।
এরই কারণে দেখেবেন, যারা হাদীস দ্বারা আমলে আপদগ্রস্ত হয়েছে তারা এই শর্তের স্পষ্ট বিরোধিতা করে। তাদের কেউ যদিও বা সে অহাদীসের আলেম হয় - ফাযায়েলে আমালে কোন হাদীস জানা মাত্রই তা অধিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত কিনা। তা না জেনেই তার উপর আমল করায় ত্বরান্বিত হয়। এরপর যদি কেউ তাকে ঐ হাদীসের দুর্বলতার উপর সতর্ক করে, তবে শীঘ্র ঐ তথাকথিত কায়দার’ শরণাপন্ন হয়; “ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীস ব্যবহার করা যায়।” পুনশ্চ যখন এই শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তখন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে যায়। এ বিষয়ে আল্লামা দুটি উদাহরণ পেশ করেন? (১) “সর্বোৎকৃষ্ট দিন আরাফার দিন; যদি জুমআর দিনের মুতাবেক হয় তবে তা সত্তর হজ্জ অপেক্ষা উত্তম।” (রাযীন)
এ হাদীসটির প্রসঙ্গে আল্লামা শায়খ আলী আল-ক্বারী বলেন, কিছু মুহাদ্দেসীন বলেন যে, এই হাদীসের ইসনাদটি যয়ীফ, তা সঠিক মানা গেলেও উদ্দেশ্যে কোন ক্ষতি হয় না। যেহেতু যয়ীফ হাদীস ফাযায়েলে আমালে গ্রহণীয় এবং আল্লামা আবুল হাসানাত লখনবী এই কথা নকল করে বহাল করেছেন। (আল আজৰিবাতুল ফাযেলাহ ৩৭ পৃঃ) কিন্তু ভাবার বিষয় যে, কিরূপে এই শ্রদ্ধাভাজন আলেমদ্বয় উপযুক্ত শর্ত লংঘন করেছেন। অথবা নিশ্চয় তাঁরা এই হাদীসের সনদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। থাকলে অবশ্যই তা বিবৃত করেন এবং তার পরিবর্তে বিতর্ক ছলে ‘তা মানা গেলেও এই কথা বলতেন না। অথচ আল্লামা ইবনুল কাইয়েম ঐ হাদীস প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বলেন, 'বাতিল, রসূলুল্লাহ প্লঃ হতে ওর কোন ভিত্তি নেই, আর না কোন সাহাবী বা তাবেয়ী হতে।” (যাদুল মাআদ ১/১৭) (২) “যখন তোমরা হাদীস লিখবে, তখন তোমরা তার সনদ সহ লিখ। যদি তা সত্য হয়, তাহলে তোমরা সওয়াবের অংশীদার হবে। আর যদি তা বাতিল হয়, তাহলে তার পাপ তার (বর্ণনাকারীর) হবে।” (আল আজৰিবাতুল ফাযেলাহঃ ২৬পৃঃ)
এই হাদীসটি মওযু’ (গড়া হাদীস)। (দেখুন ও সিলসিলাতু আহাদীসিয যয়ীফাহ অল মওযুআহ ৮২২নং) এতদসত্ত্বেও শ্রদ্ধেয় লখনবী সাহেব এর উপর চুপ থেকেছেন। কারণ, এটাও ফাযায়েলে আমাল তাই! অথচ এটি এমন একটি হাদীস যা যয়ীফ ও জাল হাদীস প্রচার করতে ও তার উপর আমল করতে সকলকে অনুপ্রাণিত করে। যার মর্মার্থ হচ্ছে নকলকারীর কোন পাপ নেই। অথচ এমন ধারণা আহলে ইলমদের নীতির পরিপন্থী। যেহেতু তাঁদের নীতি এই যে, গড়ার কথা বিবৃত না করে কোন গড়া হাদীস বর্ণনা করাই জায়েয নয়। তদনুরূপ যথার্থতা যাচাইকারী সংস্কারক উলামা; যেমন ইবনে হিব্বান প্রভৃতিগণের নিকট যয়ীফ হাদীসও (তার দুর্বলতা উল্লেখ না করে বর্ণনা বৈধ নয়)।
আল্লামা আহমাদ শাকের উপযুক্ত তিনটি শর্তাবলী উল্লেখ করা সর্বাবস্থায় ওয়াজেব। কারণ, তা উল্লেখ না করলে পাঠক অথবা শ্রোতার ধারণা হয় যে, তা সহীহ বিশেষ করে, নকলকারী অথবা বর্ণনাকারী যদি উলামায়ে হাদীসের মধ্যে কেউ হন (অথবা দ্বীনের বুযুর্গ হন ও সমাজে মান্য হন); যাঁর প্রতি সকলে হাদীস বিষয়ে রুজু করে। যেহেতু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ না করায় আহকামে ও ফাযায়েলে আমাল ইত্যাদির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং সহীহ বা হাসান - যা রসুল থেকে শুদ্ধরূপে প্রমাণিত হয়েছে - তা ব্যতীত কোন কিছুতে কারো হুজ্জত বা দলীল নেই।' (মুখতাসার আল-বায়েষুল হাষীষ ১০ ১পৃঃ)
আল্লামা আলবানী বলেন, 'সার কথা এই যে, এই শর্তের পালন কার্যতঃ যে হাদীস (শুদ্ধ বা সহীহ বলে) প্রতিপাদিত নয়, সেই হাদীস দ্বারা আমল ত্যাগ করতে বাধ্য করে। কারণ, সাধারণ মানুষের পক্ষে (যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসের) অধিক দুর্বলতা জানা (ও চিহ্নিত করা) কঠিন। ফলতঃ এই শর্তারোপ করার অর্থ ও উদ্দেশ্যের সহিত যা আমরা এখতিয়ার করেছি তার প্রায় মিল রয়েছে এবং সেটাই উদ্দিষ্ট। দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় শর্ত থেকে একথাই বুঝা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে আমল যয়ীফ হাদীস দ্বারা নয়, বরং সাধারণ ভিত্তি না থাকলে (কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ হতে ঐ আমলের মূল বুনিয়াদ না থাকলে) যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল হয় না। অতএব এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, এই শর্তের সহিত যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা আপাতদৃষ্ট, বস্তুতঃ নয়। আর সেটাই অভীষ্ট।
তৃতীয়তঃ তৃতীয় শর্তটি হাদীসের দুর্বলতা জানা জরুরী হওয়ার ব্যাপারে প্রথম শর্তেরই অনুরূপ। যাতে আমলকারী তা (সহীহ) প্রমাণিত বলে বিশ্বাস না করে বসে। অথচ বিদিত যে, যারা ফাযায়েলে যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে আমল করে তাদের অধিকাংশই হাদীসের দুর্বলতা চেনে না। আর এটা উদ্দেশ্যের বিপরীত।
পরিশেষে স্থূল কথা এই যে, আমরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মুসলিম জন সাধারণকে উপদেশ করি যে, তাঁরা যেন যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা আদপেই ত্যাগ করেন এবং নবী প্ল থেকে প্রমাণিত (সহীহ বা হাসান) হাদীস দ্বারা আমল করতে উদ্যোগী হন। যেহেতু তাতেই যা আছে যয়ীফ হাদীস থেকে অমুখাপেক্ষী করে। (আমলের জন্য তাই যথেষ্ট।) আর ওটাই রসুল প্ল-এর উপর মিথ্যা বলায় আপতিত হওয়া (ও নিজের ঠিকানা জাহান্নাম করে নেওয়া) থেকে বাঁচার পথ। কারণ, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় জানি যে, যারা এ বিষয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে তারা উক্ত মিথ্যাবাদিতায়। সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। যেহেতু তারা প্রত্যেক সবল-দুর্বল (এবং জাল ও গড়া) হাদীস (এবং অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কেচ্ছা-কাহিনীকে হাদীস ধারণা করে তার দ্বারা) আমল করে থাকে। অথচ নবী প্লঃ (এর প্রতি ইঙ্গিত করে) বলেন, “মানুষের মিথ্যাবাদিতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (অনুরূপভাবে যা পড়ে) তার সবটাই বর্ণনা করে।” (মুসলিম)।
আর এর উপরেই বলি মানুষের ভ্রষ্টতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (বা পড়ে) তার সবটার উপরই (বিচার-বিবেক না করে) আমল করে। (যেহেতু চকচক করলেই সোনা হয় না।) (দ্রষ্টব্যঃ সহীহহুল জামেইস সাগীর, ভূমিকা ৪৯-৫৬পৃঃ, তামামুল মিন্নাহ ভূমিকা)