বিদআত দর্পণ বিদআত সৃষ্টির কারণ আবদুল হামীদ ফাইযী ১ টি
(৭) উলামাদের নীরবতা ও স্বার্থান্বেষিতা

আল্লাহ পাক বলেন,

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

অর্থাঃ, তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎকার্য থেকে নিষেধ করবে এবং ওাই হবে সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান ১০৪ আয়াত)

কিন্তু এই উম্মাহ যে সমস্ত বিপদ ও দুর্বলতার সম্মুখীন, তার মধ্যে উলামাদের আলস্য ও নীরবতা অন্যতম। আল্লাহর অর্পিত এই মহান দায়িত্ব পালনে উলামাগণ তোষামদ ও মনোরঞ্জনের পথ অবলম্বন করেছেন। উদরপূর্তি, অর্থ লাভ, কিছু আনন্দোপভোগ, পদ ও গদি বহাল প্রভৃতি স্বার্থলাভের খাতিরে বিদআত থেকে নিষেধ করা তো দুরের কথা বরং তাতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বরং তার চেয়েও বিস্মৃকর কথা এই যে, স্বার্থবশে তাতে শরীক হয়ে তার সুষ্ঠু উদ্যাপন করে থাকেন। যাদের অনেকে বেনামাযীর জানাযা পড়েন। কিন্তু তার চালশে (মীলাদ) পড়তে বা তার নামে কুরআনখানী বা শবীনা পড়তে কখনো ভুল করেন না।

অবশ্য এ কথার অর্থ এই নয় যে, কর্তব্যপরায়ণ আলেমই সমাজে নেই। এমন। আলেম তো প্রতি দেশ ও যুগে থেকেছেন ও আছেন, যাঁরা সুন্নাহ থেকে বিদআতের পার্থক্য-নির্বাচন করেন এবং ভালো-মন্দ বিচার করে ভালোর পথে চলতে সমাজকে আদেশ করেন। বিদআতকে দস্তুরমত খন্ডন করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। আর লোকেরাও তাদেরকে চিনতে ভুল করে।

প্রতিহত না হলে বাতিল খুব শীঘ্রই বেড়ে উঠতে থাকে। উলামাদের তরফ থেকে কোন। বাধা না পেলে বিদআত অবলীলাক্রমে বিস্তার লাভ করতে থাকে। বরং এই নীরবতা অনুমতি ও সমর্থনের লক্ষণ হয় এবং সমাজে তা সুন্নাহ বলে সুপরিচিত হতে থাকে। বর্তমানে মুসলিম জাহানের প্রতি দৃষ্টি ফিরালে দেখা যাবে যে, কত স্বনামধন্য উলামার কর্ণ ও চক্ষুর সামনে ছোট-বড় কত বিদআত ঘটছে ও বেড়ে চলেছে। অথচ তার প্রতিবাদ ও প্রতিকারে স্বল্প কয়েকজন ব্যতীত কেউ মুখ খুলেন না বা কলম ধরেন না।

বরং গদি ও পজিশন যাবার আশঙ্কায় অথবা কোন কূটনীতির খাতিরে অনেকে তাতে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। যাতে সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণা জন্মে যে, ‘তা বিদআত নয় বরং সুন্নাহ। তা না হলে অমুক সাহেব করবেন। কেন?” আবার কেউ যদি বাধা দিতে চান তাহলে তিনি শুনবেন, তুমি আর কতটুকু জানো? বিদআত হলে অমুক (জাদরেল) সাহেব বলে যেতেন না, বলতেন না বা করতেন না। তারা কি আলেম ছিলেন না? ওঁরা কি আলেম নন, ওঁরা কি কুরআন হাদীস জানেন না বা বুঝেন না? যত নতুন আলেম তত নতুন নতুন ফতোয়া নতুন নতুন হাদীস ইত্যাদি।

কিন্তু এ মিসকীনরা জানে না যে, সব বিষয় সবারই পক্ষে জানা বা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যেমন, সুন্নাহর সহীহ-যয়ীফ-মওযু’র পার্থক্যজ্ঞান সকলের কাছে থাকে না। আবার সমস্যা আরো অধিক ঘোরতর হয় তখনই যখন প্রতিবাদ শুনে পূর্বোক্ত সাহেব মানহানির ভয়ে হক কবুল করতে না চান। পক্ষান্তরে যারা হক বলতে চুপ থাকে তারা বোবা শয়তান। (অবশ্য যেখানে ফিতনার ভয় থাকে সেখানকার কথা ভিন্ন।)

বলা বাহুল্য, অন্যায়ের প্রতিবাদে আলস্য সাজে না। ভয়, দুর্বলতা বা তোষামদ মানায় না। দুর্বল ঈমানের পরিচয় দিয়ে কেবলমাত্র অন্তর দ্বারা ঘৃণাই যথেষ্ট নয়। আল্লাহর দ্বীন, আল্লাহই সকলের উচিত বিচার করবেন বলে গড়িমসি চলে না, অথবা এ কাজের জন্য আমি ছাড়া আরো অনেক লোক আছে বলে কর্তব্যহীনতা প্রকাশ শোভা পায় না। আলেম হয়ে (সামর্থ্যানুযায়ী) আলেমের ভূমিকা ও কর্তব্য পালন না করলে তিনি বড় যালেম হবেন নিজের জন্য এবং সমাজের জন্যও।

অনেকে বলেন, ‘সুন্নাহ প্রচার করতে গিয়ে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য সৃষ্টি হয়, ফলে সুন্নাহর প্রচার ফিতনার কারণ হয়; তাই চুপ থাকাই ভালো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুন্নাহর প্রচার ফিতনার কারণ হয় না। বরং সুন্নাহর প্রতি। অজ্ঞতাই ফিতনার মূল কারণ। যেমন সহীহ সুন্নাহ প্রচার করলে যে বলে, 'এটা নতুন হাদীস’ সে এই কথা দ্বারা এই দাবী করে যে, সে যাবতীয় হাদীস শুনে ফেলেছে এবং দ্বীনের সমস্ত আহকাম জেনে ফেলেছে, তাই এই সুন্নাহ তাকে নতুন লেগেছে।

অথচ বাস্তবপক্ষে সুন্নাহ নতুন হয় না। সুন্নাহ তো সেই চৌদ্দ শতাব্দীর পুরাতন। অবশ্য সুন্নাহর প্রচার নতুন হতে পারে। কিন্তু ঐ মিসকীন ‘নতুন’ বলে না জেনে তা রদ করতে চায়। অথচ তার উচিত কেবল মান্য করা এবং নিজের অজ্ঞতার উপর। আক্ষেপ করা। মোট কথা, বিদআত ও কুসংস্কারাদি দেখে আলেমের নির্বাক থাকা মোটেই উচিত নয়। হিকমত ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে নিজের ইলম প্রয়োগ করা উচিত। যে জ্ঞান আল্লাহ তাকে দান করেছেন তা গোপন করা আদৌ বৈধ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে আমি কিতাবে ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে অভিশাপ করে। (সূরা বাকারা ১৫৯ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۖ فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ

অর্থাৎ, (স্মরণ কর) যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল আল্লাহ তাদের নিকট প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, তোমরা উহা স্পষ্টভাবে মানুষের নিকট প্রকাশ করবে এবং উহা গোপন করবে না। এরপরও তারা উহা পৃষ্ঠপিছে নিক্ষেপ করে (অগ্রাহ্য করে) ও স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করে। সুতরাং তারা যা ক্রয় করে তা কত নিকৃষ্ট! (সূরা আলে ইমরান ১৮৭ আয়াত)।

প্রিয় রসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি জানা কোন ইলম (দ্বীনী জ্ঞান) সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তা গোপন করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন। (সহীহহুল জামে’ ৬৫১৭নং)