দ্বীন বিষয়ে যথার্থ পড়াশুনা না করা বা না জানা, ধর্মের আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা, সঠিক আরবী ভাষাজ্ঞান না থাকা প্রভৃতি। এসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকলে অবশ্যই মানুষ বিদআত ও ভ্রষ্টতায় পড়তে বাধ্য। যেমন পথ না চিনলে অবশ্যই মানুষ ভ্রান্ত পথে বিপথগামী হতে বাধ্য হয়।
শরীয়ত মুসলিমকে জ্ঞান শিক্ষার উপর ফরযরূপে উদ্বুদ্ধ করে। অজান্তে কোন কথা আন্দাজে বলতে সাবধান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
অর্থাৎ, বল, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ (হারাম) করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপাচারকে ও অসঙ্গত বিরোধিতাকে এবং কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক করাকে - যার কোন দলীল তিনি অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপর এমন। কিছু বলাকে যে সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই। (সূরা আরাফ ৩৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا
অর্থাৎ, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সুরা ইসরা ৩৬ আয়াত)
আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, “আল্লাহ বান্দাদের নিকট থেকে ইলম ছিনিয়ে নেওয়ার মত তুলে নেবেন না। বরং উলামা তুলে নিয়ে ইলম তুলে নেবেন। এমতাবস্থায় যখন কোন আলেম অবশিষ্ট রাখবেন না, তখন মানুষ মুখদেরকে গুরু (ও নে) রূপে বরণ করবে। ফলে তারা জিজ্ঞাসিত হলে বিনা ইমে ফতোয়া দেবে, যাতে তারা নিজে ভ্রষ্ট হবে এবং অপরকে ভ্রষ্ট করবে। (বুখারী ও মুসলিম ২৬৭৩ নং)
তিনি আরো বলেন, “আমার পূর্বে কোন উম্মতের মাঝে আল্লাহ যে কোনই নবী পাঠিয়েছেন তাঁর জন্যই তার মধ্য হতে সাহায্যকারী ও সহচরবর্গ ছিল; যারা তাঁর আদর্শের অনুসারী ছিল। অতঃপর তাদের পর এমন উত্তরসুরিদের জন্ম হয় যারা যা কাজে করে না তা মুখে বলে এবং যা করতে তারা আদিষ্ট নয় তাই করে। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন লোকদের বিরুদ্ধে নিজ হস্ত দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ জিহ্বা দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ অন্তর দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন। আর এর পশ্চাতে এক সরিষা দানা পরিমাণও ঈমান নেই।” (মুসলিম)
সুতরাং জ্ঞান এমন আলোকবর্তিকা যার দ্বারা মুসলিম আখেরাতের পথ সুস্পষ্টরূপে দেখতে পায় এবং কর্তব্যাকর্তব্য ঐ আলোকে প্রকটিত হয়। ফলে সে নিজে ভ্রষ্ট ও ধ্বংস হয় না এবং অপরকেও ভ্রষ্ট ও ধ্বংস করে না। পক্ষান্তরে জাহেল এক অন্ধ। যে নিজে পথের দিশা পায় না, সুতরাং অপরকে তো পথের সন্ধান বলতেই পারে না। (কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর) এমন অন্ধ নিজে বিদআতী হয় এবং ভুল ফতোয়া দিয়ে, জাল ও যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে আহকাম রচনা করে ও তা প্রচার করে অপরকেও বিদআতী বানায়।
অনেকে কিসা-কাহিনী এবং স্বপ্নবৃত্তান্ত দ্বারা আমল করে এবং তাই দিয়ে দাওয়াতের কাজ করে। এরা এমন কাঠুরে যারা রাতের অন্ধকারে কাঠ কুড়ায় এবং সাপও কুড়ায়। ফলে নিজেদের ধ্বংস ডাকে এবং যারা তাদের কাঠ ক্রয় করে তাদেরও সর্বনাশ আনে। প্রয়োজন সত্ত্বেও আলো জরুরী মনে করে না। বরং ইলম ও উলামার নামে নাক সিটকায়। যেহেতু উলামারা ওদের মত কাঠুরে নন তাই। হযরত জাবের এts বলেন, একদা আমরা সফরে বের হলাম। আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তির মাথায় পাথরের আঘাত লেগে ক্ষত ছিল। পরে তার স্বপ্নদোষ হল। লোকটি (পবিত্রতা সম্পর্কে) তার সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করল, আমার জন্য তায়াম্মুমের অনুমতি আছে কি? তারা বলল, 'না, তোমার জন্য সে অনুমতি নেই। কারণ তুমি পানি ব্যবহার করতে সক্ষম। (এই ফতোয়া শুনে) লোকটি গোসল করল। (এবং ক্ষতস্থানে পানি পৌছে ক্ষত বর্ধিত হলে) তাতে সে মারা গেল।
অতঃপর যখন। আমরা নবী -এর নিকট ফিরে এলাম তখন ঐ লোকটির কথা জানালাম। তখন। ঘটনা শুনে তিনি বললেন, “ওরা ওকে হত্যা করেছে, আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করেন, কেন তারা জিজ্ঞাসা করেনি। যদি তারা জানত না? মুখতা রোগের নিরাময় তো প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাই। ওর জন্য তো তায়াম্মুমই যথেষ্ট ছিল।” (আবু দাউদ, ইবন মাজাহ মুঃ আহমাদ ১/৩৩০) এতো ইহকালের ধ্বংসের কথা। কিন্তু ঐ গদ্দিনশীন জাহেল মুশরিকরা তো মানুষের পরকাল মন্দ করে এবং চিরস্থায়ী সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেয়। কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানকে কিতাবী জ্ঞান বা জাহেরী ইলম বলে অপদার্থ জ্ঞান করে এবং ওদের কল্পিত বাতেনী বা গুপ্ত কলবী জ্ঞানকেই প্রকৃত জ্ঞান বলে গুপ্তভাবেই কেবল নিজেদের ভক্তদের মাঝে প্রচার করে। ফলে ঐ জ্ঞানের কৃষ্ণতমসে নিজেদেরকে ও তার সাথে মুরীদদেরকেও সর্বনাশগ্রস্ত করে। পথের দিশা দিতে গিয়ে হতের দিশা দান করে থাকে।
পক্ষান্তরে অনেকে মনে করে যে, আমলটাই আসল। কোন আলেমের নিকট অযথা সময় নষ্ট করে ইলম শিক্ষায় কোন লাভ নেই। কিন্তু তারা জানে না যে, ইলম শিক্ষা। করাও এক বড় আমল। বরং বিনা ইমে আমল সম্ভবই নয়। যাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই অধিক হয়ে থাকে। ইন্ম মুমিনের অস্ত্র ও ঈমানের জ্যোতি, তার চিরশত্রু শয়তান তাকে এই অস্ত্র হতে দুর এবং এই জ্যোতিকে নির্বাপিত করতে সফল হলে তাকে ধ্বংস ও ভ্রষ্ট করা খুবই সহজ হয়। অন্ধকারে পথ ভুল হয়। বিদআত বেড়ে চলে।
‘আমপারা পড়ে হামবড়া করে আর দু’পাতা উর্দু পড়ে ওস্তাজী সেজে অথবা ইমামরূপে প্রত্যেক মহল্লায় ‘খাস-খাস’ ফতোয় চলে। কেউ বা মকসুদুল মুমেনীন’ অথবা ‘বেহেস্তী যেওর’কে বুখারী-মুসলিমের দর্জা দিয়ে চোখ বুজে আমল করে। কেউ বা নিম-মৌলভী অথবা শুন-মৌলভীর কথায় ঈমানদার ও পরহেযগার সাজে। সে ক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাহর প্রকৃত জ্ঞানী আলেম ও মুফতিদের কোন প্রয়োজনই বোধ হয় না। ফলে ঐ সমাজের অবস্থা এই যে, কিতাব ও সুন্নাহর কোন আলেম সঠিক পথ দেখাবার চেষ্টা করলে গদ্দিনশীনরা নিজেদের গদি যাবার ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দিয়ে নিজ ভক্তদের কানে তালা ঝুলিয়ে দেয় অথবা ‘নতুন হাদীস’ বলে নাক সিটকে দেয় ফলে সংস্কার ও সংশোধন কঠিন হয়ে পড়ে, বিদআতের অন্ধকার আরো ঘনীভূত হতে থাকে।