বিদআতের আভিধানিক অর্থ, বিনা নমুনা বা উদাহরণে কিছু রচনা বা উদ্ভাবন করা বা আবিষ্কার করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “(আল্লাহ) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আবিষ্কর্তা।” অর্থাৎ বিনা নমুনায় সৃষ্টিকর্তা। (সূরা বাকারাহ ১১৭ আয়াত) বলা হয় বিদআত করেছে; অর্থাৎ, এমন পথ বা প্রথা রচনা করেছে, পুর্বে যার কোন উদাহরণ ছিল না। যেমন, যে ঘটনা বা কান্ড পুর্বে কখনো ঘটেনি তাকে বলা হয় অভূতপূর্ব ঘটনা।
এই সকল অর্থের প্রতি খেয়াল করে বিদআতকে বিদআত বলা হয়েছে সুতরাং এমন ধর্মীয় বিশ্বাস, কথা বা কাজ যার কোন দলীল শরীয়তে নেই। এই বিদআতীর পূর্বে আল্লাহর রসূল অথবা তার কোন সাহাবী বলেননি বা করেননি, যার কোন ইঙ্গিত দ্বীনে বা কুরআনে অথবা সহীহ সুন্নাহতে নেই, নতুনভাবে তাই বিশ্বাস করা, বলা বা করাকে - যা আসল শরীয়তের সমতুল্য মনে করা হয় এবং অতিরঞ্জন করে তা পালনীয় ধর্মীয় রীতি স্বরূপ করার উদ্দেশ্যে হয় - তাকে বিদআত বলে।
অন্য কথায়, প্রত্যেক সেই আমল (ইবাদত মনে করে বা আল্লাহর সন্তুষ্টি আছে মনে বা শরীয়ত ভেবে বা করতে হয় অথবা নেই ভেবে, নেকী বা গোনাহ হয় মনে করে) করা বা ত্যাগ করা, যার নির্দেশ বা ইঙ্গিত দ্বীনে নেই তাকে বিদআত বলে। (হুজাজ প্লাবিয়্যাহ) অতএব যে আমলের মূল দ্বীন বা শরীয়তে আছে এবং কিছুকাল পরে যদি তার নতুনভাবে সংস্কার সাধন করা হয়, তাহলে তাকে আভিধানিক অর্থে বিদআত বলা গেলেও শরয়ী অর্থে তা বিদআত’ নয়। যেমন কিছু সলফের উক্তি “নি’মাতিল বিদআহ” (উত্তম আবিষ্কার বা বিদআহ) শরয়ী অর্থে বিদআত নয়। হযরত উমার (রাঃ) যখন সমস্ত লোকদেরকে রমযানের তারাবীহ পড়ার জন্য একই ইমামের পিছনে জমায়েত হয়ে নামায পড়তে দেখলেন, তখন তিনি বললেন, ‘নি’মাতিল বিদআতু হা-যিহ। (অর্থাৎ, উত্তম আবিষ্কার এটা!) এটা আভিধানিক অর্থে বিদআহ।
কারণ, রমযানে জামাআত করে তারাবীহর নামায পড়ার মূল ভিত্তি। শরীয়তে ছিল। রসুল প্লঃ নিজে সাহাবাবৃন্দকে নিয়ে জামাআত করে দুই-তিন রাত্রি তারাবীহর নামায পড়েছিলেন। তারপর ঐ নামায উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাবে এবং তা আদায় করতে তারা অক্ষম হবে -এই আশঙ্কায় আর কোন দিন জামাআত করে পড়েননি। সুতরাং তা শরয়ী অর্থে বিদআত নয়। পক্ষান্তরে হযরত উমরের বা অন্যান্য খলীফা ও সাহাবার কর্মও সুন্নাহ।। সতর্কতার বিষয় এই যে, হযরত উমার (রাঃ) বা খুলাফায়ে রাশেদীন-দের কোন কাজের দোহাই দিয়ে বিদআত করা বা নবী -এর পরে তাঁদের কোন কর্মকে তাঁদের পরবর্তী যুগে কোন নতুন ধর্মীয় কাজ বা প্রথা রচনা করার উপর দলীল মনে করা যাবে না।
তাই এ কথা কারো মনে করা উচিত নয় যে, হযরত উসমান (রাঃ), সমস্ত কুরআনী আয়াতকে জমা করে মুসহাফ বা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন যা এক নতুন কাজ ছিল, তাই আমাদেরও ঐ ধরনের কোন অন্য কাজ করা চলবে, অথবা তাঁদের ঐ ধরনের কর্মগুলি বিদআত ছিল। কারণ, আল্লাহর রসুল (সা.)-এর উক্তিতে প্রমাণিত যে, তাঁদের যে কোনও কাজ সুন্নাহ, বিদআত নয়; যদি তা তাঁর নির্দেশের পরিপন্থী না হয় তবে। অতএব তাঁদের নির্দেশিত বা কৃতকর্মের আমরা অনুসরণ করতে পারি; কিন্তু তাতে কোন অতিরিক্ত অথবা তাঁদের রচনার অনুকরণে কোন অন্য নতুন কর্ম রচনা করতে পারি না। আবার কোন দেশাচার, লৌকিক বা কোন বৈষয়িক কাজ (ধর্ম না ভেবে করাকে) আভিধানিক অর্থে বিদআত বলা গেলেও
শরীয়তের পারিভাষিক অর্থে তা বিদআত’ নয় এবং রসুল (সা.)-এর উদ্দেশ্য ঐ ধরনের কর্মের উপর সতর্ক করাও নয়। অবশ্য ঐ সমস্ত প্রথা বা কর্ম শরীয়ত পরিপন্থী হলে সে কথা ভিন্ন।
তদনুরূপ কোন বৈষয়িক বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও শরয়ী অর্থে বিদআত নয়। তা সাধারণ কর্মে অথবা দ্বীন ও ইবাদতের অসীলাহ ও মাধ্যমস্বরূপ ব্যবহার করাও বিদআতের পর্যায়ে পড়ে না। যেমন আযান, নামায বা খুতবার জন্যে লাউড-স্পীকার, বিদ্যুৎ বাতি, শিক্ষার অভিনব ব্যবস্থা ইত্যাদিকে বিদআত বলতে পারি না।
পক্ষান্তরে যদি কোন কাজ ইবাদত বা নৈকট্যদানকারী না ভেবে করা হয়, তবে তার তিন অবস্থা হতে পারে;
(১) সে কাজের কোন স্পষ্ট নির্দেশ শরীয়তে থাকলেও তা ব্যাপক অর্থ ও মৌলিক নীতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অস্পষ্ট বা পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকলে তা বিদআত বলে গণ্য হবে না। বরং তা ঐ মূল অর্থ অনুযায়ী ঐ নির্দেশ ওয়াজেব হলে ঐ কর্ম ওয়াজেব; নচেৎ মুস্তাহাব অথবা হারাম হবে।
(২) সে কাজের প্রতি অস্পষ্টও কোন ইঙ্গিত শরীয়তে পাওয়া যাবে না এবং তা মৌলিক নীতি বা ব্যাপক দলীলের আওতাভুক্ত নয়। বরং সে বিষয়ে শরীয়ত নীরব। তাহলে তা মুবাহ। অর্থাৎ, তাতে পাপ-পুণ্য কিছুই নেই।
(৩) সে কাজ ব্যাপক কোন দলীলের বা মৌলিক নীতির অন্তর্ভুক্ত নয় এবং এ বিষয়ে শরীয়ত নীরব। কিন্তু তা ইবাদত বা আমলের কেবল অসীলাহ ও মাধ্যম মাত্র। তাহলে তা যে কাজের অসীলা তার হিসাবে অসীলারও গুরুত্ব হবে। যেমন তবলীগ বা ইসলাম প্রচারের জন্য রেডিও, টিভি, টেপরেকর্ডার, আযান, জলসা বা দর্সের জন্য মাইক ইত্যাদি আমলের সহায়ক যন্ত্রাদি ব্যবহার করা বিদআতের পর্যায়ে পড়ে না। (ফারাইদুল ফাওয়াইদ, ইবনে উষাইমীন ১৪৪-১৪৫ পৃঃ)