জাহান্নামে নানা ধরনের আযাব হবে। কতক প্রকার আযাবের কথা কুরআন-হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে, তার কিছু নিম্নরূপঃ

নবী (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তির দুনিয়াতে কোন (প্রাণীর) চিত্র বানিয়েছে। তাকে কিয়ামতের দিনে তাতে রূহ ফুকার জন্য বাধ্য করা হবে আর সে রূহ ফুকতে পারবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)।

নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করে, যা সে দেখেনি---সে ব্যক্তিকে (কিয়ামতের দিন) দু’টি যবের মাঝে জোড়া লাগাতে বাধ্য করা হবে। অথচ সে কখনই তা পারবে না। (যার ফলে তাকে আযাব ভোগ করতে হবে।)।

যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কথা কান পেতে শুনবে অথচ তারা তা অপছন্দ করে সে ব্যক্তির উভয় কানে কিয়ামতের দিন গলিত সীসা ঢালা হবে।

আর যে ব্যক্তি কোন ছবি (বা মূর্তি) তৈরী করবে (কিয়ামতে) তাকে আযাব দেওয়া হবে অথবা ঐ ছবি (বা মূর্তি)তে রূহ ফুকতে বাধ্য করা হবে অথচ সে তাতে কখনই সক্ষম হবে না।” (বুখারী ৭০৪২নং)।

রসূল (ﷺ) বলেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুনের এক মূর্তি বের হবে, যার থাকবে দুটি চোখ; যার দ্বারা সে দর্শন করবে, দু’টি কান; যার দ্বারা সে শ্রবণ করবে এবং যার জিভও থাকবে; যার দ্বারা সে কথাও বলবে। সেদিন সে বলবে, ‘তিন প্রকার লোককে শায়েস্তা করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে: প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী, প্রত্যেক সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকেও আহ্বান (শিরক) করেছে এবং যারা ছবি বা মূর্তি প্রস্তুত করেছে।” (আহমাদ, তিরমিযী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৫১২নং)।

যারা যাকাত দেয় না তাদের শাস্তি সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (34) يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ (35)

অর্থাৎ, যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে ঐগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশ দাগা হবে, (আর বলা হবে,) এ হচ্ছে তাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চিত জিনিসের স্বাদ গ্রহণ কর।” (তাওবাহঃ ৩৪-৩৫)

নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ধন-মাল দান করেছেন; কিন্তু সে ব্যক্তি তার সেই ধন-মালের যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন (আযাবের) জন্য তার সমস্ত ধন-মালকে একটি মাথায় টাক পড়া (অতি বিষাক্ত) সাপের আকৃতি দান করা হবে; যার চোখের উপর দু’টি কালো দাগ থাকবে। সেই সাপকে বেড়ির মত তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সে তার উভয় কশে ধারণ (দংশন) করে বলবে, 'আমি তোমার মাল, আমি তোমার সেই সঞ্চিত ধনভান্ডার। এরপর নবী (ﷺ) এই আয়াত পাঠ করলেন,

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

অর্থাৎ, আল্লাহর দানকৃত অনুগ্রহে (ধন-মালে) যারা কৃপণতা করে, সে কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পণ্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে বেড়ি বানিয়ে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় পরানো হবে। (আলে ইমরানঃ ১৮০, বুখারী ১৪০৩নং, নাসাঈ)

রসূল (ﷺ) বলেন, “কোন (গরীব) নিকটাত্মীয় যখন তার (ধনী) নিকটাত্মীয়র নিকট এসে আল্লাহর দানকৃত অনুগ্রহ তার কাছে প্রার্থনা করে তখন সে (ধনী) ব্যক্তি তা দিতে কার্পণ্য করলে (পরকালে) আল্লাহ তার জন্য দোযখ থেকে একটি শুজা’ নামক সাপ বের করবেন; যে সাপ তার জিব বের করে মুখ হিলাতে থাকবে। এই সাপকে বেড়িস্বরূপ তার গলায় পরানো হবে।” (ত্বাবারানীর আউসাত্ব ও কাবীর, সহীহ তারগীব ৮৮৩নং)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন যে, “একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম; এমন সময় (স্বপ্নে) আমার নিকট দুই ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমার উভয় বাহুর উর্ধাংশে ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ের নিকট উপস্থিত করলেন এবং বললেন, আপনি এই পাহাড়ে চড়ুন। আমি বললাম, 'এ পাহাড়ে চড়তে আমি অক্ষম। তাঁরা বললেন, আমরা আপনার জন্য চড়া সহজ করে দেব। সুতরাং আমি চড়ে গেলাম। অবশেষে যখন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌছলাম তখন বেশ কিছু চিৎকার-ধ্বনি শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এ চিৎকার-ধনি কাদের? তারা বললেন, এ হল জাহান্নামবাসীদের চীৎকার-ধনি। পুনরায় তারা আমাকে নিয়ে চলতে লাগলেন। হঠাৎ দেখলাম একদল লোক তাদের পায়ের গোড়ালির উপর মোটা শিরায় (বাঁধা অবস্থায়) লটকানো আছে, তাদের কশগুলো কেটে ও ছিড়ে আছে এবং কশবেয়ে রক্তও ঝরছে। নবী (ﷺ) বলেন, আমি বললাম, ওরা কারা? তারা বললেন, 'ওরা হল তারা; যারা সময় হওয়ার পূর্বে পূর্বেই ইফতার করে নিত---।” (ইবনে খুযাইমাহ, ইবনে হিব্বান, হাকেম, সহীহ তারগীব ৯৯১নং)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন যে, “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাতে তার নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাবে এবং সে তার চারিপাশে সেইরূপ ঘুরতে থাকবে, যেমন গাধা তার চাকির (ঘানির) চারিপাশে ঘুরতে থাকে। এ দেখে দোযখবাসীরা তার আশে-পাশে সমবেত হয়ে বলবে, 'ওহে অমুক! কি ব্যাপার তোমার? তুমি কি আমাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দিতে না? সে বলবে, (হ্যাঁ!) আমি তোমাদেরকে সৎকাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু আমি নিজে তা করতাম না, আর মন্দ কাজে বাধা দিতাম; কিন্তু আমি তা নিজে করতাম” (বুখারী ৩২৬৭, মুসলিম ২৯৮৯নং)

নবী (ﷺ) বলেন, “আমি মিরাজের রাতে এমন একদল লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছি যারা আগুনের কাঁইচি দ্বারা নিজেদের ঠোট কাটছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে জিবরীল! ওরা কারা? তিনি বললেন, 'ওরা আপনার উম্মতের বক্তাদল; যারা নিজেরা যা করত না তা (অপরকে করতে) বলে বেড়াত।” (আহমদ ৩/১২০ প্রভূতি, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ১২০নং)

নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি মাদকদ্রব্য সেবন করবে তার জন্য আল্লাহরপ্রতিশ্রুতি আছে যে, তাকে তিনি জাহান্নামীদের ঘাম অথবা পুঁজ পান করাবেন।” (মুসলিম ২০০২নং, নাসাঈ)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, মিরাজের রাত্রে যখন আমাকে আকাশ ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হল, তখন এমন একদল লোকের পাশ বেয়ে আমি অতিক্রম করলাম যাদের ছিল তামার নখ; যার দ্বারা তারা তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষস্থল চিরে ফেলছিল। আমি বললাম, 'ওরা কারা হে জিবরীল?!’ জিবরীল (আঃ) বললেন, ‘ওরা হল সেই লোক; যারা লোকেদের মাংস খায় (গীবত করে) এবং তাদের ইজ্জত লুটে বেড়ায়।” (আহমদ ৩/২২৪, সহীহ আবু দাউদ ৪০৮২ নং)

সামুরাহ ইবনে জুনদুব (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) প্রায়ই তাঁর সাহাবীদেরকে বলতেন, “তোমাদের কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছে কি?” রাবী বলেন, যার ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা সে তার কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করত। তিনি একদিন সকালে বললেন, “গতরাত্রে আমার কাছে দুজন আগন্তুক এল। তারা আমাকে উঠাল, আর বলল, চলুন। আমি তাদের সাথে চলতে লাগলাম। অতঃপর আমরা কাত হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির নিকট পৌছলাম। দেখলাম, অপর এক ব্যক্তি তার নিকট পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলছে। আর পাথর গড়িয়ে সরে পড়ছে। তারপর আবার সে পাথরটির অনুসরণ করে তা পুনরায় নিয়ে আসছে। ফিরে আসতে না আসতেই লোকটির মাথা আগের মত পুনরায় ভাল হয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসে আবার একই আচরণ করছে; যা প্রথমবার করেছিল। তিনি বলেন, আমি সাথীদ্বয়কে বললাম, 'সুবহানাল্লাহ! এটা কী? তারা আমাকে বলল, 'চলুন, চলুন।

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম, তারপর চিৎ হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। এখানেও দেখলাম, তার নিকট এক ব্যক্তি লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে তার চেহারার একদিকে এসে এর দ্বারা তার কশ থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং একইভাবে নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে চোখ থেকে মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। তারপর ঐ লোকটি শোয়া ব্যক্তির অপরদিকে যাচ্ছে এবং প্রথম দিকের সাথে যেরূপ আচরণ করেছে অনুরূপ আচরণই অপর দিকের সাথেও করছে। ঐ দিক হতে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মত ভাল হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার প্রথম বারের মত আচরণ করছে। তিনি বলেন, আমি বললাম, 'সুবহানাল্লাহ! এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং (তন্দুর) চুলার মত একটি গর্তের কাছে পৌছলাম। (বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয়, যেন তিনি বললেন,) আর সেখানে শোরগোল ও নানা শব্দ ছিল। আমরা তাতে উকি মেরে দেখলাম, তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী-পরুষ রয়েছে। আর নীচ থেকে নির্গত আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছে, তখনই তারা উচ্চরবে চিৎকার করে উঠছে। আমি বললাম, 'এরা কারা? তারা আমাকে বলল, 'চলুন, চলুন।

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটি নদীর কাছে গিয়ে পৌছলাম। (বর্ণনাকারী বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি বললেন,) নদীটি ছিল রক্তের মত লাল। আর দেখলাম, সেই নদীতে এক ব্যক্তি সঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অপর এক ব্যক্তি রয়েছে এবং সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্রিত করে রেখেছে। আর ঐ সাঁতার-রত ব্যক্তি বেশ কিছুক্ষণ সঁতার কাটার পর সেই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসছে, যে তার নিকট পাথর একত্রিত করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার সামনে মুখ খুলে দিচ্ছে এবং ঐ ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে চলে গিয়ে। আবার সঁতার কাটছে এবং আবার তার কাছে ফিরে আসছে। আর যখনই ফিরে আসছে তখনই ঐ ব্যক্তি তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এরা কারা? তারা বলল, 'চলন, চলুন।

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং এমন একজন কুৎসিত ব্যক্তির কাছে এসে পৌছলাম, যা তোমার দৃষ্টিতে সর্বাধিক কুৎসিত বলে মনে হয়। আর দেখলাম, তার নিকট রয়েছে আগুন, যা সে জ্বালাচ্ছে ও তার চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোকটি কে? তারা বলল, চলুন, চলুন।

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটা সবুজ-শ্যামল বাগানে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে বসন্তের সব রকমের ফুল রয়েছে আর বাগানের মাঝে এত বেশী দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে, আকাশে যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। আবার দেখলাম, তার চারদিকে এত বেশী পরিমাণ বালক-বালিকা রয়েছে, যত বেশী পরিমাণ আর কখনোও আমি দেখিনি। আমি তাদেরকে বললাম, উনি কে? এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটা বিশাল (বাগান বা) গাছের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। এমন বড় এবং সুন্দর (বাগান বা) গাছ আমি আর কখনো দেখিনি। তারা আমাকে বলল, 'এর উপরে চড়ন। আমরা উপরে চড়লাম। শেষ পর্যন্ত সোনা-রূপার ইটের তৈরী একটি শহরে গিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম। আমরা শহরের দরজায় পৌছলাম এবং দরজা খুলতে বললাম। আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হল। আমরা তাতে প্রবেশ করলাম। তখন সেখানে কতক লোক আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করল, যাদের অর্ধেক শরীর এত সুন্দর ছিল, যত সুন্দর তুমি দেখেছ, তার থেকেও অধিক। আর অর্ধেক শরীর এত কুৎসিত ছিল যত কুৎসিত তুমি দেখেছ, তার থেকেও অধিক। সাথীদ্বয় ওদেরকে বলল, 'যাও ঐ নদীতে গিয়ে নেমে পড়। আর সেটা ছিল সুপ্রশস্ত প্রবহমান নদী। তার পানি যেন ধপধপে সাদা। ওরা তাতে গিয়ে নেমে পড়ল। অতঃপর ওরা আমাদের কাছে ফিরে এল। দেখা গেল, তাদের ঐ কুশ্রী রূপ দূর হয়ে গেছে এবং তারা খুবই সুন্দর আকৃতির হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, 'এটা জান্নাতে আদন এবং ওটা আপনার বাসস্থান। (তিনি বলেন,) উপরের দিকে আমার দৃষ্টি গেলে, দেখলাম ধপধপে সাদা মেঘের মত একটি প্রাসাদ রয়েছে। তারা আমাকে বলল, ঐটা আপনার বাসগৃহ৷’ (তিনি বললেন, আমি তাদেরকে বললাম, 'আল্লাহ তোমাদের মাঝে বরকত দিন, আমাকে ছেড়ে দাও; আমি এতে প্রবেশ করি। তারা বলল, আপনি অবশ্যই এতে প্রবেশ করবেন। তবে এখন নয়।”

আমি বললাম, আমি রাতে অনেক বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে পেলাম, এগুলোর তাৎপর্য কী? তারা আমাকে বলল, 'আচ্ছা আমরা আপনাকে বলে দিচ্ছি। ঐ যে প্রথম ব্যক্তিকে যার কাছে আপনি পৌঁছলেন, যার মাথা পাথর দিয়ে চুর্ণ-বিচুর্ণ করা হচ্ছিল, সে হল ঐ ব্যক্তি যে কুরআন গ্রহণ করে---তা বর্জন করে। আর ফরয নামায ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকে।

আর ঐ ব্যক্তি যার কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তার কশ থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং একইভাবে নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে চোখ থেকে মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল। সে হল ঐ ব্যক্তি যে সকালে আপন ঘর থেকে বের হয়ে এমন মিথ্যা বলে, যা চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ে।

আর যে সকল উলঙ্গ নারী-পুরুষ যারা (তন্দুর) চুলা সদৃশ গর্তের অভ্যন্তরে রয়েছে, তারা হল ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণীর দল।

আর ঐ ব্যক্তি যার কাছে পৌছে দেখলেন যে, সে নদীতে সাঁতার কাটছে ও তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সে হল সুদখোর।

আর ঐ কুৎসিত ব্যক্তি যে আগুনের কাছে ছিল এবং আগুন জ্বালাচ্ছিল। আর তার চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছিল। সে হল মালেক (ফিরিশ্তা); জাহান্নামের দরোগা।

আর ঐ দীর্ঘকায় ব্যক্তি যিনি বাগানে ছিলেন। তিনি হলেন ইব্রাহীম (আঃ) আর তার চারপাশে যে বালক-বালিকারা ছিল, ওরা হল তারা, যারা (ইসলামী) প্রকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।”

বারক্বানীর বর্ণনায় আছে, “ওরা তারা, যারা (ইসলামী) প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে (মৃত্যুবরণ করেছে)।” তখন কিছু সংখ্যক মুসলিম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! মুশরিকদের শিশু-সন্তানরাও কি (সেখানে আছে)? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “মুশরিকদের শিশু-সন্তানরাও (সেখানে আছে)।

আর ঐ সব লোক যাদের অর্ধেকাংশ অতি সুন্দর ও অর্ধেকাংশ অতি কুৎসিত ছিল, তারা হল ঐ সম্প্রদায় যারা সৎ-অসৎ উভয় প্রকারের কাজ মিশ্রিতভাবে করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।” (বুখারী)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, “আজ রাতে আমি দেখলাম, দু’টি লোক এসে আমাকে পবিত্র ভূমির দিকে বের করে নিয়ে গেল।” অতঃপর ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন, “সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং (তন্দুর) চুলার মত একটি গর্তের কাছে পৌছলাম; যার উপর দিকটা সংকীর্ণ ছিল এবং নিচের দিকটা প্রশস্ত। তার নিচে আগুন জ্বলছিল। তার মধ্যে উলঙ্গ বহু নারী-পুরুষ ছিল। আগুন যখন উপর দিকে উঠছিল, তখন তারাও (আগুনের সাথে) উপরে উঠছিল। এমনকি প্রায় তারা (চুলা) থেকে বের হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। আর যখন আগুন স্তিমিত হয়ে নেমে যাচ্ছিল, তখন (তার সাথে) তারাও নিচে ফিরে যাচ্ছিল।”

এই বর্ণনায় আছে, “একটি রক্তের নদীর কাছে এলাম।” বর্ণনাকারী এতে সন্দেহ করেননি। “সেই নদীর মাঝখানে একটি লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর নদীর তীরে একটি লোক রয়েছে, যার সামনে পাথর রয়েছে। অতঃপর নদীর মাঝের লোকটি যখন উঠে আসতে চাচ্ছে, তখন তীরের লোকটি তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে সেই দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, যেখানে সে ছিল। এইভাবে যখনই সে নদী থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে, তখনই ঐ লোকটি তার মুখে পাথর ছুঁড়ে মারছে। ফলে সে যেখানে ছিল, সেখানে ফিরে যাচ্ছে।”

এই বর্ণনায় আরো আছে, “তারা উভয়ে আমাকে নিয়ে ঐ (বাগান বা) গাছে উঠে গেল। অতঃপর সেখানে এমন একটি গৃহে আমাকে প্রবেশ করাল, যার চেয়ে অধিক সুন্দর গৃহ আমি কখনো দেখিনি। সেখানে বহু বৃদ্ধ ও যুবক লোক ছিল।”

এই বর্ণনায় আরো আছে, “আর যাকে আপনি তার নিজ কশ চিরতে দেখলেন, সে হল বড় মিথুক; যে মিথ্যা কথা বলত, অতঃপর তা তার নিকট থেকে বর্ণনা করা হত। ফলে তা দিকচক্রবালে পৌছে যেত। অতএব এই আচরণ তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে।”

এই বর্ণনায় আরো আছে, “যার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে দেখলেন, সে ছিল এমন ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন শিখিয়েছিলেন। কিন্তু সে (তা ভুলে) রাতে ঘুমিয়ে থাকত এবং দিনে তার উপর আমল করত না। অতএব এই আচরণ তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে। আর প্রথম যে গৃহটি আপনি দেখলেন, তা হল সাধারণ মুমিনদের। পক্ষান্তরে এই গৃহটি হল শহীদদের। আমি জিবরীল, আর ইনি মীকাঈল। অতএব আপনি মাথা তুলুন। সুতরাং আমি মাথা তুললাম। তখন দেখলাম, আমার উপর দিকে মেঘের মত কিছু রয়েছে। তারা বললেন, 'ওটি হল আপনার গৃহ৷” আমি বললাম, 'আপনারা আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আমার গৃহে প্রবেশ করি। তারা বললেন, (দুনিয়াতে) আপনার আয়ু অবশিষ্ট আছে; যা আপনি পূর্ণ করেননি। যখন আপনি তা পূর্ণ করবেন, তখন আপনি আপনার গৃহে চলে আসবেন।” (বুখারী)।

উক্ত আযাবগুলি মধ্যজগতের বলে উল্লিখিত হয়েছে। হতে পারে তা জাহান্নামেও হবে।

আযাবের জন্য আছে শিকল। তা দিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখা হবে। (আল-কুরআন ৭৬/৪) যার দৈর্ঘ্য সত্তর হাত। (আল-কুরআন ৬৯/৩২) এবং ওদের গলদেশে বেড়ি পরানো হবে। (আল-কুরআন ৩৪/৩৩) আর ওদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে পদবেড়িও। (আল-কুরআন ৭৩/ ১২)

কোন কোন কাফেরকে হস্তপদ শৃঙ্খলিত অবস্থায় জাহান্নামের কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে। তখন তারা সেখানে নিজেদের ধ্বংস কামনা। করবে। তখন ওদের বলা হবে, আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা করো না, বরং বহুবার ধ্বংস হওয়ার কামনা করতে থাক।” (আল-কুরআন ২৫/ ১৩-১৪)

অধিক ও চিরস্থায়ী শাস্তি আস্বাদন করাবার জন্য যখনই অগ্নিদাহে তাদের চর্ম দগ্ধ হবে, তখনই ওর স্থলে নূতন চর্ম সৃষ্টি করা হবে। (আল-কুরআন ৪/৫৬)।

তেমনি তাদের দেহের স্থূলতা অত্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে। একজন কাফেরের দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী অংশ দ্রুতগামী আরোহীর তিন দিনের পথ-সম দীর্ঘ হবে! একটি দাঁত উহুদ পর্বতসম এবং তার চর্মের স্থূলতা হবে তিনদিনের পথ! (মুসলিম ২৮৫১, ২৮৫২) অথবা বিয়াল্লিশ হাত। আর জাহান্নামে তার অবস্থান ক্ষেত্র হবে মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থান বরাবর। (অর্থাৎ ৪২৫ কিমি.।) (তিরমিযী ২৫৭৭, আহমাদ ২/২৬) এসব বিচিত্র হলেও আল্লাহর কাছে অবাস্তবতার কিছু নেই।

অগ্নির বেষ্টনী জাহান্নামীদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। (আল-কুরআন ১৮/২৯) অগ্নিদগ্ধে ওদের মুখমণ্ডল বীভৎস হয়ে যাবে। (আল-কুরআন ২৩/১০৪)।

জাহান্নামে উটের মত বৃহদাকার এমন সর্প আছে, যদি তা একবার কাউকে দংশন করে, তবে চল্লিশ বছর তার বিষাক্ত যন্ত্রণা বিদ্যমান থাকবে। খচ্চরের মত এমন বড় বড় বিছা আছে যার দংশন জ্বালা চল্লিশ বছর বর্তমান থাকবে। (আহমাদ ৪/ ১৯১)

দোযখে কাফেরদেরকে উল্টা করে মুখের উপর ভর দিয়ে টানা হবে। (আল-কুরআন ৫৪/৪৮)

অনেক শাস্তি হবে অপরাধের অনুরূপ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন পাহাড় হতে নিজেকে ফেলে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে ফেলে অনুরূপ শাস্তিভোগ করবে। যে ব্যক্তি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা চিরকালের জন্য বিষ পান করে যাতনা ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি কোন লৌহখন্ড (ছুরি ইত্যাদি) দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামেও ঐ লৌহখন্ড দ্বারা সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে আঘাত করে যাতনা ভোগ করতে থাকবে।” (বুখারী ৫৭৭৮, মুসলিম ১০৯নং প্রমুখ)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফাঁসি নিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ ফাঁসি নিয়ে আযাব ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা (নিজে নিজে) আযাব ভোগ করবে।” (বুখারী ১৩৬৫নং)

জাহান্নামে অনেকের তার পায়ের গাঁট পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত এবং কারো গলা পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হবে। (মুসলিম ২৮৪৫)