কবরকে গভীর, প্রশস্ত এবং সুন্দর করে খনন করা ওয়াজেব। হিশাম বিন আমের (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা কবর খনন কর, প্রশস্ত কর এবং সুন্দর বানাও।” (আবু দাউদ ৩২১৫, নাসাই ২০০৯, আহমাদ ৪/ ১৯২০প্রমুখ, সহীহ আবু দাউদ ২৭৫৪নং)
যে ব্যক্তি কবর খনন করবে তার জন্য রয়েছে বিরাট পরিমাণ সওয়াব। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “--- আর যে ব্যক্তি (নেক নিয়তে) মাইয়্যেতের জন্য কবর খুঁড়বে এবং তাকে তাতে দাফন করবে আল্লাহ তার জন্য সেই ঘর তৈরী করে দেওয়ার সওয়াব জারী করে দেবেন; যা কিয়ামত পর্যন্ত বাস করতে দেওয়ার জন্য করা হয়।” (হাকেম, বাইহাকী)
বগলী ও সিন্দুকী উভয় প্রকার কবরই বৈধ। কারণ, নবী (ﷺ) এর যুগে উভয় প্রকার কবরই প্রচলিত ছিল। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, মদীনায় কবর খননকারী ২টি লোক ছিল। একজন বগলী এবং অপরজন সিন্দুকী কবর খনন করত। আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর ইন্তিকাল হলে সকলে বলল, আমরা আমাদের প্রভুর নিকট মঙ্গল প্রার্থনা করব এবং দুজনকেই ডেকে পাঠাব। অতঃপর ওদের মধ্যে যে প্রথম উপস্থিত হবে তাকেই কবর খুঁড়তে দেব। তারপর উভয়কে ডেকে পাঠানো হলে বগলী (লহদ) কবর খননকারী আগে এসে উপস্থিত হল। সুতরাং নবী (ﷺ) এর জন্য খনন করা হল বগলী কবর। (ইবনে মাজাহ ১৫৫৭, আহমাদ ৩/৯৯প্রমুখ, সহীহ ইবনে মাজাহ ১২৬৪ নং)
তবে উভয় প্রকার কবরের মধ্যে বগলী কবরই আফযাল। কারণ এই কবরেই মহানবী (ﷺ)-কে দাফন করা হয়েছিল। সা’দ বিন আবী অক্কাস মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, আমার জন্য এক বগলী কবর খনন করো। অতঃপর (আমাকে তাতে রেখে) সাধারণভাবে (কাঁচা) ইট গেঁথে দিও; যেমন নবী (ﷺ)-এর জন্য করা হয়েছিল।
আর আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “বগলী কবর আমাদের এবং সিন্দুকী কবর অন্যান্য (নবীর উম্মত)দের।” (আবু দাউদ ৩২০৮, তিরমিযী ১০৪৫, ইবনে মাজাহ ৪৭১১ নং, প্রমুখ।)
অবশ্য উলামাগণ সুবিধার জন্য বলেন, যে স্থানের মাটি আলগা ও নরম, সে স্থানের সিন্দুকী এবং যে স্থানের মাটি টাইট ও শক্ত; ধসার ভয় থাকে না, সে স্থানে বগলী কবর খনন করা উত্তম। (দেখুন মাজমু, নওবী ৫/২৮৫, আউনুল মা'বুদ ৯১৯ প্রভৃতি)
প্রকাশ যে, বগলী কবরের সাধারণ দৈর্ঘ হবে ২০০ সেমি, গভীরতা ১৩০ সেমি। আর লহদের ৫৫ সেমি এবং প্রস্থ হবে ৫০ সেমি। (আল বিজাযাহ) অবশ্য মাইয়্যেতের দেহ অনুসারে কবরের পরিমাপ ছোট বড় হওয়াই স্বাভাবিক।
কবর খুঁড়তে কোন পুরাতন (মাইয়্যেতের) হাড় বাহির হলে তা যত্নের সাথে পুনরায় দাফন করা জরুরী। হাড় যেন কোন প্রকারে ভেঙ্গে না যায় - তা খেয়াল রাখা আবশ্যিক। কারণ, পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “মৃত মুমিনের হাড় ভাঙ্গা জীবিতের হাড় ভাঙ্গার সমান।” (আবু দাউদ ৩২০৭, ইবনে মাজাহ ১৬ ১৬ নং আহমাদ ৬/৫৮, বাইহাকী ৪/৫৮ প্রমুখ, সহীহ আবু দাউদ ২৭৪৬নং)
আর এই কারণেই একান্ত নিরুপায় ও জরুরী না হলে মৃতের ময়না তদন্ত করা বা করতে দেওয়া অবৈধ। (আহকামুল জানাইয ২৩৬পৃঃ, আবহৃতু কিবরিল উলম ২/৬৯)
তবে মৃতার গর্ভে জীবিত সন্তান থাকলে তা অপারেশন করে বের করা ওয়াজেব। (আহকামুল জানাইয ২৩৪পৃঃ)
মাইয়্যেত অধিক হওয়ার কারণে প্রয়োজনে একই কবরে দুই বা ততোধিক লাশ দাফন করা বৈধ। এদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক দ্বীনদার ও কুরআন পাঠকারী লোককে আগে কবরে (কেবলার দিকে) রাখা হবে। জাবের (রাঃ) বলেন, উহুদের দিন নবী (ﷺ) শহীদদেরকে দাফন করার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, “ওদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কুরআন হিফযকারী কে? অতঃপর কারো একজনের প্রতি ইঙ্গিত করা হলে তাকেই সর্বপ্রথম লহদে রাখা হল। (বুখারী ১৩৪৭, আবু দাউদ ৩১৩৮, তিরমিযী ১০৩৬নং প্রমুখ।
কিন্তু মহিলা ও পুরুষকে একই কবরে দাফন করা বৈধ নয়। অবশ্য একান্ত নিরুপায় অবস্থায় যদি নারী ও পুরুষকে একই কবরে দাফন করতেই হয়, তাহলে আগে পুরুষকে তারপর মহিলাকে রেখে উভয়ের মাঝে ইট, পাথর, বালি অথবা মাটির পর্দা (আড়াল) করে দিতে হবে। (আহকামুল জানাইয ১৪৭পৃঃ টীকা, ইআশাঃ ১১৮৮৯- ১১৮৯৩নং)।
কবরে লাশ নামাবে পুরুষে। পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক হকদার হল মৃত ব্যক্তির অভিভাবক ও আত্মীয় স্বজনরা। কারণ, আল্লাহ তাআলার সাধারণ উক্তিতে এ কথার ইঙ্গিত রয়েছে; তিনি বলেন,
وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ
অর্থাৎ, বস্তুতঃ আত্মীয়গণ আল্লাহর বিধানে পরস্পর (অন্য অপেক্ষা) অধিক হকদার। (সুরা আনফাল ৭৫ আয়াত)
আর আলী (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে গোসল দিলাম। অতঃপর মরণের প্রভাব তার চেহারায় দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। তিনি জীবন ও মরণ উভয় অবস্থাতেই ছিলেন চির সুন্দর।
তার দাফন কার্যের ভার অর্পিত ছিল চার ব্যক্তির উপর; আলী, আব্বাস, ফাযল এবং আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর স্বাধীনকৃত ক্রীতদাস সালেহ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর জন্য লহদ তৈরী করে তাতে তাকে রেখে (কাঁচা) ইট গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। (হাকেম ১/২৬২, বাইহাকী ৪/৫৩)
স্ত্রীর লাশ তার স্বামী নামাতে পারে। তবে শর্ত হল সে যেন গত রাত্রে (অন্য) স্ত্রী সহবাস না করে থাকে। তা করে থাকলে তার জন্য লাশ নামানো বিধেয় নয়। বরং এ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মীয় অথবা কোন বেগানাই লাশ নামাবে। অবশ্য তাদের ক্ষেত্রেও এ শর্ত পালনীয়। কারণ, আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) এর এক কন্যা (উম্মে কুলসুম) এর দাফন কার্যের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম, আল্লাহর রসূল (ﷺ) কবরের পাশে বসে আছেন। আর তার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত ছিল। অতঃপর (লাশ নামানোর সময়) তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে (গত) রাত্রে স্ত্রী সহবাস করেনি?” আবু তালহা বললেন, আমি আছি, হে আল্লাহর রসূল!” তিনি বললেন, “তাহলে তুমি ওর কবরে নামো।” এ শুনে আবু তালহা কবরে নামলেন। (বুখারী ১২৮৫নং, হাকেম ৪/৪৭, বাইহাকী ৪/৫৩, আহমাদ ৩/১২৬ প্রমুখ।)
অবশ্য মহিলার লাশের ক্ষেত্রে যদি তার বেগানা কোন পুরুষ কবরে নামে তাহলে একান্ত সৎ ও বৃদ্ধ লোক হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাহরাম হওয়া শর্ত নয়। কবরের পায়ের দিক হতেই লাশ নামানো সুন্নত। আবু ইসহাক বলেন, হারেস অসিয়ত করেছিলেন যে, তার জানাযার নামায যেন আব্দুল্লাহ বিন যায়দ পড়ে। সুতরাং আব্দুল্লাহ তার জানাযা পড়লেন। অতঃপর কবরের পায়ের দিক হতে তাকে কবরে নামালেন এবং বললেন, এভাবে লাশ নামানো সুন্নাহ (নবী (ﷺ) এর তরীকা)।” (ইবনে আবী শাইবাহ ৪/১৩০, আবু দাউদ ৩২১১, বাইহাকী ৪/৫৪) অনুরূপ ছিল আনাস (রাঃ)-এর আমলও। (আহমাদ ৪০৮ ১নং, ইআশা ৪/ ১৩০) বলা বাহুল্য, লাশের মাথার দিক হতে লাশ নামানোর হাদীস সহীহ নয়। (আকামুল জানাইয, আলবানী ১৫০- ১৫১পৃঃ)
কবরে নেমে যে ব্যক্তি লাশ রাখবে, কেবল সেই ব্যক্তিই ঐ সময় নিম্নের দুআ পাঠ করবেঃ
بسم الله وعلي سنة رسول الله
উচ্চারণ, বিসমিল্লাহি অআলা সুন্নাতি রাসুলিল্লাহ। অথবাঃ
بسم الله وعلي ملة رسول الله
উচ্চারণ, বিসমিল্লা-হি অআলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ।
অর্থাৎ, আল্লাহর নাম নিয়ে এবং তাঁর রসূলের তরীকা বা মিল্লাতের নিয়মানুসারে (লাশ রাখছি)। (আবু দাউদ ৩২ ১৩, ইবনে মাজাহ ১৫৫০, হাকেম ১৩৬৬, বাইহাকী ৪/৫৫, তিরমিযী ১০৪৬নং) হাকেমের এক বর্ণনায় শুরুতে ‘বিসমিল্লাহি অবিল্লা-হি----’ শব্দ এসেছে।
মাইয়্যেতকে তার কবরে (পিঠ ও মাথার নিচে কিছু মাটি বা ঢেলা রেখে) ডান পার্শ্বে শায়িত করবে। তার মুখমণ্ডল হবে কেবলার প্রতি, মাথা হবে কেবলার ডাইনে এবং পা দুটি কেবলার বামে (উত্তর-দক্ষিণে)। (মুহাল্লা ৫/ ১৭৩, আহকামুল জানাইয ১৫১পৃঃ)
প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “কা’বা হল তোমাদের জীবিত ও মৃত সকলের জন্য কেবলাহ।” (আবু দাউদ ২৮৭৫লং, নাসাঈ, হাকেম ১/৫৯ ৪/২ ৫৯, বাইহাকী ৩/৪০৮-৮০৯)
লাশ রাখার পর কাফনের বাঁধনগুলো খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে যদিও কোন সহীহ হাদীস মহানবী (ﷺ) কর্তৃক বর্ণিত হয়নি, তবুও কিছু সংখ্যক আষার দ্বারা বুঝা যায় যে, এমন আমল সলফের যুগে প্রচলিত ছিল। সুতরাং বাঁধন খোলা বিধেয়। (দেখুন ইবনে আবী শাইবাহ ১ ১৬৬৯- ১১৬৭৩নং, সিলসিলাহ যয়ীফাহ ৪/২৫৭, ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪৮১)
পক্ষান্তরে মাইয়্যেতের চেহারা খুলে রাখার কোন ভিত্তি বা দলীল সুন্নাহতে নেই। মাইয়্যেত মুহরিম হলে তার চেহারা ও মাথা খোলা থাকবে। (মহিলা হলে পর্দার আবরণ থাকা জরুরী।)
অনেকে (পুরুষ মাইয়্যেতের) ডান গাল খুলে মাটিতে লাগিয়ে দেওয়া বিধেয় মনে করেন। কারণ, এরূপ করতে উমার (রাঃ) অসিয়ত করেছিলেন। সুতরাং তা সত্য হলেও পূর্ণ চেহারা খুলে রাখার কথা প্রমাণ হয় না। (দেখুন, আশারহুল মুমতে’, ইবনে উষাইমীন ৫/৪৫৬)
এরপর মাথার দিক থেকে কাঁচা ইট পরস্পর থাকিয়ে কাদা লেপে বগলী কবরের ফাঁক বন্ধ করবে।
কবর খননের সময় প্রথম চোটের মাটি লাশের বুকের উপর রাখা বিদআত। তদনুরূপ লাশের জন্য কবরের ভিতর (মাটির) বালিশ করা, অপ্রয়োজনে বালি বিছানো, গোলাপ পানি ছিটানো, ঢেলা বা মাটিতে কোন সূরা বা দুআ পড়ে, কোন আয়াত বা দুআ কাগজে লিখে, কাবা শরীফের গিলাফের টুকরা, কোন বুযুর্গের ব্যবহৃত কাপড় বা অন্য কিছু কবরের ভিতর রাখা বিদআত ও অবৈধ। এ সবে কবরের আযাব লাঘব হবে মনে করাও অমূলক ধারণা। (আহকামুল জানাইয অবিদাউহা দ্রষ্টব্য)
মহিলার লাশ কবরে রাখার সময় পর্দা করা এবং অপ্রয়োজনে লোকেদের কবরের নিকট ভিড় না করা বাঞ্ছনীয়। লাশের উপর যারা ভিড় করে তাদেরকে হাসান (রঃ) শয়তান’ বলে আখ্যায়ন করেছেন। তা ছাড়া এটি বিদআত। (ইআশাঃ ১১৯৯০-১১৯৯১নং, মুহালা ৫/১৭8)
সিন্দুকী কবরে লাশ রাখার পর বাঁশের টোটা বা পাটা ও তার উপর খড় আদি রাখার সময় টোটার নিচে কাপড় রেখে নেওয়া ও পরে গুটিয়ে বের করে নেওয়া উত্তম, যাতে লাশের উপর মাটি বা কুটা না পড়ে। যে স্থানের মাটি একান্ত বালি অথবা কাদাময়, সেখানে গর্ত খুঁড়তেই ধস নামে সেখানে তাবুতের (কাঠের শবাধার) মাঝে লাশ রেখে দাফন করা যায়। যেমন, যেখানে গর্ত খুঁড়তেই (বিশেষ করে বর্ষাকালে ও বন্যার সময়) ঝর্ণা ঝরে সেখানে কবরের নিচে কলাগাছের ভেলার উপর লাশ রেখে দাফন করা দূষণীয় নয়।
সমুদ্রের মাঝে জলজাহাজে কারো মৃত্যু হলে এবং তীরে জাহাজ লাগতে অসাধারণ দেরী হলে এবং ফ্রিজ না থাকলে ও লাশের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে গোসল-কাফন দিয়ে জানাযা পড়ে পিঠের নিচে একটি ভারি কিছু বেঁধে সমুদ্রে সলিল-সমাধি দেওয়াও প্রয়োজনে বৈধ। (ইবনে আবী শাইবাহ ১১৮৪৯-১১৮৫০নং)।
কাঁচা ইট ও টোটা দ্বারা কবর বন্ধ করার পর উপস্থিত সকলের জন্য মুস্তাহাব, দুই হাত দিয়ে মাটি বা কাদার ডাব নিয়ে (সুবিধামত দাঁড়িয়ে অথবা বসে) মাথার দিক হতে ৩ বার কবরে রেখে কবর বন্ধ করা। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) এক জানাযার নামায পড়লেন। অতঃপর তিনবার মাইয়্যেতের (কবরের) উপর মাটি দিলেন।” (ইবনে মাজাহ ১৫৬৫নং, ইরওয়াউল গলীল ৭৪৩নং) মাটি দেওয়ার সময় মুখে পঠনীয় কোন দুআ নেই। মিনহা খালাকনা-কুম-- পাঠ করা বিদআত। (আহকামুল জানাই ১৫৩পৃঃ টাকা)।
কবর তৈরী হয়ে যাওয়ার পর তার উচ্চতা হবে মাত্র আর্ধহাত; যাতে কবর বলে চেনা যায় এবং সম্মানহানির হাত হতে রক্ষা পায়। জাবের (রাঃ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) এর জন্য লহদ (বগলী) কবর তৈরী করা হয়েছিল। অতঃপর (তাকে তাতে রেখে) কাঁচা ইট থাকানো হয়েছিল। আর মাটি থেকে তার কবর উঁচু করা হয়েছিল আধ হাত মত। (ইবনে হিব্বান ২১৬০নং, বাইহাকী ৩/৪১০)
কিন্তু সিন্দুকী (আমাদের দেশের সাধারণতঃ) কবরের উচ্চতা এতটুকুই হলে হিংস্র জন্তুরা তা খুলে লাশের উপর অত্যাচার করতে পারে অথবা লাশ বের করে নিতে পারে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে কবরের চারিপাশের মাটি আধ হাত বা তার বেশী খাপিয়ে নিয়ে তাতে টোটা বা পাটা রাখলে উপরের মাটির ঘনত্ব মোটা হবে এবং খোলার ভয় আর থাকবে না। আর উচ্চতাও হবে আধ হাত।
এরপর মাটি বেড়ে গেলে কোন ক্ষতি নেই। মাটি বাড়লেই আবার হালেই কেউ মরবে এই ধারণা কাল্পনিক ও অলীক।
কবরের আকৃতি হবে উটের কুজের মত। সুফিয়ান তাম্মার বলেন, 'আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) আবু বাকার ও উমার (রাঃ)-এর কবরকে উটের কুঁজের মত দেখেছি।
বগলী কবর তৈরী হওয়ার পর যেহেতু তার মাটি শুষ্ক থাকে, তাই তার উপর পানির ছিটা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া দূষণীয় নয়। তবুও এ প্রসঙ্গে হাদীসগুলি দুর্বল। (ইরওয়াউল গালীল ৭৫৫নং) কিন্তু সিন্দুকী কবরের উপর দেওয়ার মাটি সাধারণতঃ কাদা হয়, তাই কবর প্রস্তুত করতে যে পরিমাণ পানি লাগে তাই দেওয়াই দরকার। কবর প্রস্তুত হওয়ার পর আর ‘কবর লোয়ানো’ বলে কোন কিছু সংস্কার নেই। সুতরাং এই সময় কলেমার যিকরের সাথে কবরের মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত তিনবার পানি ঢালা নিষ্প্রয়োজন ও বিদআত। (আহকামুল জানাইয)
এরপর কবরের শিয়রে পাথর ইত্যাদি রেখে চিহ্ন দেওয়া সুন্নত। মুত্তালিব বিন আবী অদাআহ বলেন, 'উষমান বিন মাযউন (রাঃ) ইন্তেকাল করলে তার লাশ দাফন করা হল। অঃপর নবী (ﷺ) এক ব্যক্তিকে একটি পাথর আনতে আদেশ করলেন। লোকটি পাথরটিকে তুলতে সক্ষম না হলে আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাঁর জামার আস্তিন গুটালেন। যিনি আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নবী (ﷺ) যখন আস্তিন গুটালেন তখন তার উভয় হাতের শুভ্রতা যেন এখনো আমার চোখে চোখে ঘুরছে। অতঃপর তিনি নিজেই তা বহন করে কবরের মাথার দিকে রাখলেন এবং বললেন, “এতে আমার ভায়ের কবর চিনতে পারব এবং আমার পরিজনের মধ্যে যে মারা যাবে তাকে ওর পাশে দাফন করব।” (আবু দাউদ ৩২০৬নং, বাইহাকী ৩/৪১২)।
দাফনের পর তালকীন বা আযান কিছু নেই। শুদ্ধ প্রমাণ না থাকার জন্য এসব বিদআত। (দেখুন, আহকামুল জানাইয ১৫৫পৃঃ) বরং এই সময় কবরের পাশে দাড়িয়ে মাইয়্যেতের জন্য দুআ করতে হয়; যাতে সে কবরে ফিরিশতার প্রশ্নের জওয়াব ঠিকমত দিতে পারে। কর্তৃপক্ষ বা ইমাম উপস্থিত সকলকে দুআ করতে আদেশ করবেন। দুআ এই রূপ করবেঃ
আল্লাহুম্মাগফির লাহু আল্লাহুম্মা সাব্বিত্হ ...
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি ওকে ক্ষমা কর, ওকে মুনকির-নাকীরের প্রশ্নের উত্তরে টিকিয়ে রাখ---- ইত্যাদি।
উষমান বিন আফফান (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) মাইয়্যেত দাফন করা শেষ হলে তার কবরে দাঁড়িয়ে বলতেন, “তোমরা তোমাদের ভায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং (প্রশ্নের জওয়াবে) প্রতিষ্ঠিত থাকার তওফীক চাও। কারণ ওকে এখনই প্রশ্ন করা হবে।” (আবু দাউদ ৩২২ ১নং, হাকেম ১/৫৭০, বাইহাকী ৪/৫৬)।
আরবী দুআ না জানলে নিজের ভাষাতেই অনুরূপ দুআ করবে সকলেই। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের একাকী দুআ করাই বিধেয়। পক্ষান্তরে জামাআতী দুআ, অর্থাৎ একজন বা ইমামের দুআ করা এবং বাকী সকলের (হাত তুলে) ‘আমীন-আমীন’ বলা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সুন্নত নয়। আর না-ই তা খোলাফায়ে রাশেদীন বা কোন সাহাবার তরীকা। এখানে আল্লাহর রসূল (ﷺ) কেবল সকলকে উক্তরূপ দুআ করতে নির্দেশ দিতেন। এতে প্রত্যেকে নিজে নিজের মনে দুআ করতেন। তারা জামাআতী দুআ করতেন না। তা করা উত্তম হলে নিশ্চয়ই রসূল (ﷺ) দুআর আদেশ না করে নিজে হাত তুলে দুআ করতেন এবং সাহাবাগণও অনুরূপ করতেন। কারণ, ভালো-মন্দের ব্যাপারে আমাদের চেয়ে তাঁরাই সব রকমের জ্ঞান অধিক রাখতেন। আর তা উত্তম হলে আমাদের আগে তারাই করে যেতেন। অথচ তার কোন প্রমাণ নেই। (দেখুন, ফাতাওয়াত তাযিয়াহ, ইবনে উষাইমীন ৩১পৃঃ)
এ স্থলে এও খেয়াল রাখা উচিত যে, যে দুআ করা হবে তা যেন মৃতের আত্মার জন্য কল্যাণমূলক হয়। অপ্রাসঙ্গিক লম্বা দুআও এখানে বিধেয় নয়। অতঃপর কবরের শিয়রে ও পদতলে পঠনীয় কোন সূরা বা আয়াত নেই। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত কোন হাদীসই সহীহ নয়।
দাফনের পর কিছু সময় অপেক্ষা করার ব্যাপারে অসিয়ত করেছিলেন সাহাবী আমর বিন আল-আস। তিনি তাঁর মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, '----অতঃপর আমি মারা গেলে আমার জানাযার সাথে যেন কোন মাতমকারী ও কোন প্রকার আগুন না যায়। তারপর আমাকে তোমরা কবরে রাখার পর আমার উপর ধীরে ধীরে মাটি ঢেলে দিও। আমার কবরের পাশে ততক্ষণ অবস্থান করো যতক্ষণ একটি উটনী যবেহ করে তার মাংস ভাগ করতে সময় লাগে। যাতে আমি তোমাদেরকে কাছে পেয়ে আমার আতঙ্ক দূর করতে পারি এবং আমার প্রতিপালকের দূতকে কি জওয়াব দেব তা ভেবে নিতে পারি।'
অবশ্য এটা ছিল তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদ। নচেৎ ঐরূপ বিধেয় হলে অবশ্যই নবী (ﷺ) তা সকলের জন্য নির্দেশ দিয়ে যেতেন। (দেখুন আসইলাতুন অআজবিঝাঁতুন আ’ন আলফাযিন অমাফাহীমা ফী মীযানিশ শারীআহ, ইবনে উষাইমীন ২/৬০-৬১)।
দাফন চলাকালে বসে বসে ইমামের নসীহত করা এবং মৃত্যু সম্পর্কে সকলকে অবহিত ও সতর্ক করা, রূহের অবস্থা ও অবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা করা বৈধ। (যেমন পুর্বেই আলোচনা হয়েছে। অন্যথা এই সময় বিতর্কিত কোন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অথবা কোন পার্থিব বিষয় নিয়ে হৈ-হাল্লা করা বৈধ নয়। বরং এ সময়ে কেবল পরপারের পথিকের পথ ও যাত্রা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নীরব ও শান্ত থাকাই উচিত। (ফাতাওয়াত তা'যিয়াহ ৩৪ পৃঃ)
দাফনের পর কোন সঠিক কারণ ও প্রয়োজনে কবর খুলে লাশ বের করা ও পুনঃ দাফন করা বৈধ। জাবের (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে দাফন করার পর আল্লাহর রসূল (ﷺ) তার কবরের কাছে এলেন। অতঃপর তিনি তার লাশ বের করতে আদেশ করলেন। সে লাশ তাঁর হাঁটুর উপরে রেখে তার উপর থুথু মারলেন এবং তাঁর নিজের কামীস পরিয়ে দিলেন। জাবের (রাঃ) আরো বলেন, 'অতঃপর তিনি তার জানাযা পড়লেন। আর এর কারণ আল্লাহই অধিক জানেন। তবে আব্দুল্লাহ আব্বাস (রাঃ)-কে একটি কামীস পরিয়েছিল। (বুখারী ১৩৫০, মুসলিম ২৭৭৩নং)
প্রস্তুতি স্বরূপ পুর্বে নিজের জন্য কবর খুঁড়ে রাখা বিদআত। যেহেতু একাজ নবী (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবাগণের কেউই করে যান নি। তা ছাড়া মানুষ জানে না যে, তার মৃত্যু কখন ও কোথায় ঘটবে। (আহকামুল জানাইয ১৬১ ও ২৫৭পৃঃ) কবরের উপর খেজুর ডাল গাড়া আমাদের জন্য বিধেয় নয়। আল্লাহর রসূল (ﷺ) দুটি কবরের পাশ দিয়ে পার হওয়ার সময় ওহী মারফৎ জানতে পারলেন যে, উভয় মাইয়্যেতের আযাব হচ্ছে।--- অতঃপর তিনি একটি ভিজে খেজুর ডাল মাঝামাঝি ফেড়ে দুই ভাগ করে কবরে গেড়ে দিলেন।
সাহাবাগণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল! এরূপ কেন করলেন? তিনি বললেন, “সম্ভবতঃ ডাল দুটি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওদের গোর আযাব হাল্কা হবে।” (বুখারী ১৩৬১, মুসলিম ৩০ ১২নং)
উক্ত ঘটনাটি ছিল আল্লাহর রসূল (ﷺ) এবং উক্ত দুই কবরের জন্য খাস (বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র ব্যাপার)। কারণ, নবী (ﷺ) তাদের কবরে আযাব হচ্ছে জেনেই ডাল গেড়েছিলেন এবং এ ছাড়া আর অন্য কোন কবরে গাড়েন নি। অথচ তা যদি সুন্নাহ বা বিধেয় হত তাহলে প্রত্যেকের কবরেই অনুরূপ খেজুর ডাল গাড়তেন। তারপর তার খেলাফায়ে রাশেদীন এবং বড় বড় সাহাবাগণও এরূপ করে যান নি। বিধেয় হলে তারা এ কাজে নিশ্চয়ই অগ্রগামী হতেন।
বুরাইদা (রাঃ) সম্বন্ধে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর কবরে দুটি খেজুর ডাল গাড়তে অসিয়ত করেছিলেন। এ কথা সত্য হলেও তা ছিল তাঁর ইজতিহাদ মাত্র। আর মুজতাহিদ ভুলও করতে পারেন এবং সঠিকও। আর এ ব্যাপারে সঠিক আমল তাঁদের ছিল যারা এ কাজ করে যাননি। (ফাতহুল বারীর টীকা, ইবনে বায ৩/২৬৪)
সুতরাং সাধারণভাবে কবরে (১, ২, ৩, ৪, বা ৫টি) খেজুর অথবা অন্য কোন ডাল গাড়া বিদআত। আর উক্ত হাদীস শুনে ডাল গাড়ায় একজন মুসলিম মাইয়্যেতের প্রতি কুধারণা এই হয় যে, তার কবরে আযাব হচ্ছে, তাই এতে হাল্কা হয়ে যাবে। তাছাড়া এ কথা আমাদের জানা নেই যে, ঐরূপ করা হলে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর মত আমাদের সুপারিশও গ্রহণযোগ্য হবে। পক্ষান্তরে তার পরে আর কারো সে জ্ঞানও নেই এবং সে হাতও। (দেখুন সাবউনা সুআলান ৩৪ পৃঃ)
বাকী জন্তু-জানোয়ারের ঘোড়ার ভয়ে কবরের উপর কাটা ইত্যাদি রাখা দূষণীয় নয়। তদনুরূপ কবরের উপর মসুর ডাল ছড়ানো উক্ত উদ্দেশ্যে বৈধ। নচেৎ বিদআত।
অমাবস্যার সন্ধ্যায় বা রাত্রে দাফন হলে নাকি কবর পাহারা দিতে হয়। এটা কোন শরয়ী বিধান নয়। তবে লাশের মাথা চুরি হওয়ার কথা যদি সত্য হয়, তবে পাহারা দেওয়াই উচিত। যেমন যেখানে কাফন চোরের(?) ভয় থাকে সেখানে অমাবস্যা না হলেও পাহারা দেওয়া কর্তব্য। যাতে লাশের কোন প্রকার ক্ষতি ও সম্মানহানি না হয়।
মৃতদেহের মাংসাদি নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত যদি কবর ধসে গিয়ে লাশ বের হয়ে যায়, তবে নবরূপে কবর পুনর্নিমাণ করা উচিত। যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায় ও জন্তু জানোয়ার লাশের ক্ষতি না করতে পারে। এরূপ করলে মৃতের আযাব বাড়বে ধারণা ভিত্তিহীন।
কবরের নিকট পশু যবেহ করা, কবর আধ হাতের অধিক উঁচু করা, পলস্তরা ও চুনকাম করা, কবরের উপর কবরবাসীর নাম, প্রশংসা, কবিতাছত্র, কুরআনী আয়াত, জন্ম-মৃত্যু তারীখ, জান্নাতী’, ‘মরহুম’, ‘মগফুর ইত্যাদি লিখা, তার উপর ঘর, গম্বুজ বা মাযার নির্মাণ, তার উপর বসা ইত্যাদি হাদীস সুত্রে নিষিদ্ধ ও হারাম। (আহকামুল জানাইয)
দাফন কাজ সেরে এসে হাত-পা না ধুয়ে ঘর ঢুকতে নেই বা কাউকে স্পর্শ করতে নেই মনে করা, দাফন শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাইয়্যেতের আত্মীয়পরিজনদের আহার ভক্ষণ না করা, ব্যবহারযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও মাটির কলসি ইত্যাদি কবরের পাশে উবুড় করে ফেলে আসা, দাফনের কাজে ব্যবহৃত অতিরিক্ত বাঁশ অথবা কাফনের উদ্বৃত্ত কাপড় বা সাবানাদি বাড়ির লোকের ব্যবহার না করা বিদআত। এ সবে অমঙ্গল হয় এমন ধারণা ভিত্তিহীন ও অলীক।
কবরের উপর কোন প্রকারের গাছ অথবা ফুল গাছ লাগানো বৈধ নয়। কারণ এই গাছেই পরবর্তী কালে শির্কের আড়ডা হতে পারে। পক্ষান্তরে কবর চিহ্নিত করার জন্য পাথর ব্যবহারে অনুমতি আছে। বৃক্ষ রোপণে নয়। (মু’জামুল বিদা” ১৪৮ পৃঃ)।
পক্ষান্তরে প্রকৃতিগতভাবে যে গাছ কবরস্থানে উদগত হয় তা তাযীমযোগ্য নয়। তা কাটা যায় এবং কবরস্থান ঘেরার কাজে বা অন্য কোন ওয়াফুফের কাজে ব্যবহার করা যায়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন)