গোসল দেওয়ার পর মাইয়্যেতকে কাফনানো ওয়াজেব। এ ব্যাপারে পূর্বের ইহরাম বাধা হাজীর হাদীসে মহানবী (ﷺ) এর আদেশ এসেছে, “আর ওকে (দুই কাপড়ে) কাফনা ও ----।” যে ব্যক্তি মাইয়্যেত কাফনায় তার জন্য রয়েছে বিরাট সওয়াব।
পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “আর যে ব্যক্তি তাকে কাফন পরায়, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুক্ষ ও স্কুল রেশমবস্ত্র পরিধান করাবেন।”
কাফন হবে মাইয়্যেতের নিজের ক্রয় করা, ব্যবহৃত অথবা তার নিজস্ব অর্থ দ্বারা (অন্য কারো মারফৎ) কেনা কাপড়। খাব্বাব বিন আরাত্ত (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর পথে রসূল (ﷺ)এর সাথে হিজরত করেছিলাম। যার দরুন আমরা আল্লাহর নিকট সওয়াবের অধিকারী ছিলাম। আমাদের মধ্যে কিছু লোক, যারা তাদের কোন প্রকার (পার্থিব) প্রতিদান (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) ভোগ করেনি। এদের মধ্যে একজন বলেন, মুসআব বিন উমাইর যিনি উহুদ যুদ্ধে নিহত হলেন। একটি চেক-কাটা চাদর ছাড়া তাঁর ত্যক্ত সম্পত্তি কিছুও ছিল না। সেই চাদর দিয়ে তাকে কাফনাবার সময় যখন আমরা তার মাথা ঢাকছিলাম, তখন তাঁর পা বের হয়ে যাচ্ছিল। আর তা দিয়ে যখন তার পা ঢাকছিলাম, তখন মাথা বের হয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থা থেকে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “ঐ চাদর দ্বারা ওর মাথার দিকটা ঢেকে দাও, এবং ওর পা দুটির উপর ইখির ঘাস বিছিয়ে দাও।” আর আমাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তির ফল পরিপক্ক, ফলে তারা তা চয়ন করছে। (বুখারী ৩৭৭৩ ক, মুসলিম ১৫৬২ক, প্রমুখ।)
মৃতের ব্যয়যোগ্য সে অর্থ না থাকলে ওয়ারেসীনরা এই ব্যয়ভার বহন করবে। তারাও অপারগ হলে মুসলিমদের ‘বায়তুল মাল’ বা বিশেষ ফান্ড থেকে এর জন্য অর্থ ব্যয় করা হবে।
কাফনের কাপড় পরিষ্কার, মোটাজাতীয় সূতী, মাঝামাঝি মুল্যের সর্বাঙ্গ আবরক হওয়া মুস্তাহাব ও বাঞ্ছনীয়। কারণ, জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী (ﷺ) ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি তাঁর এক সাহাবীর কথা উল্লেখ করলেন; যাকে খাটো কাপড় দ্বারা কাফনানো হয়েছিল এবং রাতেই দাফন করে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর নিরুপায় অবস্থা ছাড়া (বেশী সংখ্যক লোকের) জানাযার নামায না পড়া পর্যন্ত রাতে কোন মুর্দা দাফন করার ব্যাপারে নবী (ﷺ) ভৎসনা করলেন। আর তিনি বললেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ তার ভাইকে কাফন পরায় তখন তার উচিত, সাধ্যমত উত্তম কাফন সংগ্রহ করা।” (মুসলিম ১৫৬৭ক, আবু দাউদ ২৭৩৭, আহমাদ ১৩৬৩১ক)।
উলামাগণ বলেন, উত্তম কাফনের অর্থ হল, তা যেন পরিষ্কার হয়, মোটা ও সর্বাঙ্গ-আবরক চওড়া হয় এবং তা যেন মাঝারি মূল্যের হয়। এখানে ‘সাধ্যমত উত্তম’ বলতে মূল্যবান কাপড় সংগ্রহে অর্থের অপচয় বা অতিরঞ্জন করা উদ্দিষ্ট নয়। (আহকামুল জানাইয ৫৮ পৃঃ)
কাফনের কাপড় সংখ্যা মাত্র একটি হওয়াই ওয়াজেব; যদি তাতে মৃতের সারা দেহ ঢেকে যায় তবে। অবশ্য সারা দেহের জন্য যথেষ্ট না হলে লাশের মাথার দিকটায় কাফন পরিয়ে পায়ের দিকটা ইখির বা অন্য কোন ঘাস (বা খড়) দ্বারা আবৃত করতে হবে। যেমন এ ব্যাপারে নির্দেশ খাব্বাব বিন আরাত্তের হাদীসে পুর্বেই উল্লিখিত হয়েছে।
তদনুরূপ কাফন কম হলে এবং মাইয়্যেতের সংখ্যা বেশী হলে একই কাফনে ২/৩টি লাশ কাফনানো বৈধ। এ ক্ষেত্রে কেবলার দিকে সেই মুর্দাকে রাখতে হবে যার কুরআন মুখস্থ (এবং জ্ঞান ও আমল) অধিক ছিল। এ ব্যাপারে আনাস (রাঃ) বলেন, “উহুদের যুদ্ধে নিহতের সংখা কাফনের তুলনায় বেশী ছিল। ২/৩ জনকে একই কবরে দাফন করা হয়েছিল। কুরআন কে বেশী জানে তা জিজ্ঞাসা করে এমন লোককে লহদ (কবরে) আগে রাখা হয়েছিল। আর একই কাপড়ে ২/৩ জন নিহতকে কাফনানো হয়েছিল। (আবু দাউদ ২৭২৯ক, তিরমিযী ৯৩৭ক, প্রমুখ)।
জিহাদের ময়দানে নিহত শহীদের পরিহিত লেবাস খুলে নেওয়া বৈধ নয়। বরং সেই লেবাস সহ তার কাফন ও দাফন করতে হবে। কেননা, পিয়ারা নবী (ﷺ) উহুদ যুদ্ধে নিহত শহীদদের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “ওদের লেবাস সহ ওদেরকে কাফনাও।” (আহমাদ ২২৫৪৭, ২২৫৫০কনাসাঈ ১৯৭৫, IT/৩০৬৭ক, সহীহ নাসাঈ ১৮৯২নং)
হজ্জ-উমরার ইহরামে মুহরিম মৃত ব্যক্তিকে তার সেই ইহরামের দুই কাপড় দিয়েই কাফনাতে হবে। যেহেতু নবী (ﷺ) পূর্বোক্ত সওয়ারী-পিষ্ট মৃত মুহরিমের জন্য বলেছিলেন, “--ওকে ওর ঐ দুই কাপড় দ্বারাই কাফনাও; যে কাপড়ে ও ইহরাম বেঁধেছিল।” (বুখারী ১৭ ১৯ক, মুসলিম ২০৯২ক, তাবারানীর কাবীর)
অবশ্য সাধারণ মাইয়্যেতের জন্য কাফনের কাপড় গণনায় তিনটি হওয়া মুস্তাহাব ও বাঞ্ছনীয়। যেহেতু মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহ রসূল (ﷺ)-কে ইয়ামানের সহুল শহরে প্রস্তুত সাদা রঙের তিনটি সুতির কাপড় দ্বারা কাফনানো হয়েছিল। তাতে কোন কামীস বা পাগড়ী ছিল না। সাধারণভাবে তাকে তার মধ্যে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।” (বুখারী ১ ১৮ ৫ক, মুসলিম ১৫৬ ৪ প্রমুখ)
সুতরাং কাফনের কাপড় সাদা হওয়াই উত্তম। যেহেতু নবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা তোমাদের লেবাসের মধ্যে সাদা কাপড় পরিধান কর। কারণ, তা সব চাইতে উত্তম। আর ঐ সাদা কাপড় দ্বারা তোমাদের ম্যাইয়্যেতকেও কাফনাও।” (আবু দাউদ ৩৫২ ৯, তিরমিযী ৯১৫ক, ইবনে মাজাহ ১৪৬১, আহমদ ২5০৯)।
সম্ভব হলে তিন কাপড়ের মধ্যে একটি কাপড় চেক কাটা সাদা হওয়া উত্তম। কেননা, পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “কেউ মারা গেলে এবং তার পরিবারবর্গ কাফন দেওয়ার মত সামর্থ্য রাখলে তারা যেন চেক কাটা কাপড় দ্বারা তাকে কাফনায়।” (আবু দাউদ ২৭৩৯, বাইহাকী ৩/৪০৩, সহীহ আবু দাউদ ২৭০২নং)
অতএব কাফনের কাপড় একটি হলে সাদা মেঝের উপর চেক কাটা হওয়া। মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে একাধিক হলে তার মধ্যে কিছু অথবা একটি কাপড় অনুরূপ চেক কাটা হওয়া উত্তম।
কাফনের কাপড়কে তিনবার আগর কাষ্ঠের সুগন্ধময় ধুয়া দিয়ে সুগন্ধময় করা মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে নবী (ﷺ) বলেন, “যখন তোমরা তোমাদের মাইয়্যেতকে সুগন্ধ ধুয়া দিয়ে সুগন্ধময় করবে, তখন যেন তা তিনবার কর।” (আহমাদ ১৩০১৪ক, ইবনে শাইবাহ, মাওয়ারিদুয যামআন ৭৫২, হাকেম ১/৩৫৫, বাইহাকী ৩/৪০৫)
আগর কাঠের ধুয়া না হলে গোলাপ পানি ইত্যাদি দ্বারাও সুগন্ধিত করা যায়। অবশ্য মুহরিমের কাফন এরূপ করা যাবে না। যেমন পূর্বোক্ত মৃত মুহরিমের হাসীসে উল্লিখিত হয়েছে। অর্থশালী হলেও কাফন দেওয়ায় অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করা বৈধ নয়।
সুতরাং অতি মূল্যবান কাপড় কেনা বা তিন খন্ডের অধিক কাপড় দেওয়া শরীয়তের নির্দেশের পরিপন্থী। তাতে অর্থের অপচয় ঘটে, আর তা নিষিদ্ধ। তাছাড়া মৃতের চাইতে জীবিত ব্যক্তিই নতুন কাপড়ের অধিক হকদার। এ কথা বলেছেন আবু বকর (রাঃ)। (আহকামুল জানাইয ৬৪ পৃঃ)
তাই কাফনের কাপড় নতুন বা সেলাইবিহীন হওয়া জরুরী নয়। পুরাতন বা সিলাইযুক্ত (কামীস, আলখাল্লা লুঙ্গি, ইত্যাদি) কাপড়েরও কাফনানো যায়। যেমন পুরুষের পরিধেয় লেবাস দিয়ে মহিলাকে কাফনানো চলে নবী (ﷺ) এর কন্যা যয়নাব (রাঃ)-কে তার লুঙ্গি দিয়ে কাফনানো হয়েছিল। (বুখারী ১২৫৩নং প্রমুখ
জীবিত অবস্থা থেকেই নিজের কাফন নিজেই প্রস্তুত করে রাখা দোষাবহ নয়। সাহাবাগণের কোন কোন ব্যক্তি আল্লাহ নবী (ﷺ) এর নিকট থেকে তার পরিধেয় কাপড় নিজের কাফন বানানোর জন্য চেয়ে নিতেন এবং তাতেই তাকে কাফনানো হত। (দেখুন, বুখারী ১২৭৭ নং)
পক্ষান্তরে কাফন উত্তম দিলে মাইয়্যেত কবরে গিয়ে অন্যান্য মওতার নিকট তা নিয়ে গর্ব করে এ ধারণা বিদআত। (মু'জামুল বিদা ১৩০পৃঃ)