মুসলিম মারা গেলে তার পরপারের জীবন কেমন হবে তার কিছু লক্ষণ মরণমুহূর্তে অভিব্যক্ত হয়ে থাকে। মৃত্যুর পর মধ্যকালে ও পরকালে তার। জীবন সুখের হবে এমন শুভমরণের কিছু লক্ষণ নিম্নরূপঃ
১। মরণের সময় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কলেমার শুদ্ধ উচ্চারণ, কলেমাটি বিশুদ্ধচিত্তে (অর্থ জেনে) শুদ্ধভাবে পাঠ করে ইন্তেকাল করলে ইনশাআল্লাহ মাইয়্যেত জান্নাতবাসী হবে। অবশ্য অন্যান্য পাপের শাস্তি তাকে পূর্বেই ভুগতে হবে। পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তির সর্বশেষ কথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে। সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (হাকেম, মাওয়ারিদুয যামআন ৭ ১৯নং)।
২। মরণের সময় ললাটে ঘর্মবিন্দু ঝরা। মহানবী (ﷺ) বলেন, “মুমিনের মৃত্যুকালে তার কপালে ঘাম ঝরে।” (তিরমীযী ৯৮২নং নাসাঈ ৪২৭নং ইবনে মাজাহ ১৪৫২ নং আহমদ ৫/৩৫০, ৩৫৭, ৩৬০, হাকেম ১/৩৬ ; ইবনে হিব্বান ৭৩০ প্রমুখ)।
৩। জুমআর রাত্রে অথবা দিনে ইন্তেকাল হওয়া। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে মুসলিম জুমআর দিন মারা যায় আল্লাহ তাকে কবরের ফিতনা থেকে বাঁচান।” (সহীহ তিরমিযী ৮৫৮নং, আহমাদ ৬২৯৪)
৪। জিহাদের ময়দানে খুন হওয়া। আল্লাহ বলেন,
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ * فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِهِم مِّنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ * يَسْتَبْشِرُونَ بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থাৎ, যারা আল্লাহর পথে (জিহাদে) নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের প্রতিপালকের নিকটে জীবিত ও তারা জীবিকা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত। আর তাদের পিছনের যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। তাদের জন্য আপোসে আনন্দ প্রকাশ করে এই নিয়ে যে, তাদের কোন ভয়। নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ পেয়ে তা আপোসে আনন্দ প্রকাশ করে। আর নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের শ্রম-ফল নষ্ট করেন না। (সুরা আ-লি ইমরান ১৬৯-১৭১ আয়াত)
জানের নবী (ﷺ) বলেন, আল্লাহর নিকট শহীদের জন্য রয়েছে ৬টি দান; তার রক্তের প্রথম ক্ষরণের সাথে তার পাপ ক্ষমা করা হবে, জান্নাতে তার বাসস্থান দেখানো হবে, কবরের আযাব থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে, কিয়ামতের মহাত্রাস। থেকে নিরাপত্তা পাবে, ঈমানের অলঙ্কার পরিধান করবে, সুনয়না হুরীদের সাথে তার বিবাহ দেওয়া হবে এবং তার নিজ পরিজনের মধ্যে ৭০ জনের জন্য তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে।” (তিরমিযী ১৫৮৬ক, ইবনে মাজাহ ২৭৮১ক, আহমাদ ১৬৫৩ সহীহ তিরমিযী ১৩৫৫নং)।
৫। আল্লাহর পথে জিহাদে থেকে গাজী হয়ে ইন্তেকাল করা। প্লেগ, পেটের রোগে বা পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। যেহেতু এমন মাইয়্যেতরা শহীদের মর্যাদা পায়। প্রাণের নবী (ﷺ) মুক্তি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কাকে কাকে তোমরা শহীদ বলে গণ্য কর?” সকলে বলল, 'হে আল্লাহর রসূল! যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) নিহত হয় সেই ব্যক্তি শহীদ। তিনি বললেন, “তাহলে তো আমার উম্মতের শহীদ-সংখ্যা নেহাতই কম।” সকলে বলল, তবে তারা আর কারা, হে আল্লাহর রসূল?’ বললেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে (জিহাদে) নিহত হয় সে শহীদ, যে আল্লাহর পথে (গাজী হয়ে) মারা যায় সে শহীদ, যে প্লেগরোগে মারা যায় সে শহীদ, যে পেটের পীড়ায় মারা যায় সে শহীদ এবং যে পানিতে ডুবে মারা যায় সেও শহীদ।” (মুসলিম ৩৫৩৯ক আহমাদ ১৩ ১৮ ক)
যে ব্যক্তি দেওয়াল চাপা পড়ে মারা যায় সেও শহীদের দর্জা পায়। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “শহীদ হল পাঁচ ব্যক্তি, প্লেগরোগে মৃত, পেটের রোগে মৃত, পানিতে ডুবে মৃত শহীদ, দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত শহীদ এবং আল্লাহর পথে (জিহাদে) নিহত ব্যক্তি শহীদ।” (বুখারী ৬১৫, মুসলিম ৩৫৩৮)।
তদনুরূপ আগুনে পুড়ে মরা, প্লুরিসি রোগে মরা, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মহিলার প্রাণত্যাগ করাও শহীদী মরণ। নবী করীম (ﷺ) বলেন, “আল্লাহর পথে (জিহাদে) নিহত হওয়া ছাড়া আরো সাত ব্যক্তি শহীদ হয়; প্লেগ রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ, ডুবে গিয়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, প্লুরিসি রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ, পেটের রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ, পুড়ে গিয়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ এবং সে মহিলাও শহীদ যে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়।” (মালেক, মুঅত্তা ৪৯৩ক, আবু দাউদ ২৭০৪ক সহীহ আবু দাউদ ২৬৬৮নং)
ক্ষয় রোগে মরাও শুভ মরণের শুভ লক্ষণ; এমন মৃত্যুও শহীদের মর্যাদা দান করে। রসূল (ﷺ) বলেন, “-----ক্ষয় রোগের ফলে মরণ শহীদের মরণ।” (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩১৭, ৫/ ৩০১)
ধন-সম্পদ ডাকাতের খপ্পরে পড়লে, পরিবার পরিজন, নিজের দ্বীন বা জান বিনাশের শিকার হলে তা রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুও শহীদী মৃত্যু। নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের মাল রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ, যে নিজের পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ, যে নিজের দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ এবং যে তার নিজের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সেও শহীদ।” (আবু দাউদ ৪১৪২ক, নাসাঈ ৪০২৬ক, তিরমিযী ১৩৪ ১ক)
তদনুরূপ নিজের সওয়ারী থেকে পড়ে গিয়ে যে মারা যায়, সেও শহীদ। (সহীহুল জামে’ ৬৩৩৬নং)
শত্রুঘাটি বা সীমান্ত প্রতিরক্ষার কাজে থাকা অবস্থায় মরণ ও শুভ মরণ প্রিয়। নবী (ﷺ) বলেন, “একটি দিন ও রাতের প্রতিরক্ষা কাজ একমাস (নফল) রোযা ও নামায অপেক্ষা উত্তম। মরার পরেও তার সেই আমল জারী থাকে যা সে জীবিত অবস্থায় করত। তার রুজী জারী হয় এবং (কবরের) যাবতীয় ফিতনা থেকে সে নিরাপত্তা লাভ করে।” (মুসলিম ২৫৩৭ক, তিরমিযী ১৫৮৮ক, নাসাঈ ৩১১৬ক)।
কোন নেক আমল ও সৎকার্য করা অবস্থায় মরণও শুভ মরণ। পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলে এবং সেটাই তার শেষ কথা হয় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রোযা রাখে এবং সেটাই তার শেষ। আমল হয় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কিছু সাদকাহ করে এবং সেটা তার শেষ কর্ম হয় তবে সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (আহমাদ ২২২৩৫ক) বলা বাহুল্য, সব ভালো তার, শেষ ভালো যার।
উল্লেখ্য যে, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘শহীদ’ বলা বা উপাধি স্বরূপ ব্যবহার করা বৈধ নয়। কারণ, নির্দিষ্টভাবে ‘শহীদ’ কে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। অবশ্য মহানবী (ﷺ) যাদেরকে ‘শহীদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন তাদের কথা স্বতন্ত্র। (আশশারহুল মুমতে’৫/৩৭৮)। প্রতিবেশীর একাধিক দ্বীনদার, জ্ঞানী সৎলোক যদি মৃত ব্যক্তির জন্য দ্বীনদারী। ও সততার সাক্ষ্য দেয়, তবে সে ব্যক্তিও ঐ সাক্ষ্যানুসারে আল্লাহর বিশেষ। অনুগ্রহে জান্নাতী হবে।
আবুল আসওয়াদ দুয়ালী বলেন, এক সময় আমি মদীনায় এলাম। তখন। সেখানে চলছিল মহামারী; ব্যাপক আকারে মানুষ মারা যাচ্ছিল। আমি গিয়ে উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এর নিকট বসলাম। এমন সময় একটি জানাযা পাশ দিয়ে পার হল। তার প্রশংসা করা হলে তিনি বললেন, ওয়াজেব হয়ে গেল। আমি বললাম “কি ওয়াজেব হয়ে গেল, হে আমীরুল মু'মিনীন? তিনি বললেন, যা আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন; তিনি বলেছেন, “যে মুসলিমের জন্য চার ব্যক্তি নেক হওয়ার সাক্ষ্য দেবে তাকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” আমরা বললাম, “আর তিনজন হলে?' তিনি বললেন, “তিনজন হলেও।” অতঃপর একজন সাক্ষ্য দিলে সে মর্যাদা আছে কিনা তা আর জিজ্ঞাসা করলাম না। (বুখারী ১২৭৯ক, তিরমিযী ৯৭১ক, নাসাঈ ১৯০৮ক, আহমাদ ১৩৩ক)
অবশ্য মৃতব্যক্তির পরিজনবর্গের কারো লাভজনক মনে করে কোন প্রতিবেশীকে সাক্ষী মানা ও তা গ্রহণ করা বিদআত। তবে সকলের উচিত, মৃত মানুষের দুর্নাম ও মন্দ চর্চা না করা। (বুখারী, আবু দাউদ, নাসাঈ, বাইহাকী)
পুর্ণিমার দিনে বা রাতে, সূর্যগ্রহণের দিনে অথবা চন্দ্রগ্রহণের রাতে ইন্তেকাল কোন শুভলক্ষণ বা মহৎ ব্যক্তিত্বের চিহ্ন নয়। কারণ, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “---চন্দ্র-সূর্য আল্লাহর বহু নিদর্শনের দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু অথবা জন্মের জন্য তাদের গ্রহণ লাগে না। গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দা সকলকে ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন।” (বুখারী ১৮৬ক, মুসলিম ১৪৯৯)।
তদনুরূপ অমাবশ্যার রাতে মরণ কোন অশুভ লক্ষণ নয়- যেমন, বহু লোকে ধারণা করে থাকে এবং মৃতব্যক্তির প্রতি কুধারণা রাখে। অনুরূপভাবে আকস্মিক মৃত্যু এবং জাকান্দানীর সময় কষ্ট না পাওয়াও শুভমরণের লক্ষণ নয়। তবে দম যাওয়ার পর চেহারা হর্ষোৎফুল্ল ও উজ্জ্বল হওয়া এবং শাহাদতের আঙ্গুল (তর্জনী) উপর দিকে উঠে যাওয়া শুভ মরণের লক্ষণ।