১। মাতম করা, উচ্চরোলে কান্না করা, গাল নোচা, কাপড় ছেড়া, চুল ছেড়া, বুকে থাপড় মারা, ইনিয়ে-বিনিয়ে রোদন করা, মাইয়্যেতের অতিরিক্ত প্রশংসা করা, ও আমার সাত কোদালের মুনিস! ও আমার সাত রাজার ধন’ ইত্যাদি বলে হা-হুতাশ সহ আর্তনাদ করে, তকদীরকে গালি দিয়ে, আল্লাহর প্রতি অবিচারের প্রতি অভিযোগ আরোপ করে কান্না করা, মাটি মাখা, মাথায় মারা, কপাল ঠোকা ইত্যাদি হারাম। এমনটি করাই হল ধৈর্যশীলতার পরিপন্থী এবং ভাগ্যের উপর অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ। এটা একটি প্রাক ইসলামের জাহেলী কুপ্রথা। যেমন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে চারটি কর্ম রয়েছে যা জাহেলিয়াতের বিষয়ীভূত; যা তারা ত্যাগ করবে না; বংশ-মর্যাদা নিয়ে গর্ব করা, (অন্যের) বংশে খোঁটা দেওয়া, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির আশা করা এবং মাতম করে কান্না করা।”
তিনি আরো বলেন, “মাতমকারিণী নারী যদি তার মরণের আগে তওবা না করে মারা যায়, তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন দাহ্য আলকাতরার পায়জামা এবং পাঁচড়াময় জামা পরিয়ে দাঁড় করানো হবে।” (মুসলিম ১৫৫০, বাইহাকী ৪/৬৩)
তিনি বলেন, “দুটি কর্ম মানুষের মাঝে রয়েছে যা কাফেরদের কাজ; কারো বংশে খোটা দেওয়া এবং মৃতর জন্য মাতম করা।” (মুসলিম ১০০ক, বাইহধন ৪৫৩)
মরার পর আত্মীয়-স্বজনরা বিশেষ করে মহিলারা মাতম করে, তা জানা সত্ত্বেও যদি কেউ তা না করতে অসিয়ত না করে মারা যায় অথবা মরার পূর্বে তার জন্য মাতম করার অসিয়ত করে যায়, তাহলে সেই মৃতব্যক্তিকেও তার পরিবারের মাতমের দায়ে কবরে ও কিয়ামতে আযাব ভোগ করতে হবে। (দেখুন, বুখারী ১২০ ক, মুসলিম ১৫৪ ক, আহকামুল জানাইয ২ পৃঃ টীকা)
অবশ্য শব্দহীনভাবে গুপ্ত কান্নায় নয়না বিগলিত হওয়া দুষণীয় নয়। যেমন, পুর্বেই আলোচিত হয়েছে।
২। শোকে ভেঙ্গে পড়ে মাথা নেড়া করে ফেলা হারাম। কারণ, মহানবী (ﷺ) এমন মহিলা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেছেন, যে তার কেউ মারা গেলে) উচ্চস্বরে কান্না করে, নিজের মাথা নেড়া করে ফেলে এবং কাপড় ছিড়ে।” (বুখারী ১২৯৬নং, মুসলিম ১৪৯)
৩। মহিলাদের আলুলায়িত কেশদাম ছড়িয়ে রাখা (মাথা না বাধা) বৈধ নয়। কারণ, জনৈক বায়আতকারিণী সাহাবী বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ) যে সব সৎ বিষয়ে আমাদের নিকট থেকে বায়আত গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে এও যে, আমরা তার অবাধ্যাচরণ করব না, (বিপদের সময়) চেহারা নুচব না, ধ্বংস ডাকব না, বুকের কাপড় ছিড়ব না এবং চুল ছিটিয়ে রাখব না। (আবু দাউদ ২৭২৪ক, বাইহাকী ৪/৬৪)।
৪। শোকে বিমর্ষ হয়ে কেবল কয়েকদিনকার জন্য দাড়ি বাড়ানো; যদিও এর পূর্বে সে সর্বদা চেঁছে বা ছোট করে হেঁটেই ফেলত। অতঃপর শোক দুর হলে পুনরায় চাছতে বা ছাঁটতে শুরু করা বৈধ নয়। কারণ, কয়েক দিনকার জন্য দাড়ি ছাড়া বাহ্যতঃ উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত চুল ছড়ানোর শামিল। অতএব তা নিষিদ্ধ, অবৈধ এবং বিদাআতও। তবে হ্যাঁ এরপর থেকে যদি তওবা করে দাড়ি ছেড়ে রেখে আর না চছে বা না ছাঁটে, তবে সেটাই হল ওয়াজেব। (আহকামুল জানাইয
৫। শোক পালনের জন্য বিশেষভাবে কালো কাপড় পরা অথবা অন্য কোন বিশেষ ধরন বা রঙের লেবাস পরা বিদআত। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন)
৬। মৃত্যু সংবাদ সাধারণভাবে রেডিও, টিভি,পত্র-পত্রিকা ও লাউডস্পিকার প্রভৃতি শব্দবর্ধক যন্ত্রের সাহায্যে অথবা উচ্চরবে বাজারে বাজারে, পাড়ায়পাড়ায় অথবা মসজিদের মিনারে-মিনারে অথবা দরজায়-দরজায় ঘোষণা ও প্রচার করা নিষিদ্ধ ও অবৈধ। হুযাইফা বিন য়্যামান (রাঃ) এর কোন আত্মীয় মারা গেলে বলতেন, মৃত্যুর খবর কাউকে জানাব না। কারণ আমার আশঙ্কা হয় যে, তা মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পর্যায়ভুক্ত। কেননা, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করায় নিষেধ করতে শুনেছি।” (তিরমিযী ৯০৭ক, ইবনে মাজাহ ১৫৬৫ক, আহমাদ ২২৩৫৮ক)
আল্লামা আলবানী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, (نعي) শব্দের আভিধানিক অর্থ হল, মৃতব্যক্তির মৃত্যুর খবর দেওয়া। সুতরাং এই অর্থে সকল ধরনের খবর দেওয়াই এর শামিল। কিছু সহীহ হাদীস এসেছে যা এক ধরনের খবর দেওয়ার বৈধতার কথা প্রমাণ করে। উলামাগণ বলেন, এ ধরনের খবর দেওয়ার ব্যাপারটা মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপার থেকে ব্যতিক্রম। মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করার অর্থ হল এমন এলান ও ঘোষণা করা যেমন জাহেলী যুগে বাড়ির দরজায় দরজায় ও বাজারে বাজারে চিৎকার করে প্রচার করা হত।
পক্ষান্তরে এমনভাবে মৃত্যু-সংবাদ দেওয়া বৈধ, যাতে জাহেলী যুগের ঐ মৃত্যু-সংবাদ প্রচার ও ঘোষণা করার অর্থ পাওয়া যায় না। বরং অনেক সময় মৃত্যু সংবাদ অপরকে জানানো ওয়াজেব হয়। যেমন, যদি মৃতব্যক্তির নিকট এমন লোক না থাকে যাতে গোসল-কাফন ও জানাযার নামায ইত্যাদি যথা নিয়মে পালন হতে পারে।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, “বাদশা নাজাশী যেদিন ইন্তিকাল করেন সেদিন নবী (ﷺ) তাঁর মৃত্যু-সংবাদ সকলকে জানান এবং মুসাল্লায় বের হয়ে গিয়ে কাতার বানিয়ে চার তকবীর দিয়ে (গায়েবানা) জানাযার নামায পড়েন।” (বুখারী ১১৬৮, মুসলিম ১৫৮০ক)
মৃত্যুব্যক্তির ঝুটা অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে সংবাদ দেওয়া সংবাদদাতার জন্য বৈধ নয়। আর তার জন্য মুস্তাহাব হল যাকে মৃত্যু সংবাদ জানাবে তার নিকটে মৃতব্যক্তির জন্য দুআর আবেদন করা। আবু কাতাদাহ হতে বর্ণিত, (মূতা যুদ্ধের যোদ্ধাদের খবর বর্ণনা করে নবী (ﷺ) বললেন,) “আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের যোদ্ধাদলের সংবাদ দেব না? তারা বহু পথ চলার পর শত্রদলের সম্মুখীন হয়েছে। অতঃপর যায়দ শহীদ হয়ে গেছে, অতএব তোমরা তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।” এতে সকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল। তিনি পুনঃ বললেন, “এরপর পতাকা ধারণ করেছে জাফর বিন আবী তালেব। সে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে কঠিনভাবে লড়ে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়ে গেছে। আমি তার শাহাদতের সাক্ষী। সুতরাং তোমরা তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর পতাকা ধারণ করেছে। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা দৃঢ়পদে লড়াই লড়ে শেষে সেও শহীদ হয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা তার জন্যও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।----” (আহমাদ ৫/২৯৬, ৩০০-৩০১, ২১৫০৯)।
মৃতের দম যাওয়া মাত্র বাড়ির লোকের কিছু সদকাহ করা বিদআত। যেমন, মৃত্যুর খবর শুনে কোন প্রতিষ্ঠানের লোকেদের সমবেত হয়ে মৃতব্যক্তির। আত্মার উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হয়ে ক্ষণেক নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা অনৈসলামিক প্রথা। এরূপ মুসলিমরা করতে পারে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ১/৩৭-৩৮)
যে স্থানে দম যায় সেই স্থানে কয়েকদিন ধরে রূহ ঘোরাফিরা বা যাতায়াত করে এমন ধারণা ভ্রান্ত ও বিদআত। তাই সে স্থানে কয়েকদিন যাবৎ লাতা দেওয়া, বাতি জ্বালানো, ধূপধুনো দেওয়া এবং পরে মসজিদের ইমাম ও জামাআত সহ মীলাদ অনুষ্ঠান করে সেই রূহ তাড়ানোর ব্যবস্থা করা বিদআত। জান কবজ হওয়ার সময় বাড়িতে যে পানি বা পাকানো খাবার ছিল তা ফেলে দেওয়া, ঝাড়বাতি আয়না প্রভৃতি আবৃত করাও বিদআত। (আহকামুল জানায়েয বিদয়াত নং ২১)।
বেনামাযী বা নামায ত্যাগকারীর নামায ছাড়ার গোনাহ মাফ করাবার উদ্দেশ্যে ওয়াক্ত হিসাব করে নির্দিষ্ট কাফফারা দেওয়ার ফলে মুর্দার কোন লাভ হয় বলে শরীয়তে কিছু নেই। সুতরাং এমন নামায খন্ডনের কাফফারা প্রথা বিদআত। আর বেনামাযী তওবা না করে মারা গেলে আর কোন কাফফারাই তার কাজে লাগবে না। (দেখুন, ইসলাহুল মাসাজিদ, মিনাল বিদায়ি অল আওয়ায়িদ, আহকামুল জানাই ১৭৪ ২৫৭পৃঃ, মুজামুল বিদা ১৬৪পৃঃ)