রূহ কবয হয়ে গেলে উপস্থিত ব্যক্তিদের উচিতঃ
১। তার চক্ষুদ্বয় খোলা থাকলে বন্ধ করে দেওয়া এবং তার জন্য পুনঃপুনঃ দুআ করা। যেমন, আল্লাহ! তুমি ওকে ক্ষমা কর, সৎপথপ্রাপ্ত লোকেদের দলভুক্ত কর এবং ওকে মাফ করে দাও প্রভু! ওর মত (ভালো লোক) ওর। বংশে পুনঃ দান কর। আমাদেরকে এবং ওকে মাফ করে দাও প্রভু! ওর কবরকে প্রশস্ত করো এবং তা আলোময় করে দিও---।” ইত্যাদি।।
উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) আবু সালামার নিকট উপস্থিত হলেন। তখন তার চক্ষু (মৃত্যুর পর) খোলা ছিল। তিনি তা বন্ধ করে দিলেন এবং বললেন, “রূহ কবয হয়ে গেলে চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।” নবী (ﷺ)বললেন, “তোমরা নিজেদের উপর বদুআ করো না বরং মঙ্গলের দুআ কর। কারণ, তোমরা যা বল তার উপর ফিরিশ্তাবর্গ ‘আমীন-আমীন’ (কবুল কর) বলে থাকেন।”
অতঃপর তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি আবু সালামাহকে ক্ষমা করে। দাও। ওর মর্যাদা উন্নীত করে ওকে হেদায়াতপ্রাপ্তদের দলভুক্ত করে দাও। ওর অবশিষ্ট পরিজনের মধ্যে ওর পরবর্তী প্রদান কর। আমাদেরকে এবং ওকে মাফ করে দাও হে সারা জাহানের প্রভু! ওর জন্য ও কবরকে প্রশস্ত ও আলোকিত করে দাও।” (মুসলিম ১৫২৮ক, ইবনে মাজাহ ১৪৪৪ক, আহমাদ ৬/২৯৭, বাইহাকী ৩/৩৩৪)
২। মুখগহ্বার খোলা থাকলে বন্ধ করে দেবে। প্রয়ােজনে দুই চিবুক চেপে কিছু বেঁধে দেবে। হাত-পা হিলিয়ে ঢিলা করে দেবে। অনিবার্য কারণে দাফনে দেরী হবে আশঙ্কা করলে লাশ ফ্রিজে রাখার ব্যবস্থা করবে।
৩। একটি চাদর বা কাঁথা দ্বারা তার সর্বশরীর ঢেকে দেবে। মা আয়েশা বলেন, “আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন ইন্তেকাল করলেন তখন তাঁকে চেককাটা ইয়ামানী চাদর দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।” (বুখারী ৫৩৬৭ক, আবু দাউদ ২৭ ১৩ক, প্রমুখ)
তবে মৃতব্যক্তি হজ্জ করতে গিয়ে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মারা গেলে তার চেহারা ও মাথা ঢাকা চলবে না। কারণ, আব্বাস (রাঃ) বলেন, “আরাফাতে অবস্থান-কালে এক ব্যক্তি তার সওয়ারী থেকে পড়ে তার ঘাড় ভেঙ্গে মারা গেলে নবী (ﷺ) বললেন, “কুলের পাতা-মিশ্রিত পানি দ্বারা ওর গোসল দাও, (যে দুই ইহরামের কাপড় ও পরে আছে সে) দুই কাপড়েই ওকে কাফনিয়ে দাও, কোন খোশবু ওর দেহে লাগাবে না। আর ওর মাথা ও চেহারা ঢাকবে না। কেননা, কিয়ামতের দিন ও তালবিয়াহ পড়া অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে।” (বুখারী ১৭ ১৯ক, মুসলিম ২০৯২ক, প্রমুখ)
৪। অতিসত্বর তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করবে এবং এতে মোটেই বিলম্ব করবে না। কারণ, নবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা জানাযার কার্য শীঘ্র সমাধা কর।” (বুখারী ১২৩১ক, মুসলিম, ১৫৬ ক, প্রমুখ)
৫। যে শহর বা গ্রামে মৃত্যু ঘটেছে সেই শহর বা গ্রামেই লাশ দাফন করবে। অন্য কোন স্থানে বহন করে সেখানে দাফন করা বিহিত নয়। কারণ, এ কাজ উক্ত শীঘ্রতার আদেশের পরিপন্থী। পরন্তু জাবের বলেন, উহুদের যুদ্ধের দিন মুসলিমদের লাশ বাকী’তে দাফন করার জন্য বহন করা শুরু হলে রসূলুল্লাহর তরফ থেকে এক আহ্বানকারী আহ্বান করে বলল, আল্লাহর রসূল (ﷺ) তোমাদেরকে তোমাদের লাশসমূহকে তাদের মৃত্যুস্থলে দাফন করতে আদেশ করেছেন। আমার আম্মাজান তখন আমার আব্বাজান ও মামাজানকে একটি সেচক উটের পিঠে পাশাপাশি রেখে বাকীতে দাফন করার উদ্দেশ্যে বহন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাদেরকেও (ঐ আদেশানুসারে) ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।' (আবু দাউদ ১৭৪২ ক, তিরমিযী ১৬৩১ক, ইবনে মাজাহ ১৫০৫ক, আহমাদ ১৩৬৫৩ ক, মাওয়ারেদু্য যামআন ১৯৬ নং, বাইহাকী ৪/৫৭)
আয়েশা (রাঃ) এর এক ভাই ওয়াদিউল হাবাশাতে মারা গেলে এবং সেখান হতে তার লাশ বহন করা হলে তিনি বলেছিলেন, যার শোক আমাকে সন্তপ্ত করেছে তা এই যে, আমার ইচ্ছা ছিল আমার ভাই-এর দাফন তার মৃত্যুস্থলেই হোক।” (বাইহাকী, আহকামুল জানায়্যে ১৪পৃঃ)
কোন মর্যাদাপূর্ণ (বা তথাকথিত শরীফ) স্থানে দাফন করার অসিয়ত মৃতব্যক্তি করে থাকলেও তা মানা উচিত নয়। কারণ, এমন অসিয়ত বাতিল। (আযকার, নওবী, আহকামুল জানায়েয ১৪ পৃঃ, টীকা) আর সেখানে দাফন করলে মৃতের কোন ইষ্টলাভ হবে মনে করাও যুক্তিযুক্ত নয়।
পক্ষান্তরে লাশের কোন প্রকার ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে; যেমন সেথায় দাফন করলে তার কবর বা লাশের উপর অত্যাচার হতে পারে, কোন বিবাদ, হঠকারিতা বা কুপ্রবৃত্তিবশে কেউ লাশের মর্যাদাহানি ঘটাতে পারে এমন ভয় হলে নিরাপদ স্থানে বহন করে দাফন করা ওয়াজেব। তদনুরূপ কেউ বিদেশে মারা গেলে তার আত্মীয়-পরিজনের দর্শন আশা পূরণ করার জন্য এবং যিয়ারত সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে স্বদেশে বহন করে দাফন করাও প্রয়ােজনে বৈধ। (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১০/৬২)।
৬। সত্বর তার বকেয়া ঋণ পরিশোধ করবে। এতে মৃত্যের ত্যক্ত সমস্ত সম্পদ লেগে গেলেও ঋণশোধে ওয়ারেসীনদের দ্বিধা করা উচিত নয়। ঋণ পরিশোধের মত অর্থ না থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য তার তরফ থেকে সে ঋণ শোধ করা। তা না হলে বায়তুল মাল বা মুসলিমদের বিশেষ ফান্ড হতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। অবশ্য এতে যদি কোন আত্মীয় বা অন্য কোন মুসলিম সাহায্য করে ঋণ পরিশোধ করে দেয় তাও উত্তম ও বৈধ।
সা’দ বিন আত্বঅল (রাঃ) বলেন, তার ভাই মাত্র ৩ শত দিরহাম রেখে মারা যান। আর ছেড়ে যান সন্তান-সন্ততিও। আমার ইচ্ছা ছিল ও দিরহামগুলো আমি তার পরিবারবর্গের উপর খরচ করব। কিন্তু নবী (ﷺ) আমাকে বললেন, “তোমার ভাই তো ঋণ-জালে আবদ্ধ। সুতরাং তুমি গিয়ে (আগে) তার ঋণ শোধ কর।” অতএব আমি গিয়ে তার ঋণ শোধ করে এলাম এবং নবী (ﷺ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি তার সমস্ত ঋণ শোধ করে দিয়েছি। তবে একটি মহিলা দুই দীনার পাওয়ার কথা দাবী করছে, কিন্তু তার কোন সবুত নেই। তিনি বললেন, “ওকেও দিয়ে দাও। কারণ ও সঠিক বলছে।” (ইবনে মাজাহ ২৪২৪ ক, আহমাদ ১৬৯৩ ক)
রসূল (ﷺ) বলেছিলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হয় অতঃপর তা পরিশোধে অপারগ হয়ে পরিশোধ না করেই মারা যায়, সে ব্যক্তির অভিভাবক আমিই।” (আহমাদ ২৩৩১৬ ক, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৯৭৩নং, এ ব্যাপারে আরো অন্যান্য হাদীসও রয়েছে। দেখুন আহকামুল জানায়েয আলামা আলবানী)
মোট কথা, ঋণ পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত মৃত ব্যক্তি জান্নাত প্রবেশে প্রতিবন্ধী থাকবে। অতএব কর্তব্য হল, মাইয়েতের ত্যক্ত সম্পত্তি ও অর্থ থেকে প্রথমে তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা, অতঃপর তার ঋণ পরিশোধ, অতঃপর অসিয়ত পালন, এবং সবশেষে বাকী সম্পত্তি ও অর্থ ওয়ারেসীনদের মাঝে ভাগবন্টন করা হবে।