মুমূষু ব্যক্তির প্রাণ ওষ্ঠাগত-প্রায় হওয়া বুঝলে সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের যা করা উচিত তা হল নিম্নরূপঃ
১। কলেমা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ স্মরণ করিয়ে দেওয়া। পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, তোমরা তোমাদের মরণাপন্ন ব্যক্তিকে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ স্মরণ করিয়ে দাও।” (তিরমিযী ৯৭৬, নাসাঈ ১৮২৬, ইবন মাজাহ ১৪৪৪ প্রমুখ।)
“যে ব্যক্তির মৃত্যুর সময় সর্বশেষ কথা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ হবে সে একদিন জান্নাত প্রবেশ করবে - যদিও সে তার পূর্বে কিছু আযাব ভোগ। করবে।” (মাওয়ারিদুয যামআন ৭১৯নং, ইরওয়াউল গালীল ৬৭৯নং)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই’ একথা জানা অবস্থায় মারা যায় সে জান্নাত প্রবেশ করবে।” (মুসলিম ৩৮ক, আহমাদ ৪৩৪ক)।
অতএব এই শেষ মুহূর্তে যদি সে এই কলেমা উচ্চারণ করে ও হৃদয়ে এর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় রেখে মরণের হাতে আত্মসমর্পণ করতে পারে তাহলে সে শুরু থেকে না হলেও কোন এক সময়ে জান্নাতে প্রবেশ করে সেখানে চিরস্থায়ী হবে। তালকীনের অর্থ কেবল মরণাপন্ন ব্যক্তির সামনে কলেমা পাঠ করে শোনানোই নয় বরং ঐ কলেমা পাঠের আদেশও তাকে করা যায়। (আহকামুল জানায়েয আলবানী ১০পুঃ)।
আনাস (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) আনসারদের এক (মরণাপন্ন) ব্যক্তিকে দেখা করতে গিয়ে বললেন, “হে মামা! লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বল।” লোকটি বলল, মামা নাকি চাচা?” তিনি বললেন, “বরং মামা।” অতঃপর লোকটি বলল, “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলা কি আমার জন্য কল্যাণকর?’ নবী (ﷺ) বললেন, “অবশ্যই।” (আহমাদ ১২৮৫নং)
অনুরূপ আদেশ করেছিলেন তাঁর চাচা আবু তালেবকেও; বলেছিলেন, “হে চাচা! আপনি “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলুন---।” (বুখারী ১৩৬০, মুসলিম, নাসাঈ, আহমদ ৫/৪৩৩)
অবশ্য কলেমা বলার জন্য বারবার আদেশ করা উচিত নয়। কারণ সেই কঠিন মৃত্যু যন্ত্রণার সময় বিরক্ত হয়ে তা বলতে অস্বীকার করতে পারে অথবা বিরক্ত হয়ে কোন অসমীচীন কথাও বলে ফেলতে পারে। সুতরাং কলেমার প্রতি বিরক্তিভাব প্রকাশ পেলে মৃতের শেষ পরিণাম অশুভ হয়ে যাবে। অতএব নম্রতার সাথে ধীরে ধীরে তাকে কলেমা উচ্চারণ করাতে চেষ্টা করতে হবে। এর পরেও যদি সে না বলে, তাহলে তার ব্যাপার আল্লাহর হাতে। আল্লাহর নিকট আমরা শুভ পরিণাম প্রার্থনা করি। আমীন।
মরণাপন্ন ব্যক্তি কলেমা পাঠ করে নিলে তার নিকট উপস্থিত সকল ব্যক্তিবর্গের উচিত, আর কিছু না বলে চুপ থাকা এবং তার সাথে অন্য কথা না বলা; যাতে তার সর্বশেষ কথা ঐ কলেমাই হয়। নচেৎ তারপর কথা বললে পুনরায় কলেমার তালকীন করা কর্তব্য। (সাবউনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ইবনে উষাইমীন ৪ পৃঃ)
এ স্থলে কতকগুলো বিষয় জেনে রাখা জরুরীঃ
১। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ বলে অথবা আহলে বায়ত বা অন্য কোন বুযুর্গ ও অলীর নাম স্মরণ ও স্বীকার করানো বিদআত। (আহকামুল জানাই অবিদাউহা, বিদআত নং ৩)।
২। মুমুর জন্য দুআ করা; আল্লাহ! ওকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ! ওর মরণকষ্ট আসান করে দাও --- ইত্যাদি।
৩। কোন প্রকারের মন্দ কথা বা অন্যায় মন্তব্য না করা। কারণ, নবী (ﷺ) বলেন, যখন তোমরা কোন রোগী বা মরণাপন্ন ব্যক্তির নিকট উপস্থিত থাকবে, তখন ভালো কথাই বলো। কেননা, তোমরা যা বলবে তার উপর ফিরিস্তাবর্গ ‘আমীন-আমীন’ বলবেন।” (মুসলিম ১৫২৭ক, তিরমিযী ৮৯৯ক, প্রমুখ) সুতরাং এ মুহূর্তে দুআ ও বন্দুআ উভয়ই কবুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তাই এই সময় মুর্খ লোক ও বাজে মেয়েদের বাজে মন্তব্য এবং অহেতুক কলকলানি থেকে ঐ পরিবেশকে মুক্ত ও শান্ত রাখা উচিত। যাতে মুমূর্ষ ব্যক্তি কলেমা শুনতে, বুঝতে ও বলতে পারে এবং দুআময় পরিবেশে তার জীবনাবসান ঘটে। ওয়ারেসীনদের উচিত, এ কাজে মুমুর্ষকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা এবং মীরাস নিয়ে এই মুহূর্তে তার সামনে আপোসে বচসা না করা।
এই সময় মরণাপন্ন ব্যক্তির নিকট সুরা ইয়াসীন বা অন্যান্য সুরা পড়ার কথা শুদ্ধ হাদীসে নেই। সুতরাং এখন হতে সেই দাফন ও কবর যিয়ারত পর্যন্ত (নামাযে ছাড়া) কোন স্থানেই কুরআনের কোন আয়াত পড়া বিহিত নয়। অবশ্য মরণের সময় মরণােন্মুখ ব্যক্তি কুরআন তেলাঅত শুনতে চাইলে সে কথা ভিন্ন।
অন্যথা মৃতব্যক্তির শিয়রে কুরআন রাখা, পার্শ্বে বসে লোয়ানোর আগে পর্যন্ত অবিরাম কুরআন পড়া, (কোন দুর্গন্ধ না থাকলেও) ধূপধুনো দেওয়া, সারারাত্রি ব্যাপী বাতি জ্বালিয়ে রাখা, অপবিত্র (ঋতুমতী) কাউকে লাশের পাশ ঘেঁষতে না দেওয়া ইত্যাদি বিদআত। (আহকামুল জানাইয ২৪৪ পৃঃ)।
তদনুরূপ মরণাপন্ন ব্যক্তিকে কেবলামুখ করা প্রসঙ্গে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। বরং সাঈদ বিন মুসাইয়িব এ কাজকে মকরূহ মনে করেছেন। যুরআহ বিন আব্দুর রহমান সাজুর রহমান সাঈদ বিন মুসাইয়িবের মৃত্যু রোগের সময় তার নিকট উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন আবু সালামাহ বিন আব্দুর রহমানও। এক সময় সাঈদ জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে আবু সালামাহ তাঁর বিছানাটাকে কেবলামুখ করতে আদেশ করলেন। জ্ঞান ফিরে পেলে তিনি বললেন, 'তোমরা আমার বিছানা ঘুরিয়ে দিয়েছ?!’ সকলে বলল, হ্যাঁ। একথা শুনে তিনি আবু সালামার প্রতি তাকিয়ে বললেন, 'আমার মনে হয় তোমার জ্ঞানে এ কাজ হয়েছে? আবু সালামাহ বললেন, 'আমিই ওদেরকে আদেশ করলাম। এরপর সাঈদ তার বিছানাকে পূর্বাবস্থায় ঘুরিয়ে দিতে আদেশ করলেন। (ইবনে আবী শাইবাহ ৪/৭৬)।
মুমুর্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে কোন মৃতব্যক্তিকে সালাম পৌছানো বিদআত এ ব্যাপারে যে সলফের আমল বর্ণিত করা হয় তা সহীহ নয়। (যয়ীফ ইবনে মাজাহ ৩১০নং, মিশকাত ১৬৩৩নং)
ইসলাম পেশ করলে এই শেষ মুহূর্তে মুসলিম হয়ে যেতে পারে এই আশায়। কোন কাফেরের মরণদশা দেখতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম পেশ করা উত্তম কাজ। আনাস (রাঃ) বলেন, একজন ইহুদী কিশোর নবী (ﷺ) এর খিদমত করত। সে পীড়িত হলে মহানবী (ﷺ) তাকে দেখা করতে এলেন এবং তার শিথানে বসে বললেন, “ইসলাম গ্রহণ কর (তুমি মুসলিম হয়ে যাও)।” তার এই কথা শুনে সে তার পিতার দিকে (তার মত জানতে) দৃষ্টিপাত করল। তার পিতা তার নিকটেই বসে ছিল। সে বলল, আবুল কাসেম (ﷺ)-এর কথা তুমি মেনে নাও। ফলে কিশোরটি মুসলমান হয়ে গেল। অতঃপর নবী (ﷺ) এই বলতে বলতে বের হয়ে গেলেন, “সেই আল্লাহর সকল প্রশংসা যিনি ওকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। তারপর কিশোরটি মারা গেলে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা তোমাদের এক সাথীর উপর (জানাযার নামায পড়।” (বুখারী ১২৬৮ক)।
এখানে লক্ষণীয় যে, কোন কাফের শেষ মুহূর্তে ঈমান আনলে তার জানাযা আদি পড়া হবে।