তারা আল্লাহ তাআলার যথাযথ বড়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি - ১

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘তারা আল্লাহ্‌র যথাযথ কদর করেনি। কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা যুমারঃ ৬৭)

ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতের অর্থে একাধিক হাদীছ ও আছার বর্ণিত হয়েছে। হাফেয ইমামুদ্দীন ইবনে কাছির (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এখানে বলেনঃ মুশরিকরা আল্লাহর যথাযথ কদর করেনি। এ কারণেই তারা আল্লাহর সাথে অন্যের এবাদত করেছে। তিনি এত বড় যে, তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান, সবকিছুর মালিক এবং সবকিছুই তার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধীন।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ তারা আল্লাহর যথাযথ মর্যাদা প্রদান করেনি। মুহাম্মাদ বিন কা’ব (রঃ) বলেনঃ মুশরিকরা যদি আল্লাহর যথাযথ কুদরত উপলব্ধি করতে পারতো, তাহলে তারা কুফরী করতোনা।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াত এবং এ বিষয়ে অন্যান্য আয়াত ও হাদীছের ব্যাপারে সালফে সালেহীনদের মাযহাব এই যে, কোনো প্রকার ধরণ বর্ণনা করা এবং কোন প্রকার পরিবর্তন ছাড়াই এগুলো যেভাবে এসেছে, সেভাবেই জারী (চালু) রাখতে হবে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

«جَاءَ حَبْرٌ مِنَ الأَحْبَارِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلمَ قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنَّا نَجِدُ أَنَّ اللَّهَ يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالأَرَضِينَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلاَئِقِ عَلَى إِصْبَعٍ فَيَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ فَضَحِكَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ تَصْدِيقًا لِقَوْلِ الْحَبْرِ ثُمَّ قَرَأَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ»

‘‘একজন ইহুদী পন্ডিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­ামের নিকট এসে বললঃ হে মুহাম্মাদ! আমরা তাওরাত কিতাবে দেখতে পাই যে, আল্লাহ তাআলা আকাশ মন্ডলীকে এক আঙ্গুলে, সমস্ত যমীনকে এক আঙ্গুলে, বৃক্ষরাজিকে এক আঙ্গুলে, পানি ও কাদাকে এক আঙ্গুলে এবং সমস্ত সৃষ্টি জগতকে এক আঙ্গুলে রেখে বলবেন, আমিই বাদশাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ইহুদী পন্ডিতের এ কথা শুনে এবং তা সত্যায়ন করে এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর দন্ত মোবারক দেখা যাচ্ছিল। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেনঃ

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘তারা আল্লাহ্‌র মর্যাদা ও ক্ষমতা মুতাবেক কদর করতে পারেনি। কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা যুমারঃ ৬৭)[1] সহীহ মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

«وَالْجِبَالَ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ ثُمَّ يَهُزُّهُنَّ فَيَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَنَا اللَّهُ»

‘‘পাহাড়-পর্বত এবং বৃক্ষরাজি এক আঙ্গুলে থাকবে। অতঃপর এগুলোকে ঝাকুনি দিয়ে তিনি বলবেনঃ আমি রাজাধিরাজ, আমিই আল্লাহ’’।[2]

সহীহ বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় আছেঃ

«يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلاَئِقِ عَلَى إِصْبَعٍ»

‘‘আকাশ মন্ডলীকে এক আঙ্গুলে রাখবেন। পানি এবং কাদাকে এক আঙ্গুলে রাখবেন। আরেক আঙ্গুলে রাখবেন সমস্ত সৃষ্টিকে’’।[3]

ব্যাখ্যাঃ ইমাম বুখারী, মুসিলম এবং ইমাম নাসায়ী (রঃ) এভাবেই আমাশ থেকে একাধিক সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী (রঃ) আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

«يَقْبِضُ اللَّهُ الأَرْضَ وَيَطْوِى السَّمَوَاتِ بِيَمِينِهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ»

‘‘কিয়ামতেন দিন আল্লাহ্ তাআলা যমীনকে স্বীয় মুষ্ঠির মধ্যে রাখবেন। আর ডান হাতে রাখবেন আসমানকে ভাজ করা অবস্থায়। অতঃপর তিনি বলবেনঃ আমিই বাদশাহ। দুনিয়ার বাদশাহরা আজ কোথায়’’? ইমাম বুখারী এই শব্দে একাই বর্ণনা করেছেন।[4]

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুসলিম শরীফে বর্ণিত মারফু হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«يَطْوِى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ السَّمَوَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُهُنَّ بِيَدِهِ الْيُمْنَى ثُمَّ يَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ ثُمَّ يَطْوِى الأَرَضِينَ بِشِمَالِهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ»

‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আকাশমন্ডলীকে ভাঁজ করবেন। অতঃপর তা ডান হাতে নিবেন। অতঃপর বলবেনঃ আমিই বাদশাহ। দুনিয়ার প্রতাপশালীরা আজ কোথায়? দুনিয়ার অহংকারীরা আজ কোথায়? অতঃপর সাত যমীনকে ভাঁজ করবেন এবং এগুলোকে বাম হাতে নিবেন। অতঃপর বলবেনঃ আমি হচ্ছি রাজাধিরাজ। দুনিয়ার অত্যাচারীরা আজ কোথায়? দুনিয়ার অংহকারীরা আজ কোথায়?[5]

ব্যাখ্যাঃ সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এভাবেই এসেছে। হুমাইদী বলেনঃ এই বর্ণনাটি অধিক পরিপূর্ণ।

ব্যাখ্যাকার বলেনঃ এ সমস্ত হাদীছ এবং অনুরূপ অর্থে আরো অনেক হাদীছ আল্লাহর বড়ত্ব, সকল দিক থেকে তাঁর পরিপূর্ণতা এবং তাঁর কুদরতের বিশালতার প্রমাণ বহন করে। তাতে জাহমীয়া, আশায়েরা এবং তাদের অনুরূপ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদও রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য যেসব সিফাত সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তা আল্লাহর পূর্ণতা, বড়ত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ করে। এ সমস্ত সিফাত আরো প্রমাণ করে যে, এবাদতের কোনো প্রকারই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা জায়েয নয়। না কোন নৈকট্যশীল ফেরেশতার জন্য তা করা জায়েয, না কোনো প্রেরিত নবীর জন্য কিংবা অন্য কারো জন্য।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর কিতাব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, রাসূলের পবিত্র সুন্নাত, সাহাবী ও তাবেয়ীদের উক্তি এবং সম্মানিত ইমামদের স্মরণীয় বাণীর মধ্যে অগণিত দলীল রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক সৃষ্টির উপরে, তিনি সমস্ত আসমানের উপরে আরশের উপর সমুন্নত। ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই কথা বলার পর কুরআন ও সুন্নাহ হতে অনেক দলীল পেশ করেছেন।

ইমাম আওযায়ী (রঃ) বলেনঃ আমরা এবং আমাদের যামানায় যেসব তাবেয়ী জীবিত ছিলেন, আমরা সকলেই বলতামঃ আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। সহীহ সুন্নাতে এ ব্যাপারে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলোর উপরই আমরা ঈমান আনয়ন করি।

আবু উমার তালমানকী (রঃ) তাঁর কিতাবুল উসূলে বলেনঃ আহলে সুন্নাত মুসলিমগণের ইজমা সংঘটিত হয়েছে যে আল্লাহ তাআলা স্বীয় সত্তায় আরশের উপরে। ইমাম যাহাবী (রঃ) কিতাবুল উলুতে এটি উল্লেখ করেছেন।

আবু উমার তালমানকী (রঃ) আরো বলেনঃ এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের লোকদের ইজমা হয়েছে যে, প্রকৃত অর্থেই আল্লাহ তাআলা আরশে সমুন্নত হয়েছেন; রূপক অর্থে নয়।

অতঃপর আবু উমার উক্ত কিতাবে বলেনঃ আহলে সুন্নাতের মুসলিমগণ আল্লাহ তাআলার বাণীঃوَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন, তোমরা যেখানেই থাকো’’-এই আয়াত এবং অনুরূপ অন্যান্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ এখানে আল্লাহর ইল্ম উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান।[6] আর আল্লাহ তাআলা স্বীয় সত্তায় আরশের উপরে। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। তালমানকী স্বীয় কিতাবে এই শব্দগুলোই উল্লেখ করেছেন।

ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে, সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এই কথাকে অস্বীকার করেছে বলে জানা যাচ্ছে সে হচ্ছে জা’দ বিন দিরহাম। এভাবেই সে আল্লাহর সকল সিফাতকেই অস্বীকার করেছে। এ কারণেই ইরাকের তৎকালীন আমীর খালেদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কুসারী তাকে হত্যা করেন। তার হত্যা কান্ডের ঘটনা খুবই প্রসিদ্ধ।[7] জা’দ বিন দিরহাম থেকে এই মতবাদ গ্রহণ করে জাহমীয়াদের ইমাম জাহ্ম বিন সাফওয়ান। সে এই মতবাদের প্রচার শুরু করে এবং বিভিন্ন সংশয়পূর্ণ কথা দ্বারা দলীল দিতে থাকে। এটি ছিল তাবেয়ীদের যুগের শেষের দিকের ঘটনা। সেই সময়ের ইমামগণ এই মতবাদের কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। তাদের মধ্যে ইমাম আওয়াঈ, ইমাম আবু হানীফা, লাইছ বিন সা’দ, সুফিয়ান ছাওরী, হাম্মাদ বিন যায়েদ, হাম্মাদ বিন সালামা, ইবনুল মুবারক এবং তাদের পরে আগমণকারী হেদায়াতের অন্যান্য ইমামগণ। যেমন ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল এবং আহলে সুন্নাতের বিরাট একটি জামাআত।

ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর অনেক নাম ও সিফাত রয়েছে। কারো জন্য সেগুলো অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা জায়েয নয়। দলীল-প্রমাণ সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি এর বিরোধীতা করবে সে কাফের হয়ে যাবে। তবে তার কাছে দলীল না পৌঁছে থাকলে এবং দলীল-প্রমাণ নাজানার কারণে তার অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে। ইমাম শাফেঈ (রঃ) আরো বলেনঃ আল্লাহ তাআলার এই সিফাতগুলো আমরা সাব্যস্ত করি এবং আল্লাহ্ তাআলার পবিত্র সত্তা হতে তাশবীহ দূর করি অর্থাৎ তাঁর সিফাতগুলোকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনা করিনা কিংবা এ কথা বলিনা যে, তাঁর সিফাতগুলো মানুষের সিফাতের মতই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ

‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরাঃ ১১) ফতহুলবারী থেকে উপরোক্ত কথাগুলো তুলে ধরা হলো।[8]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ

«ما السموات السبع والأرضون السبع في كف الرحمن إلا كحبة خردل في كف أحدكم»

‘‘সাত আসমান ও সাত যমীন আল্লাহ তাআলার হাতের তালুতে তোমাদের কারো হাতে একটা সরিষার দানার মত।[9]

[1] - সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৪৮১১।

[2] - সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ২৭৮২।

[3] - বুখারী, হাদীছ নং- ৪৮১১।

[4] - সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৪৮১২।

[5] - সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ২৭৮৮।

[6] - অনেক সাহাবী, তাবেঈ এবং পরবর্তী যুগের অনেক আলেম এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। তবে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তাআলা প্রকৃত পক্ষেই আমাদের সাথে এবং প্রকৃতপক্ষেই তিনি আমাদের উপরে। যেসব আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মাখলুকের সাথে তার সকল ক্ষেত্রেই তিনি সাথে থাকার ব্যাখ্যা ইলম ও কুদরত দ্বারা করাকে সমর্থন করেন নি। উপরে থাকা এবং সৃষ্টির সাথে ও নিকটে থাকাকে তিনি পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে করেন নি। তাই তিনি বলেছেন, তিনি প্রকৃতপক্ষেই আমাদের সাথে এবং প্রকৃতপক্ষেই আমাদের উপরে। সাথে থাকা ও নিকটে থাকার অর্থ এই নয় যে, তিনি কোনো সৃষ্টির মধ্যে ঢুকে আছেন কিংবা মিশে আছেন। যেমন ধারণা করে থাকে সুফী তরীকার বিভিন্ন সম্প্রদায়। এমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে মোটেই শোভনীয় নয়। উপরে থাকা ও সাথে থাকা পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কেননা স্রষ্টার সিফাতকে সৃষ্টির সিফাতের সাথে তুলনা করা চলেনা। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যান্য আলেমগণ সাথে থাকাকে ইলম ও কুদরত দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। আর যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের সাথে রয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে সাথে থাকা দ্বারা সাহায্য-সহযোগিতা, সমর্থন ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে সাথে থাকা উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যাও প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের সাথে থাকা এবং উপরে থাকার পরিপন্থী নয়।

আরেকটি কথা বিশেষভাবে জেনে রাখতে হবে যে, স্বীয় সত্তাসহ আল্লাহ তাআলা আরশে আযীমের উপর রয়েছেন। কুরআন-সুন্নাহর বহু দলীল, সালাফদের ইজমা এবং সৃষ্টিগত স্বভাব সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা এটি সাব্যস্ত। সেই সঙ্গে আরো বিশ্বাস রাখা আবশ্যক যে, সত্তাসহ সমস্ত মাখলুকের সাথে থাকা তাঁর বড়ত্ব, মর্যাদা ও পবিত্রতার জন্য অশোভনীয়। বিস্তারিত জানার জন্য শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর কিতাব আল-ওয়াসেতীয়া এবং উহার ব্যাখ্যাসমূহ পাঠ করার অনুরোধ রইল।

[7] - জা’দ বিন দিরহাম ছিল তাবেয়ীদের যুগের একজন গোমরাহ এবং বিদআতী। তার আকীদাহ ছিল, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)কে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন নি এবং মুসা (আঃ)এর সাথে কথাও বলেন নি। অর্থাৎ সে আল্লাহ তাআলার কালাম, ভালোবাসা ইত্যাদি সিফাতকে অস্বীকার করেছিল। এমনকি সেই সর্বপ্রথম আরশে আযীমে আল্লাহ তাআলার সমুন্নত হওয়াকেও অস্বীকার করেছিল এবং প্রকাশ্যে তার ঘোষণাও দিয়েছিল।

সে সময় ইরাকের আমীর ছিলেন খালেদ বিন আব্দুল্লাহ আল কুসারী। তিনি একবার ঈদুল আযহার নামায শেষে খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে লোক সকল তোমরা কুরবানী করো। আল্লাহ তাআলা তোমাদের কুরবানীকে কবুল করুন। আমি জা’দ বিন দিরহামকে কুরবানী করার মাধ্যমেই আমার কুরবানী শুরু করবো। এই বলে তিনি মিম্বার থেকে নামলেন এবং সকলের সামনেই জা’দ বিন দিরহামকে হত্যা করে ফেললেন।

[8] - দেখুনঃ ফতহুলবারী, (১৩/৪০৭)

[9] - সহীহ হাদীছে يد الله (আল্লাহর হাত), كف الله (আল্লাহর হাতের তালু), كف الرحمن (রাহমানের হাতের তালু) এবং আল্লাহ তাআলার সিফাত সংক্রান্ত ইত্যাদি আরো অনেক বিষয়ই বর্ণিত হয়েছে। এ জাতিয় বিষয়ে ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেনঃ অনেক আলেম আল্লাহর সিফাত সম্পর্কিত হাদীছগুলো এবং দুনিয়ার আসমানে আল্লাহ তাআলার নেমে আসা সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো সুসাব্যস্তও সুপ্রমাণিত বলেছেন। আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, কোন প্রকার ধারণা করা যাবেনা এবং এ কথা বলা যাবেনা যে, كيف؟ (তা কেমন?)। ইমাম মালেক, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রঃ) থেকে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীছগুলোর ব্যাপারে কথা হচ্ছে أمروها بلا كيف অর্থাৎ যেভাবে এসেছে, সেভাবেই ছেড়ে দাও। এ কথা বলোনা যে, কেমন-কিভাবে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের কথাও তাই।

কিন্তু জাহমীয়ারা এই বর্ণনাগুলোকে অস্বীকার করেছে। তাদের কথা হচ্ছে এগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ (তুলনা) হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় আল্লাহর হাত, চোখ, শ্রবণ, দৃষ্টি ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। জাহমীয়ারা এই আয়াতগুলোর তাবীল (ব্যাখ্যা) করেছে। আলেমগণ এগুলোর যেই ব্যাখ্যা করেছেন, তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছে। তাদের কথা আল্লাহ তাআলা আদমকে স্বীয় হাত দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। তাদের কথা হচ্ছে হাত অর্থ কুদরত (শক্তি)!! ইসহাক বিন ইবরাহীম বলেনঃ তাশবীহ (তুলনা) তখনই হবে, যখন বলা হবে আল্লাহর হাত মাখলুকের হাতের মতই, আল্লাহর হাত বান্দার হাতের মতই। এমনি আল্লাহর শ্রবণ, আল্লাহর দৃষ্টি বান্দার দৃষ্টির মতই। এটি তাশবীহ।

আর আল্লাহ যেমন বলেছেন যখন সেভাবেই বলা হবে অর্থাৎ হাত, শ্রবণ, দৃষ্টি এবং এই প্রশ্ন করা হবেনা যে, তা কিভাবে? অথবা এটি বলা হবেনা যে, আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মতই এবং শ্রবণ শ্রবণের মতই, তখন কোন তাশবীহ হবেনা। তখন তেমনই হবে যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ

‘‘কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরাঃ ১১) {দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, (৬/২০) ঈষৎ পরিবর্তিত)}