ব্যাখ্যাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহীদের চার দেয়ালকে ঐ সমস্ত কথা ও কর্ম থেকে হেফাজত করেছেন, যা বান্দার তাওহীদকে দূষিত করে ফেলে এবং তাওহীদের সাথে যে সমস্ত কথা ও কাজ মিশ্রিত হলে তাওহীদ দুর্বল হয়ে যায় অথবা তা নষ্ট হয়ে যায়। যে সমস্ত বিষয় বান্দার তাওহীদকে কলুষিত করে ফেলে তার অধিকাংশই এই সংক্ষিপ্ত কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই সাথে এই কিতাবে ঐ সমস্ত কথা ও কাজ থেকে নিষেধ করা হয়েছে, যা তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী অথবা যা বান্দার তাওহীদকে দুর্বল করে দেয়। যে ব্যক্তি এই কিতাবের প্রত্যেকটি অধ্যায় গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঠ করবে এবং তাতে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে তা ভালভাবেই বুঝতে সক্ষম হবে।
আব্দুল্লাহ বিন শিখ্খির রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একবার বনী আমেরের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গেলাম। তখন আমরা বললামঃ
«أَنْتَ سَيِّدُنَا فَقَالَ السَّيِّدُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى» قُلْنَا وَأَفْضَلُنَا فَضْلاً وَأَعْظَمُنَا طَوْلاً فَقَالَ قُولُوا بِقَوْلِكُمْ أَوْ بَعْضِ قَوْلِكُمْ وَلاَ يَسْتَجْرِيَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ»
‘‘আপনি আমাদের সায়্যেদ! মনিব, প্রভু তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন একমাত্র সায়্যেদ! (নেতা, প্রভু) আমরা বললামঃ আমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমাদের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। এরপর তিনি বললেনঃ তোমরা তোমাদের এ সব কথা অথবা এগুলো থেকে কতিপয় কথা বলে যাও। তবে শয়তান যেন তোমাদেরকে তার বশীভুত করতে না পারে। ইমাম আবু দাউদ এই হাদীছকে ভাল সনদে বর্ণনা করেছেন’’।[1]
আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, কতিপয় লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বললো, হে আল্লাহর রাসূল, হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি! হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তির পুত্র! হে আমাদের সাইয়্যেদ (নেতা বা প্রভু)! হে আমাদের নেতার পুত্র! তখন তিনি বললেনঃ
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا بِقَوْلِكُمْ ولاَ يَسْتَهْوِيَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ وَرَسُولُه وَاللَّهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُونِى فَوْقَ فَوْقَ مَنْزِلَتِي الَّتِي أَنْزَلَنِي اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ»
‘‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের কথা বলে যাও। এমন যেন না হয় যে, শয়তান তোমাদেরকে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত ও বিভ্রান্ত করে ফেলবে এবং পরিণামে তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি শুরু করে দিবে। আমি মুহাম্মদ, আল্লাহর বান্দা এবং তার রাসূল। আল্লাহর শপথ! আমি পছন্দ করিনা যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে যে মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন, তোমরা আমাকে তার উপরে উঠাবে। ইমাম নাসায়ী ভালো সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ব্যাখ্যাঃ উপরের হাদীছে এভাবে প্রশংসা করাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপছন্দ করেছেন। যাতে করে কেউ উক্ত কথাগুলোকে তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি এবং তাঁর অতিরিক্ত প্রশংসা করার মাধ্যম না বানাতে পারে। যেমন ইতিপূর্বে ১৮ নং অধ্যায়ে বিষয়টি অতিক্রান্ত হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ»
‘‘তোমরা আমার অতিরিক্ত প্রশংসা করোনা। যেমন প্রশংসা করেছিল নাসারারা মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আঃ)এর। আমি কেবল আল্লাহ তাআলার একজন বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তাঁরই রাসূল বলবে’’।[2]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, তাঁর উম্মতের জন্য সর্বোত্তম নসীহত পেশ করেছেন এবং তিনি যে তার উম্মতের উপর খুব দয়াবান ছিলেন- এসব হাদীছ থেকে সুস্পষ্টরূপে তাই বুঝা যাচ্ছে। তিনি উম্মতকে ঐ সমস্ত বিষয় হতে সাবধান করেছেন, যা তাদেরকে তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ وَرَسُولُهُ আমি মুহাম্মদ, আল্লাহর বান্দা এবং তার রাসূলঃ এ দু’টিই হচ্ছে বান্দার সর্বোচ্চ মর্যাদা। আল্লাহর খাস বান্দা হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ হতে রেসালাতের দায়িত্ব পাওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উভয়টিই পূর্ণ অবস্থায় পেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর উপর দুরূদ পেশ করেন। তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উম্মতকেও আদেশ দিয়েছেন, তারাও যেন তাদের নবীর উপর দুরূদ পাঠ করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর সর্বোত্তম ও পূর্ণাঙ্গ প্রশংসা করেছেন, তাঁর বক্ষকে প্রশস্ত করেছেন, তাঁর উপর থেকে সকল বোঝা সরিয়ে দিয়েছেন এবং দুনিয়াতে তাঁর নামকে সমুন্নত করেছেন। যখন, একামত, নামাযের তাশাহুদ এবং যখনই আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়, তখনই তাঁর সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নামও উল্লেখ করা হয়। আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর উপর সালাত ও সাল্লাম বর্ষিত হোক।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জন্য سيد (নেতা, প্রভু) শব্দ ব্যবহার করার ব্যাপারে আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) بدائع الفوائد নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের জন্য سيد শব্দটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। একদল আলেম বলেছেনঃ মানুষের জন্য এটি ব্যবহার করা বৈধ নয়। ইমাম মালেক (রঃ) থেকেও অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। তাঁকে উদ্দেশ্য করে যখন বলা হলোঃ أَنْت سيدنا আপনি আমাদের নেতা বা প্রভু, তখন তিনি বলেছেনঃ السيد الله সাইয়্যেদ (নেতা-প্রভু) হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা।
আরেকদল আলেম আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য সাইয়্যেদ শব্দটি ব্যবহার করা জায়েয বলেছেন। তারাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। আনসারদের নেতা যখন সা’দ বিন মুআয আগমণ করলেন, তখন তিনি বলেছিলেনঃ«قُومُوا إِلَى سَيِّدِكُمْ» ‘‘তোমাদের সাইয়্যেদের (নেতার) জন্য দাঁড়াও’’।[3] এই হাদীছটি প্রথম হাদীছের চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ।
এই শ্রেণীর আলেমগণ বলেনঃ সাইয়্যেদ শব্দটিকে কোন কিছুর দিকে সম্বন্ধ হয় এবং যার বা যাদের দিকে ‘সাইয়্যেদ’কে সম্বন্ধ করা হয় সে তাদেরই একজন হয়। সুতরাং তামীম গোত্রের কাউকে سيد كنده অর্থাৎ কেন্দাহ গোত্রের নেতা বলা যাবেনা এবং কোন বাদশাহকে سيد البشر বলা যাবেনা। কেননা সে সকল জাতির বাদশাহ নয়।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম বলেনঃ এ জন্যই আল্লাহর জন্য সাইয়্যেদ নামটি ব্যবহার করা যাবেনা।
ব্যাখাকার বলেনঃ এই বিশ্লেষণের মধ্যে চিন্তার বিষয় রয়েছে। কেননা যখন আল্লাহ তাআলার জন্য السيد শব্দটিকে ব্যবহার করা হবে, তখন শব্দটিকে المَلِك -الرَّبُّ -المَوْلَى অর্থাৎ মালিক (বাদশাহ), রব (প্রভু) মাওলা (অভিভাবক)এর স্থলাভিষিক্ত গণ্য করা হবে। তবে এই শব্দটি আল্লাহ তাআলার জন্য ঐ অর্থে ব্যবহৃত হবেনা, যেই অর্থে ব্যবহৃত হয় সৃষ্টির জন্য।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সূরা ইখলাসের ২ নং আয়াত অর্থাৎ الله الصمد এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা এমন السيد (নেতা), যার মধ্যে নেতৃত্বের সকল গুণ পরিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আবু ওয়ায়িল বলেনঃ আল্লাহ এমন সাইয়্যেদ, যার মধ্যে সরদারীর সর্বোচ্চ গুণাবলী বিদ্যমান। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হতে মানুষকে সাবধান করা হয়েছে।
২) কাউকে সম্বোধন করে أنت سيدنا ‘আপনি আমাদের নেতা বা প্রভূ কিংবা মনিব’ বলে সম্বোধন করা হলে তার জবাবে কি বলা উচিৎ, এখানে তা শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
৩) লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করে কিছু কথা বলার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘শয়তান যেন তোমাদেরকে বাড়াবাড়ির দিকে নিয়ে না যায়’’। অথচ তারা তাঁর ব্যাপারে হক কথাই বলেছিল। এর তাৎপর্য অনুধাবন করা উচিত।
৪) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ ما أحب أن ترفعونى فوق منـزلتى অর্থাৎ তোমরা আমাকে স্বীয় মর্যাদার উপরে স্থান দাও এটা আমি পছন্দ করিনা। এ কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করা জরুরী।
[2] - বুখারী ও মুসলিম। অধ্যায়ঃ আল্লাহর বাণীঃ আপনি কিতাবে মারইয়ামের কথা স্মরণ করুন।
[3] - সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৩০৪৩।