আল্লাহ তাআলার প্রতি মন্দ ধারণা করা কাফের ও মুনাফেকদের অভ্যাস

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

يَظُنُّونَ بِاللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ يُخْفُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ مَا لَا يُبْدُونَ لَكَ يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ وَلِيَبْتَلِيَ اللَّهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحِّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ

‘‘তারা জাহেলী যুগের ধারণার মত আল্লাহ সম্পর্কে অসত্য ধারণা পোষণ করে। তারা বলেঃ আমাদের জন্য কিছু করণীয় আছে কি? হে রাসূল! তুমি বলে দাওঃ সব বিষয়ই আল্লাহর হাতে। তারা তাদের মনের মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে রাখে, যা তোমার নিকট প্রকাশ করেনা। তারা বলে আমাদের যদি কিছু করার থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতামনা। তুমি বলোঃ তোমরা যদি নিজেদের ঘরে থাকতে তাহলেও যাদের মৃত্যু লিখে দেয়া হয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতো। আর যে বিষয়টি সংঘটিত হলো তা এ জন্য যে, তোমাদের বুকে যা কিছু গোপন রয়েছে, আল্লাহ তাআলা তা পরীক্ষা করে নেবেন আর তোমাদের অন্তরে যে দোষ-ত্রুটি রয়েছে তা পরিষ্কার করবেন। আল্লাহ্ মনের অবস্থা খুব ভাল করে জানেন’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৫৪)

ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্ তাআলা উহুদ যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করার ধারাবাহিকতায় এই আয়াতটি নাযিল করেছেন। আয়াতের শুরুতে আরেকটু রয়ে গেছে। তা হচ্ছে,

ثُمَّ أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُعَاسًا يَغْشَى طَائِفَةً مِنْكُمْ وَطَائِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنْفُسُهُمْ

‘‘অতঃপর তোমাদের উপর শোকের পর শান্তি অবতীর্ণ করলেন, যা ছিল তন্দ্রার মত। যা তোমাদের একদল লোককে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিল। কিন্তু আরেকটি দল নিজেদের প্রাণের ভয়ে আতঙ্কিত ও ব্যতিব্যস্ত ছিল। যে দলটিকে তন্দ্রা দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়েছিল, তারা ছিলেন ঈমানদার, সত্যের উপর সুদৃঢ় এবং পুরোপুরি আল্লাহর উপর ভরসাকারী। তাদের পূর্ণ ইয়াকীন ছিল যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে অবশ্যই সাহায্য করবেন এবং তাঁর আশা-আকাঙ্খা অবশ্যই পূর্ণ করবেন। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ আরেকটি দল নিজেদের প্রাণের ভয়ে আতঙ্কিত ও ব্যতিব্যস্ত ছিল। উৎকণ্ঠা, অধৈর্যতা এবং ভয়ের কারণে তাদেরকে তন্দ্রা আচ্ছাদিত করেনি। তারা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে নানা রকম জাহেলী অসত্য ধারণা পোষণ করতে লাগল। যেমন আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতাহ-এর ১২ নং আয়াতে বলেনঃ

بَلْ ظَنَنْتُمْ أَنْ لَنْ يَنْقَلِبَ الرَّسُولُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلَى أَهْلِيهِمْ أَبَدًا وَزُيِّنَ ذَلِكَ فِي قُلُوبِكُمْ وَظَنَنْتُمْ ظَنَّ السَّوْءِ وَكُنْتُمْ قَوْمًا بُورًا

‘‘বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, রাসূল ও মুমিনগণ তাদের বাড়ী-ঘরে কিছুতেই ফিরে আসতে পারবেনা এবং এই ধারণা তোমাদের জন্য খুবই সুখকর ছিল। তোমরা খুব মন্দ ধারণার বশবর্তী হয়েছিলে। তোমরা ছিলে ধ্বংসমূখী এক সম্প্রদায়’’।

অনুরূপ যখন মুশরিকরা ঐ সময় বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিজয়ী হয়েছিল, তখন মুনাফেকরা ধারণা করেছিল যে, এই তো চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গেছে। ইসলাম ও মুসলিমগণ খতম হয়ে গেছে। দ্বীনের মধ্যে সন্দেহ ও দ্বিধাগ্রস্ত লোকদের অবস্থা এ রকমই। যখন উহুদ যুদ্ধের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন তাদের মন-মস্তিষ্কে ঐ ধরণের নিকৃষ্ট খেয়াল ও কল্পনা প্রবেশ করে।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তাদের এই ধারণাকে মন্দ ধারণা হিসাবে ব্যাখ্যা করার কারণ হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শানে তাদের এই ধারণা ছিল অশোভনীয়। তারা ধারণা করেছিল যে, আল্লাহর রাসূলকে সাহায্য করা হবেনা এবং ইসলামের আলো অচিরেই মিটে যাবে। তাদের মন্দ ধারণাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তারা ধারণা করেছিল উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিমগণ যেই পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তারা যে কষ্ট পেয়েছিলেন, তা আল্লাহর নির্ধারণ, আল্লাহর হিকমত ও ফয়সালা অনুযায়ী ছিলনা। সুতরাং তাদের ধারণায় আল্লাহ তাআলার হিকমত ও তাকদীরকে অস্বীকার করা হয়েছে। সেই সাথে তাদের ধারণায় আল্লাহর রাসূলের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করা এবং তাঁর দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর বিজয় দান করার বিষয়টিরও অস্বীকৃতি ছিল।

এটিই ছিল সেই খারাপ ধারণা, যা করেছিল মদীনার মুনাফেক সম্প্রদায় এবং মক্কার মুশরিক দল। পবিত্র কুরআনের সূরা ফাতাহএর মধ্যে তাদের এই ধারণার আলোচনা করা হয়েছে। এই ধারণা মন্দ হওয়ার কারণ হলো, তা আল্লাহ্ তাআলার শান ও সুমহান মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূণ ছিলনা। উক্ত ধারণা ছিল আল্লাহর হিকমত, আল্লাহর প্রশংসা এবং তাঁর সত্য ওয়াদার পরিপন্থী, বেমানান এবং অসংগতিপূর্ণ।

সুতরাং যে ধারণা করবে যে, আল্লাহ তাআলা সবসময় সত্যের উপর বাতিলকে বিজয়ী রাখবেন, সত্য বাতিলের সামনে দুর্বল হয়ে থাকবে এবং এরপর সত্য কখনই মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবেনা, সে অবশ্যই আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণা করল। সে আল্লাহর সাথে এমন বিষয়কে সম্পৃক্ত করল, যা আল্লাহর সিফাতে কামালিয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে ব্যক্তি ঐ ধরণের কোনো কর্মে তাকদীরে ইলাহীকে অস্বীকার করল, সে আল্লাহর ক্ষমতা ও রাজত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর যেসব লোক আল্লাহর সেই হিকমতকে অস্বীকার করল, যার কারণে তিনি প্রশংসার হকদার এবং এই ধারণা পোষণ করল যে, উহুদের যুদ্ধে আল্লাহ্ মুমিনদেরকে পরাজিত করতে চেয়েছেন বলেই তা করেছেন, এর পিছনে অন্য কোন হিকমত নিহিত নেই, তারা কাফেরদের ন্যায়ই ধারণা করল। আর কাফেরদের জন্যই রয়েছে ধ্বংস ও জাহান্নাম।

অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। বিশেষ করে ঐ সমস্ত বিষয়ে, যা তাদের নিজেদের সাথে সম্পৃক্ত অথবা যা অন্যদের সাথে সম্পৃক্ত। যারা আল্লাহর পবিত্র সত্তা, তাঁর পবিত্র নামসমূহ, তাঁর ত্রুটিমুক্ত সিফাতসমূহ এবং তাঁর হিকমত সম্পর্কে ও তিনি যে যথাযথ প্রশংসার হকদার- এ সম্পর্কে অবগত, তারাই কেবল তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

সুতরাং যে ব্যক্তি জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং নিজের কল্যাণকামী তার উচিত এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রভুর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করে, সে যেন আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণার কারণে তাঁর কাছে তাওবা করে এবং ক্ষমা চায়।

হে প্রিয় পাঠক! আপনি মানুষদের মাঝে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখতে পারেন। দেখবেন অনেক মানুষই তাকদীরের উপর অসন্তুষ্ট এবং তাকদীরকে দোষারোপকারী। তারা বলে থাকে এ রকম হওয়া উচিত ছিলনা, এমন হওয়া ঠিক ছিলনা। এ রকম অভিযোগ কেউ কম করে আবার কেউ বেশী করে। আপনি আপনার নিজের মধ্যেই অনুসন্ধান করুন। আপনি কি তাকদীরকে দোষারোপ করা হতে মুক্ত? কবি বলেছেনঃ

فإن تنجُ منها تنجُ من ذي عظيمة + وإلا فإني لا إخالك ناجيا

‘‘হে বন্ধু! তুমি যদি তাকদীরের উপর আপত্তি করা থেকে মুক্ত হয়ে থাক তাহলে জেনে রাখো যে, তুমি একটি বিরাট মসীবত থেকে বেঁচে গেলে। আর এ থেকে মুক্তি না পেলে তুমি নাজাত পাবে বলে আমার মনে হয়না।

ব্যাখ্যাঃ লেখক মন্দ ধারণার ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়্যিমের উপরোক্ত দীর্ঘ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট বলে ব্যাখ্যাকার অতিরিক্ত কোন ব্যাখ্যা করেন নি।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ

‘‘তারা আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে, তারা নিজেরাই খারাপ ও দোষের আবর্তে নিপতিত’’। (সূরা আল-ফাতাহঃ ৬)

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) স্বীয় তাফসীরে আল্লাহ তাআলার এই বাণীর ব্যাখ্যায় বলেনঃ

وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا

‘‘আর যেসব মুনাফেক নারী ও পুরুষ এবং মুশরিক নারী ও পুরুষ আল্লাহ্ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষন করে তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন। তারা নিজেরই অকল্যাণের চক্রে পড়ে গিয়েছে। আল্লাহর গযব পড়েছে তাদের উপর, তিনি তাদেরকে লা’নত করেছেন এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত রেখেছেন। তাদের প্রত্যাবর্তন স্থল অত্যন্ত মন্দ’’। (সূরা ফাতাহঃ ৬) অর্থাৎ তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছিল আল্লাহ তোমাকে এবং তোমার প্রতি ঈমান আনয়নকারীদেরকে তোমার শত্রুদের উপর কখনও বিজয় দান করবেন না। আর তোমার দ্বীনকে বিজয়ী করে তাকে তোমার প্রতি কুফরীকারীদের দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিতও করবেন না। উহাই ছিল তাদের ধারণাসমূহ থেকে একটি খারাপ ধারণা। আল্লাহ তাআলা এই স্থানে তা উল্লেখ করেছেন।

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তারা আল্লাহ তাআলার ফয়সালা ও হুকুমে আল্লাহর উপর অভিযোগ করে। আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের ব্যাপারে এই ধারণা পোষণ করে যে, তারা নিহত হবেন এবং দুনিয়া থেকে তাদের নাম-নিশানা মিটে যাবে। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেনঃ যারা আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং রাসূলের সাহাবীদের ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করে, তাদের নিজেদের উপর মসীবত নাযিল হবে। এই অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) সূরা আল- ইমরানের ১৫৪ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।

২) সূরা ‘‘ফাতাহ’’-এর ৬ নং আয়াতের তাফসীরও জানা গেল।

৩) আলোচিত বিষয়ের প্রকার সীমাবদ্ধ নয়। অর্থাৎ মন্দ ধারণার অনেক প্রকার রয়েছে।

৪) যে ব্যক্তি আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ সিফাতগুলো এবং নিজের নফ্স সম্পর্কে অজ্ঞ রয়েছে, সেই কেবল আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা পোষণ করা থেকে বাঁচতে পারে।