আল্লাহ তাআলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেনঃ
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘আর আল্লাহ্র জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাকো। আর যারা তার নামগুলো বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করে চলো। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।
ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) এই অধ্যায়ের মাধ্যমে ঐ সমস্ত লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যারা মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তা ও সম্মানকে নিজেদের উসীলা বানায়। অথচ আল্লাহর অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুণাবলী এবং নেক আমলের উসীলা ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের উসীলা দেয়া বৈধ নয়।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ وهو وتر يحب الوترَ»
‘‘আল্লাহর এমন নিরানববইটি নাম রয়েছে যে ব্যক্তি এগুলো আয়ত্ত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি এক সংখ্যায় বে-জোড় এবং বে-জোড়কে পছন্দ করেন’’। ইমাম বুখারী ও মুসলিম সুফিয়ান হতে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[1]
ইমাম তিরমিযী স্বীয় কিতাবে ওয়ালীদ বিন মুসলিম শুআইবের সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তিনি يحب الوتر এর পর আল্লাহর নিম্নলিখিত অতি সুন্দর নামগুলো বর্ণনা করেছেনঃ
هُوَ اللَّهُ الَّذِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ তিনিই আললাহ, যিনি ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই, الرَّحْمَنُ পরম দয়ালু, الرَّحِيمُ পরম করুণাময়, الْمَلِكُ বাদশাহ, الْقُدُّوسُ মহা পবিত্র, السَّلاَمُ শান্তির আধার, الْمُؤْمِنُ নিরাপত্তা দানকারী, الْمُهَيْمِنُ মহা সংরক্ষণকারী, الْعَزِيز মহা পরাক্রমশালী,الْجَبَّارُ প্রভাব ও প্রতাপশালী, الْمُتَكَبِّرُ মহা গৌরবান্বিত, الْخَالِقُ স্রষ্টা, الْبَارِئُ সৃষ্টিকর্তা, الْمُصَوِّرُ আকৃতি দানকারী, الْغَفَّارُ অত্যাধিক ক্ষমাকারী, الْقَهَّارُ পরাজিতকারী, الْوَهَّابُ মহান দাতা, الرَّزَّاقُ রিযিক দানকারী, الْفَتَّاحُ উন্মোচনকারী, الْعَلِيمُ মহাজ্ঞানী, الْقَابِضُ الْبَاسِطُ সংকীর্ণকারী ও সম্প্রসারণকারী, الْخَافِضُ الرَّافِع নীচুকারী ও উন্নতকারী, الْمُعِزُّ الْمُذِلُّ সম্মান দানকারী এবং অপদস্তকারী, السَّمِيعُ সর্বশ্রোতা, الْبَصِيرُ সর্বদ্রষ্টা, الْحَكَمُ ফয়সালাকারী, الْعَدْلُ ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী, اللَّطِيفُ দয়ালু, الْخَبِيرُ মহা সংবাদ সংরক্ষক, الْحَلِيمُ পরম সহিঞু, الْعَظِيمُ সুমহান, الْغَفُورُ অত্যধিক ক্ষমাশীল, الشَّكُورُ মহা মূল্যায়নকারী, الْعَلِىُّ সুউচ্চ, الْكَبِيرُ অতিব মহান, الْحَفِيظُ হেফাজতকারী, الْمُقِيتُ রুজী দানকারী, الْحَسِيبُ যথেষ্ট, الْجَلِيلُ বড়ত্বের অধিকারী, الْكَرِيمُ মহা অনুগ্রহশীল, الرَّقِيبُ মহা পর্যবেক্ষক, الْمُجِيب কবুলকারী, الْوَاسِعُ প্রশস্তকারী, الْحَكِيمُ প্রজ্ঞাবান, الْوَدُودُ ভালবাসা পোষণকারী, الْمَجِيدُ মর্যাদাবান, الْبَاعِثُ পুনরুত্থানকারী, الشَّهِيدُ সাক্ষ্যদানকারী, الْحَقّ মহা সত্য, الوَكِيْلُ কর্ম সম্পাদনকারী, الْقَوِىُّ শক্তিমান, الْمَتِينُ মহা শক্তিধর, الْوَلِىُّ মহা অভিভাবক, الْحَمِيدُ মহা প্রশংসিত, الْمُحْصِى গণনা ও সংরক্ষণকারী, الْمُبْدِئُ প্রথম সৃষ্টিকারী, الْمُعِيدُ দ্বিতীয়বার সৃষ্টিকারী, الْمُحْيِى জীবন দানকারী, الْمُمِيتُ মৃত্যু দানকারী, الْحَىّ الْقَيُّومُُ চিরঞ্জী, চিরস্থায়ী ও সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিষ্ঠাকারী, الْوَاجِد ُসর্বপ্রাপক, الْمَاجِدُ মহিমান্বিত, الْوَاحِدُ الأحَدُ একক ও অদ্বিতীয়, الصَّمَدُ অমূখাপেক্ষী, الْقَادِرُ ক্ষমতাবান, الْمُقْتَدِرُ মহা ক্ষমতাবান, الْمُقَدِّمُ অগ্রসরকারী, الْمُؤَخِّرُ পশ্চাৎকারী, الأَوَّلُ সর্বপ্রথম, الآخِرُসর্বশেষ, الظَّاهِرُ প্রকাশ্য, الْبَاطِنُ অপ্রকাশ্য, الْوَالِى মালিক, الْمُتَعَالِى সুমহান, الْبَرُّ মহা অনুগ্রহকারী, التَّوَّابُ তাওবা কবুলকারী, الْمُنْتَقِمُ প্রতিশোধ গ্রহণকারী, الْعَفُوُّ ক্ষমাশীল, الرَّءُوف দয়াবান, مَالِكُ الْمُلْكِ রাজাধিরাজ, الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ ذُو মহিমাময় ও মহানুভব, الْمُقْسِطُ ইনসাফকারী, الْجَامِعُ একত্রকারী, الْغَنِىُّ ঐশ্বর্যশালী, الْمُغْنِى অভাব দূরকারী, المعطي الْمَانِعُ দানকারী ও বারণকারী, الضَّارُّ النَّافِعُ অকল্যাণ ও কল্যাণকারী, النُّورُ আলো, আলো দানকারী, الْهَادِى হেদায়াতকারী, الْبَدِيعُ পূর্ব নমুনা ছাড়াই সৃষ্টিকারী, الْبَاقِى চিরস্থায়ী, الْوَارِثُউত্তরাধিকারী, الرَّشِيدُ সঠিক পথ প্রদর্শনকারী, الصَّبُورُপরম ধৈর্যশীল, অতঃপর ইমাম তিরমিজী (রঃ) বলেনঃ এই হাদীছ ব্যতীত অনেক বর্ণনাতেই আল্লাহর নামসমূহের আলোচনা আছে বলে জানিনা।[2]
হাদীছের কতিপয় হাফেয বলেনঃ এই হাদীছে আল্লাহর নামগুলো মুদরাজ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো রাবীর পক্ষ হতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি। আল্লামা ইবনে কাছীর (রঃ) স্বীয় তাফসীরে এই কথা বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর নামসমূহ নিরানববইএর মধ্যে সীমিত নয়। এর দলীল হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঐ হাদীছ, যা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বর্ণনা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ বান্দা যখন দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে এই দুআটি পাঠ করবেঃ
«اللَّهُمَّ إنِّى عَبْدُكَ ابنُ عَبْدِكَ ابنُ أمتِكَ ناصِيَتى بيَدِكَ مَاضٍ فِىَّ حُكْمُكَ عَدْلٌْ فىَّ قضاؤكَ أَسْأَلُكَ أللَّهُمَّ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي ونُورَ صَدْرى وجِلاءَ حُزنى وذَهَابَ هَمِّى إلا أذْهَبَ اللهُ حُزْنَه وهَمَّهُ وأبْدَلَهُ مكانَهُ فرحاً»
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার বান্দা। আমি তোমার এক বান্দা ও এক বান্দীর পুত্র। আমার কপাল তোমার হাতে। আমার ব্যাপারে তোমার হুকুম কার্যকর। আমার ব্যাপারে তোমার ফয়সালা ইনসাফপূর্ণ। আমি তোমার সেই প্রত্যেক নামের উসীলা দিয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, যে নামের মাধ্যমে তুমি নিজের নামকরণ করেছ বা তোমার কিতাবে অবতীর্ণ করেছ বা তোমার কোনো বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছো অথবা যে নামগুলোকে তুমি নিজের জ্ঞান ভান্ডারে সংরক্ষিত করে রেখেছ, কুরআনকে আমার অন্তরের প্রশান্তি, বক্ষের নূর, দুঃশ্চিন্তা বিদূরিত হওয়ার মাধ্যম বানিয়ে দাও। যে ব্যক্তি এই দুআ পাঠ করবে, আল্লাহ্ তাআলা তার দুঃশ্চিন্তা দূর করে আনন্দ ও খুশীর দ্বারা সেই স্থানকে পরিপূর্ণ করে দিবেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি এটি শিখে নিবোনা? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, যে ব্যক্তি তা শুনবে, সে যেন তা শিখে নেয়’’। আবু হাতিম ইবনে হিববান স্বীয় ‘কিতাবুস্ সহীহতে’ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[3]
ইবনে আবি হাতিম ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, يلحدون فى أسمائه অর্থাৎ তারা তাঁর নামগুলো বিকৃত করে। এর অর্থ হচ্ছে তারা শির্ক করে।
ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে, মুশরিকরা ‘ইলাহ’ থেকে ‘লাত’ আর ‘আযীয’ থেকে ‘উযযা’ নামকরণ করেছে।
আ’মাস থেকে বর্ণিত আছে, মুশরিকরা আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে এমন কিছু শির্কী বিষয় ঢুকিয়েছে, যা তাতে নেই।
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলার বাণীঃ
وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘আর যারা তার নামগুলো বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করে চলো। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কাতাদাহ (রঃ) বলেনঃ অর্থাৎ তারা শির্ক করে। ইবনে আবী তালহা আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, إلحاد (ইলহাদ) অর্থ تكذيب তথা অস্বীকার করা।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, শির্ক হচ্ছে মুশরিকদের ঐসব বিষয় অস্বীকার করার নাম, যা আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে নাযিল করেছেন এবং যা দিয়ে তিনি তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন। যেমন করেছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের সাথে কুরাইশ সম্প্রদায় এবং অন্যান্য লোকেরা। এই উম্মতের মুশরিকদেরও একই অবস্থা। তারা শির্ক হারাম হওয়া সম্পর্কে এবং শির্ক হতে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত সুস্পষ্ট আয়াতগুলো গ্রহণ করেনি; বরং প্রমাণিত সত্যকে তারা মিথ্যা বলছে এবং অস্বীকার করছে। তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করেছে।
আরবদের ভাষায় ইলহাদের মূল অর্থ হচ্ছে, মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যাওয়া এবং সঠিক পথ হতে অন্য দিকে ঝুকে পড়া। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ
وحقيقـة الإلحاد فيها الميل
بالإشراك والتعطيل والنكران
ইলহাদ অর্থ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শির্ক করা বা শির্কের দিকে ঝুঁকে পড়া, তাঁর অতি সুন্দর নামসমূহকে বাতিল করা এবং তাঁর নেয়ামত ও অনুগ্রহসমূহ অস্বীকার করা। আল্লাহ তাআলার রয়েছে অনেক অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী। এসব অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী তাঁর পরিপূর্ণতার প্রমাণ করে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল আলেমের মাজহাব হচ্ছে আল্লাহর জন্য ঐ সমস্ত সিফাত সাব্যস্ত করতে হবে, যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং যার মাধ্যমে তাঁর রাসূল তাঁকে গুণান্বিত করেছেন। কোনো প্রকার উপমা ছাড়াই এবং কোনো সিফাতকে অস্বীকার করা ব্যতীতই এমনভাবে তা আল্লাহর জন্য ছাবেত করতে হবে, যা তাঁর বড়ত্ব ও সম্মানের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
‘‘কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শূরাঃ ১১) এখানে বিশেষভাবে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহর সিফাতের ব্যাপারে কথা বলা আল্লাহর সত্তা নিয়ে কথা বলার শাখা ও অংশ বিশেষ। তাই আল্লাহর যাত নিয়ে কথা বলা আর তাঁর সিফাত নিয়ে কথা বলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ যেমন এটি বিশ্বাস করা জরুরী যে, আল্লাহর এমন এক বিশেষ যাত (সত্তা) রয়েছে, যা কোনো মাখলুকের সত্তার মত নয়, তেমনি তার এমন বিশেষ গুণাবলী রয়েছে, যা কোনো মাখলুকের সিফাতের মত নয়।
সুতরাং আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য যেসব সিফাত সাব্যস্ত করেছেন অথবা আল্লাহর রাসূল যেসব সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, তা থেকে যে ব্যক্তি কোনো কিছুকে অস্বীকার করল অথবা সেই সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাদ দিয়ে অন্য কোনো ব্যাখ্যা করল, সে জাহমীয়া ফির্কার লোক বলে গণ্য হবে এবং সে হবে মুমিনদের সঠিক পথ বাদ দিয়ে অন্য পথের অনুসরণকারী।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ সম্পর্কে যে খবর এসেছে এবং যা আল্লাহর সিফাত হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা কয়েক প্রকারঃ
(১) যা আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন আমরা বলে থাকি আল্লাহর সত্তা আছে। তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে।
(২) যা আল্লাহর সিফাতের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার এমন সিফাত রয়েছে, যার অর্থ বিদ্যমান। যেমন العليم জ্ঞানী, القدير ক্ষমতাবান, السميع সর্বশ্রোতা, البصير সর্বদ্রষ্টা ইত্যাদি।
(৩) আল্লাহ সম্পর্কে এমন বিষয় বলা হয়েছে, যা আল্লাহর কর্মসমূহের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন الخالق সৃষ্টিকর্তা, الرازق রিযিক প্রদানকারী ইত্যাদি।
(৪) আল্লাহ তাআলা সকল দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সেই সাথে পরিপূর্ণ গুণাবলী আল্লাহর জন্য সাব্যস্তও করতে হবে। কেননা শুধু পবিত্র বলার মধ্যে কোনো কামালিয়াত নেই। যেমন القدوس السلام মহা পবিত্র ও শান্তি দাতা।
(৫) আল্লাহ তাআলার এমন অতি সুন্দর নামও সুউচ্চ গুণাবলী রয়েছে, যা অধিকাংশ লোকই উল্লেখ করেন নি। সেগুলো হচ্ছে এমন নাম, যার একটি অনেকগুলো গুণের প্রমাণ বহন করে, নির্দিষ্ট কোনো গুণের সাথে খাস নয়; বরং একাধিক অর্থ প্রকাশ করে। যেমন আল্লাহর المجيد (আলমাজীদ), العظيم (আলআযীম) এবং الصمد (আস্ সামাদ) নামগুলো। কেননা মাজীদ তাকেই বলা হয়, যার মধ্যে অনেকগুলো সিফাতে কামালিয়া পাওয়া যায় এবং المجيد শব্দটি সেই সব সিফাতে কামালিয়ার প্রমাণ বহন করে। এটি প্রশস্ততা, বিশালতা, আধিক্য এবং অতিরিক্ত-এর অর্থ প্রদান করে। এখান থেকেই বলা হয় استمجد المرخ والعفار মারখ ও উফার বৃক্ষ প্রচুর, বিশাল ও বড় হয়েছে। এই কথা ঠিক তখনই বলা হয়, যখন তা প্রচুর হয়, বড় হয় এবং লম্বা হয়। আর বলা হয় أمجد الناقة علفها উটনীর খাদ্য প্রচুর হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ذُو الْعَرْشِ الْمَجِيدُ‘‘মহান আরশের অধিকারী’’। এখানে মাজীদ শব্দটি আরশের সিফাত হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ মহান ও বিশাল। আরশ যেহেতু বিশাল, প্রশস্ত এবং সম্মানিত, তাই مجيد শব্দ দ্বারা আরশের সিফাত বর্ণনা করা হয়েছে।
হে পাঠক! চিন্তা করুন। আল্লাহ তাআলার এই المجيد নামটি দুরূদ শরীফে এসেছে। এখানে আল্লাহর কাছে দুআ করা হয়েছে যে, তিনি যেন তাঁর নবীর উপর দুরূদ পাঠান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এভাবে শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা যেন তাঁর শেখানো বাক্যগুলো দিয়ে আল্লাহর কাছে তাঁর উপর দুরূদ পাঠানোর দুআ করি। আর যেহেতু এটি আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণ কল্যাণ ও বরকত চাওয়ার স্থান এবং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রশস্ততা, আধিক্য এবং স্থায়ীত্ব বর্ণনার সময়, তাই এই দুআয় আল্লাহর এমন নাম নিয়ে আসা হয়েছে, যা উপরোক্ত সকল অর্থই প্রকাশ করে। যেমন আপনি বলে থাকেনঃ اغفرلي وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর এবং আমার উপর রহম কর। নিশ্চয়ই তুমি অত্যাধিক ক্ষমাকারী ও অত্যাধিক দয়াকারী। এখানে আল্লাহর নাম ও গুনাবলীর উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময় গাফুর নামের উসীলা এবং রহমত প্রার্থনা করার সময় আল্লাহর রাহীম নামের উসীলা দেয়া হয়েছে। এটি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য উসীলা। মুসনাদে আহমাদ ও তিরমিযীতে এসেছে, তোমরা يا ذا الجلال والإكرام কে উসীলা বানাও।[4] আবু দাউদ ও নাসাঈ শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় দুআয় বলতেনঃ
«اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ الْمَنَّانُ بَدِيعُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ»
‘‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, এই উসীলায় যে, তোমার জন্যই সকল প্রশংসা। তুমি ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। তুমি অত্যন্ত অনুগ্রহকারী এবং কোন নমুনা ছাড়াই আসমান-যমীন সৃষ্টিকারী। ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম (হে সুমহান, সম্মানিত এবং মর্যাদাবান)।[5] এটি হচ্ছে আল্লাহ তাআলার কাছে একটি দুআ। এখানে আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট উসীলা দিয়ে দুআ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি প্রচুর অনুগ্রহকারী। এই দুআয় আল্লাহর নাম ও গুনাবলীর উসীলা দেয়া হয়েছে। সুতরাং এই দু’আ কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী এবং আল্লাহর নিকট এটি খুবই মূল্যবান। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অধ্যায় তাওহীদের অন্যতম বিরাট একটি অধ্যায়।
(৬) আল্লাহর এমন কতিপয় নাম ও সিফাত রয়েছে, যা দু’টি নাম কিংবা দু’টি সিফাত পরস্পর মিলে একটিতে পরিণত হয়েছে। এককভাবে উক্ত দু’টি নাম বা দু’টি সিফাত যে অর্থ প্রদান করে, উভয়ে পরস্পর মিলে একত্রিত হয়ে তার চেয়ে অধিক অর্থ দেয়। যেমন الغني الحميد (আলগানিউল হামীদ), الغفور القدير (আলগাফুরুল কাদীর), الحميد المجيد (আলহামীদুল মাজীদ) এবং এ ধরণের আরো অনেক মুরাক্কাব (যৌগিক) সিফাত ও নাম কুরআনে রয়েছে। الغِني (অমূখাপেক্ষীতা) আল্লাহর একটি পরিপূর্ণ গুণ। অনুরূপ الحمد (পরিপূর্ণ প্রশংসা) আরেকটি পরিপূর্ণ গুণ। এখানে ‘গিনা’ এবং ‘হামদ’ পরস্পর মিলে অন্য একটি সিফাতে কামাল বুঝায়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার রয়েছে অমূখাপেক্ষীতার দিক থেকে প্রশংসা, সুন্দর গুণাবলীর দিক থেকেও রয়েছে তাঁর প্রশংসা। অমূখাপেক্ষীতার দিক থেকে প্রশংসা এবং সুন্দর গুণাবলীর দিক থেকে প্রশংসা একসাথে মিলিত হওয়ার কারণে আলাদা আরেকটি প্রশংসায় রূপ নিয়েছে। এ রকমই الغفور القدير (আলগাফুরুল কাদীর), الحميد المجيد (আলহামীদুল মাজীদ) এবং العزيز الحكيم (আল-আযীযুল হাকীম)। সুতরাং বিষয়টি ভালোভাবে বুঝা উচিত। কেননা এটি আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) আল্লাহ তাআলার অনেক অতি সুন্দর নাম রয়েছে। এই অতি সুন্দর নামসমূহ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা ওয়াজিব।
২) আল্লাহর অতি সুন্দর নামসমূহ অতি সুন্দর ও মহা পবিত্র।
৩) আল্লাহ তাআলাকে ঐ সমস্ত সুন্দর ও পবিত্র নামে ডাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৪) যেসব মূর্খ ও মুশরিকরা আল্লাহর পবিত্র নাম সমূহের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদেরকে পরিহার করে চলা জরুরী।
৫) এই অধ্যায়ে আল্লাহর নাম বিকৃতি করার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
৬) আল্লাহর নাম পরিবর্তন ও বিকৃতিকারীদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
[2] - এই হাদীছটি বর্ণনা করার পর ইমাম তিরমিজী (রঃ) বলেনঃ এই হাদীছটি গরীব (যঈফ)। সাফওয়ান বিন সালেহ থেকে অনেকেই আমাদের কাছে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সাফওয়ান বিন সালেহ ব্যতীত অন্য কেউ এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। মুহাদ্দিছদের নিকট সাফওয়ান একজন ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) রাবী। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকেও একাধিক সূত্রে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। তবে এই হাদীছ ব্যতীত যে সমস্ত হাদীছ রয়েছে, তাতে আল্লাহর নামগুলোর আলোচনা নেই। সেই সাথে এই বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলোর সহীহ কোন সনদও নেই। আদম বিন আবু ইয়াস এই হাদীছকে অন্য সনদে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। আর আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে। তাতে তিনি নামগুলো উল্লেখ করেছেন। তবে তার কোন সহীহ সনদ নেই।
মোট কথা আল্লাহর এই নামগুলো নির্দিষ্ট করা এবং এভাবে সীমাবদ্ধ করা সহীহ নয়। বিস্তারিত দেখুনঃ কুররাতুল উয়ুনঃ পৃষ্ঠা নং-৩৭৩।
[3] - মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- (১/১৯৯)।
[4] - হাদীছটি সহীহ। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- ১৫৩৬।
[5] - হাদীছটি সহীহ। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- ১৩২৬।