আল্লাহকে ব্যতীত অন্যদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ

‘‘মানুষের মধ্যে এমন মানুষও রয়েছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে আল্লাহর সদৃশ স্থির করে, আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫)

ব্যাখ্যাঃ শারহুল মানাযিল গ্রন্থে রয়েছে, আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত আল্লাহর মতই অন্য কোন বস্ত্তকে ভালবাসে, সে ঐ সমস্ত লোকের অন্তর্ভূক্ত, যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে তাঁর শরীক নির্ধারণ করে। এটি ভালবাসার ক্ষেত্রে আল্লাহর শরীক; সৃষ্টি, প্রভুত্ব ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আল্লাহর শরীক নয়। কেননা পৃথিবীর কেউ কোন দিন আল্লাহর সৃষ্টি ও রুবুবীয়াতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করেনি। কিন্তু আল্লাহর ভালবাসায় তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর অধিকাংশ অধিবাসী সম্মান ও ভালবাসার ক্ষেত্রে অনেক বস্ত্তকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করেছে।

ভাষ্যকার বলেনঃ আমি বলছি, এই উম্মতের পরবর্তী লোকদের অনেক আলেম ও সাধারণ লোকও রুবুবীয়াতের ক্ষেত্রে শির্কে লিপ্ত হয়েছে। তাদের ধারণা পৃথিবীর পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়েও এ সমস্ত মৃত অলী-আওলীয়াদের অংশ রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ إِنْ كَانَ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

‘‘তুমি বলে দাও, তোমাদের মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, তোমাদের স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ঐ ব্যবসা, যার লোকসান হওয়াকে তোমরা অপছন্দ করো এবং তোমাদের পছন্দনীয় বাড়ী-ঘর তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁরই পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’’। (সূরা তাওবাঃ ২৪)

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ তোমাদের কাছে যদি এ বস্ত্তগুলো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার চেয়ে অধিক প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা অপেক্ষা করো এবং দেখ তোমাদের উপর কী ধরণের শাস্তি নাযিল হয়।

সাহাবী আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»

‘‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, তার সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় হই’’।[1]

ব্যাখ্যাঃ ‘ঈমানদার হতে পারবেনা’-এর দ্বারা পরিপূর্ণ ঈমান উদ্দেশ্য। অর্থাৎ বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ না তার সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং সকল মানুষের চেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অধিক ভালোবাসবে। এই ভালবাসার দাবি হচ্ছে, বান্দা তাঁর আদেশ ও নিষেধকে সম্মান করবে এবং সকলকে বাদ দিয়ে কেবল তাঁরই আনুগত্য করবে। যার অবস্থা এ রকম হবে সেই কেবল আল্লাহকে ভালবাসে বলে ধরে নিতে হবে। যেমন বর্ণিত হয়েছে উপরের আয়াতে।

বুখারী ও মুসলিমে আনাস বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بهن حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِى الْكُفْرِ بَعْدَ إذَْ أنقَذَهُ الله منهُ كمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ

‘‘যার মধ্যে তিনটি জিনিষ বিদ্যমান আছে সে ব্যক্তি এগুলো দ্বারা ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পেরেছে। (এক) তার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বাধিক প্রিয় হবেন। (দুই) একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য কোন ব্যক্তিকে ভালোবাসবে। (তিন) আল্লাহ তাআলা তাকে কুফুরী থেকে উদ্ধার করার পর পূনরায় কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা তার কাছে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতই অপছন্দনীয় হবে’’।[2]

ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তির মধ্যে এই তিনটি গুণ পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হবে। কেননা কোনো জিনিষে স্বাদ পাওয়া উক্ত জিনিষের প্রতি মুহাববতের প্রমাণ বহন করে। যে ব্যক্তি কোনো জিনিষকে ভালোবাসে এবং তা পাওয়ার আকাঙ্খা করে, অতঃপর যখন সে তা পেয়ে যায় তখন উক্ত বিষয়টি পেয়ে স্বাদ, মজা এবং আনন্দ পায়। স্বাদ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা প্রিয় ও কাঙ্খিত বস্ত্ত লাভ করার পরই অর্জিত হয়।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ আল্লাহকে পরিপূর্ণ ভালোবাসার পরই ঈমানের স্বাদ অনুভব করা যায়। এটি হাসিল হয় তিনটি জিনিষের মাধ্যমে। বান্দার মধ্যে আল্লাহর ভালবাসা পূর্ণ হওয়া, এটিকে শুধু আল্লাহর জন্যই খালেস করা ও উপরোক্ত বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে অন্তর থেকে বের করে দেয়ার মাধ্যমে।

আল্লাহর পরিপূর্ণ ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে, বান্দার মধ্যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা অন্যান্য সকল বস্ত্তর চেয়ে অধিক পরিমাণ থাকা। কেননা বান্দার অন্তরে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি মৌলিক ভালোবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা সর্বাধিক হতে হবে।

ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, আল্লাহকে ভালোবাসার অন্যতম দাবি হচ্ছে তাঁর নবী-রাসূলদের প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর নাযিলকৃত কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের প্রতিও ভালোবাসা রাখা ও আল্লাহ তাআলার নিকট অপছন্দনীয় কথা ও কাজসমূহকে অপছন্দ করা। সেই সঙ্গে আল্লাহর শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা এবং তাঁর বন্ধুদের সাথে বন্ধুতব রাখা। বস্ত্ততঃ আল্লাহর পরিপূর্ণ মুহাববত, যা অর্জন করা আবশ্যক, তা উপরোক্ত বিষয়গুলো পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা ব্যতীত এবং নফ্সের চাহিদার উপর সেগুলোকে প্রধান্য দেয়া ব্যতীত অর্জন করা কখনই সম্ভব নয়।

أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا তার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বাধিক প্রিয় হবেনঃ এখানে سواهما কে দ্বি-বচন হিসাবে ব্যবহারের তাৎপর্য হল আল্লাহর ভলোবাসা এবং রাসূলের ভালোবাসা, -এ দু’টি বিষয়ের একটির সাথে অন্যটি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।

كمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ ‘‘তার কাছে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতই কুফুরীতে ফিরে যাওয়া অপছন্দনীয় হবে’’ঃ অর্থাৎ তার কাছে উভয়টিই সমান বিবেচিত হবে।

সহীহ বুখারীর অন্য একটি বর্ণনায় আছে,

لاَ يَجِدُ أَحَدٌ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ حَتَّى يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ وَحَتَّى أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ وَحَتَّى يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا

‘‘কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ পাবেনা যতক্ষণ না সে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোনো মানুষকে ভালোবাসবে, কুফুরী থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে মুক্তি দেয়ার পর যতক্ষণ না সে পুনরায় কুফুরীতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অধিক ভালোবাসবে এবং যতক্ষণ না আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল তার কাছে অন্যসব বস্ত্ত হতে অধিক প্রিয় হবে।[3]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেনঃ

من أَحِبَّ فِي اللَّهِ وَأَبْغَضَ فِي اللَّهِ وَوَالَى فِي اللَّهِ وَعَادَى فِي اللَّهِ فَإِنَّما تُنَالُ وِلايَةُ اللَّهِ بِذَلِكَ وَلن يَجِدُ عَبْدٌ طَعْمَ الإِيمَانِ وَإِنْ كَثُرَتْ صَلاتُهُ وَصِيَامُهُ حَتَّى يَكُونَ كَذَلِكَ وَصَارَتْ عامة مُؤَاخَاةُ النَّاسِ فِي أَمْرِ الدُّنْيَا وَ ذَلِكَ لا يُجْدِيْ عَلَى أَهْلِهِ شَيْئًا

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসে, আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ঘৃণা করে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে; তার এ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভ করা যাবে। আর এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া ব্যতীত কোনো বান্দাই ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবেনা, তার নামায-রোযার পরিমাণ যত বেশীই হোক না কেন। বর্তমানে মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্থিব স্বার্থ। এ ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের দ্বারা তার কোনো উপকার হবেনা।[4] ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

ব্যাখ্যাঃ من أَحَبَّ فِي اللَّهِ ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসে’’ঃ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারী এবং আল্লাহর আনুগত্যকারীদের ঈমান ও আনুগত্যের কারণেই তাদেরকে ভালবাসে।

وَأَبْغِضْ فِي اللَّهِ ‘‘আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ঘৃণা করে’’ঃ অর্থাৎ যারা আল্লাহর সাথে কুফুরী করে, শির্ক করে এবং আল্লাহর নাফরমানী করে তাদেরকে ঘৃণা করে। এই কারণে যে, তারা এমন কাজ করে, যাতে আল্লাহ তাআলা নারাজ হন। যদিও তারা তার নিকটতম ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

‘‘যারা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে তুমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেনা, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ্ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহ্‌র প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহ্‌র দল। জেনে রাখো! আল্লাহ্‌র দলই সফলকাম হবে’’। (সূরা মুজাদালাঃ ২২)

وَالَى فِي اللَّهِ ‘‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে’’ঃ অর্থাৎ সামর্থ ও ক্ষমতা অনুযায়ী ভালোবাসা পোষণ ও সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে।

وَعَادَى فِي اللَّهِ ‘‘আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে’’ঃ অর্থাৎ যারা আল্লাহর দুশমন, যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে, শির্ক করে এবং প্রকাশ্যে পাপাচারিতায় লিপ্ত হয়, সাধ্যানুযায়ী তার সাথে শত্রুতা পোষণ করা আবশ্যক।

فَإِنَّما تُنَالُ وِلايَةُ اللَّهِ بِذَلِكَ ‘‘এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার মাধ্যমেই আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করা যায়’’ঃ অন্য হাদীছে এসেছে, ঈমানের সর্বাধিক মজবুত বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে ঘৃণা করা।[5]

وَلن يَجِدَ عَبْدٌ طَعْمَ الإِيمَانِ ‘‘বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ পাবেনাঃ ইতিপূর্বে পূর্ণ হাদীছটি অতিক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ নামায-রোযা বেশী হলেও ঈমানের মিষ্টতা, মজা ও আনন্দ পাবেনা, যতক্ষণ না বান্দা উপরোক্ত হাদিছে বর্ণিত গুণাবলী অর্জন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

‘‘হে নবী! বলোঃ আল্লাহ্‌র দয়া ও মেহেরবানীতেই তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে নসীহত, অন্তরের রোগের নিরাময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত ও রহমত এসেছে। সুতরাং এরই প্রতি তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এটিই উত্তম সে সমুদয় থেকে, যা তারা সঞ্চয় করছে’’। (সূরা ইউনুসঃ ৫৮)

وَصَارَتْ عَامَّةُ مُؤَاخَاةِ النَّاسِ ..... ‘‘মানুষের মধ্যে পরস্পারিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্থিব স্বার্থঃ অর্থাৎ বান্দার অন্তরে যখন ঈমানের দাবি দুর্বল হয়ে যায়, তখন সে দুনিয়াকে ভালোবাসতে শুরু করে, দুনিয়ার জন্যই কাউকে ভালোবাসে, দুনিয়ার সম্পদ ও স্বার্থ অর্জনের জন্যই মানুষের সাথে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধন রচনা করে। অধিকাংশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটিই প্রবল। তারা দুনিয়ার জন্যই অন্যদেরকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নিকট পছন্দনীয় আমলের উপর নিজেদের প্রয়োজন ও চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়। অথচ এটি তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে কোন উপকারে আসবেনা। বরং উভয় জগতেই এটি তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে।

আল্লাহ তাআলার এই বাণীর ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ

إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ

‘‘গুরুরা যখন তাদের ভক্তদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে এবং জাহান্নামের আযাব প্রত্যক্ষ করবে ও তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৬)

ব্যাখ্যাঃ এখানে أسباب অর্থ হচ্ছে তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এই বন্ধুত্ব ঠিক ঐ সময় তাদের থেকে উধাও হবে, যখন তারা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এর প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَقَالَ إِنَّمَا اتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا مَوَدَّةَ بَيْنِكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُ بَعْضُكُمْ بِبَعْضٍ وَيَلْعَنُ بَعْضُكُمْ بَعْضًا وَمَأْوَاكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ نَاصِرِينَ

‘‘ইবরাহীম বললেন, পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা রক্ষার জন্য তোমরা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে প্রতিমাগুলোকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছ। এরপর কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরকে লানত করবে। তোমাদের ঠিকানা জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই’’। (সূরা আনকাবুতঃ ২৫) এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) সূরা বাকারার ১৬ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।

২) সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতের তাফসীরও জানা গেল।

৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসাকে জীবন, পরিবার ও ধন-সম্পদের উপর অগ্রাধিকার দেয়া ওয়াজিব।

৪) কোনো কোনো বিষয় এমন আছে যা ঈমানের পরিপন্থী হলেও এর দ্বারা ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাওয়া বুঝায়না। এমতাবস্থায় তাকে অপূর্ণাঙ্গ মুমিন বলা যেতে পারে।

৫) ঈমানের একটা স্বাদ আছে। মুমিন বান্দা কখনও এ স্বাদ অনুভব করতে পারে আবার কখনও অনুভব নাও করতে পারে।

৬) অন্তরের এমন চারটি আমল আছে, যা ব্যতীত আল্লাহর বন্ধুত্ব ও নৈকট্য লাভ করা যায়না এবং ঈমানের স্বাদও অনুভব করা যায়না।

৭) একজন প্রখ্যাত সাহাবী দুনিয়ার এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সাধারণত গড়ে উঠে পার্থিব বিষয়ের ভিত্তিতে।

৮) وتقطعت بهم الأسباب এর তাফসীর জানা গেল। যা একটু আগে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

৯) মুশরিকদের মধ্যেও এমন লোক রয়েছে যারা আল্লাহকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু শির্কের কারণে এ ভালোবাসা অর্থহীন।

১০) যে ব্যক্তির কাছে সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে উল্লেখিত ৮টি জিনিষ স্বীয় দ্বীন অপেক্ষা অধিক প্রিয় হবে, তার ব্যাপারে কঠিন শাস্তির ধমকি রয়েছে।

১১) যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে এবং আল্লাহকে ভালোবাসার মতই ঐ শরীককে ভালোবাসে সে শির্কে আকবার তথা বড় ধরনের শির্কে লিপ্ত হয়।

[1] - বুখারী, অধ্যায়ঃ রাসূলকে ভালোবাসা ঈমানের অন্তর্ভূক্ত। হাদীছ নং- ১৫&

[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঈমানের স্বাদ। হাদীছ নং- ১৬।

[3] - বুখারী, অধ্যায়ঃ আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা।

[4] - ইবনে জারীর এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে এই সনদে হাদীছটি দুর্বল। দেখুন কুররাতুল উয়ুন, পৃষ্ঠা নং- ২৭৬।

[5] - ইমাম তাবারানী, হাকেম এবং ইবনে আবু হাতিম হাদীছটি আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- ৯৯৮।