ব্যাখ্যাঃ نشرة শব্দের নূন বর্ণে পেশ দিয়ে পড়তে হবে। অভিধান গ্রন্থে এভাবেই লেখা আছে। আবুস সাআদাত বলেনঃ নুশরাহ হচ্ছে এক প্রকার ঝাড়-ফুঁক ও চিকিৎসার নাম। এর মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির চিকিৎসা করা হয়, যার ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, তার উপর জিন প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রকার চিকিৎসাকে নুশরাহ বলার কারণ হলো, নুশরার মাধ্যমে যাদুর গিরা খোলা হয় এবং যাদু গ্রস্তের শরীর থেকে যাদুর প্রভাব দূর করা হয়।
ইমাম ইবনুল জাওযী (রঃ) বলেনঃ যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি থেকে যাদুর প্রভাব দূর করাকে ‘নুশরাহ’ বলা হয়। যে যাদু বিদ্যা সম্পর্কে পারদর্শী সেই কেবল এই কাজ করতে পারে।
সাহাবী জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে,
«أن رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سُئِلَ عَنِ النُّشْرَةِ فَقَالَ هُوَ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ»
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নুশরাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেনঃ নুশরাহ হচ্ছে শয়তানের কাজ। ইমাম আহমাদ (রঃ) ভাল সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম আবু দাউদ (রঃ)ও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বলেনঃ ইমাম আহমাদ (রঃ)কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে জবাবে তিনি বলেছেন, ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সব কিছুই অপছন্দ করতেন।
ব্যাখ্যাঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম আবু দাউদ তাঁর থেকে স্বীয় সুনান গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। হাফেয ইবনে হাযার আসকালানী (রঃ) এ হাদীছকে হাসান বলেছেন।
سُئِلَ عَنِ النُّشْرَةِ নুশরাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ النشرة শব্দের আলিফ এবং লাম অক্ষর দু’টি নির্দিষ্ট বস্ত্ত বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত আলিফ-লাম হিসাবে ব্যবহৃত। অর্থাৎ এখানে সেই নির্দিষ্ট নুশরাহ উদ্দেশ্য, যার চর্চা করতো জাহেলী যুগের আরবরা। আর এটিই ছিল শয়তানের কাজ।
সহীহ বুখারীতে কাতাদাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হ'তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি ইবনুল মুসাইয়্যিবকে বললাম, একজন মানুষের শরীরে অসুখ রয়েছে অথবা যাদুর মাধ্যমে তাকে তার স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, এমতাবস্থায় কি তার উপর থেকে যাদুর প্রভাব দূর করা যাবে? কিংবা নুশরাহর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যাবে কি? তিনি বললেন, এতে কোনো দোষ নেই। কারণ তারা এর দ্বারা সংশোধন ও কল্যাণ সাধন করতে চায়। যা দ্বারা মানুষের কল্যাণ ও উপকার সাধিত হয় তা নিষিদ্ধ নয়’’।
ব্যাখ্যাঃ ‘কাতাদাহ’ (রঃ) এর পরিচয় হচ্ছে, তিনি হলেন কাতাদাহ বিন দিআমাহ আল দাওসী। তিনি ছিলেন একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী, ফকীহ এবং তাবেয়ী এবং তাফসীর শাস্ত্রের ইমামদের মধ্যে অন্যতম একজন বড় মাপের হাফেয। আলেমগণ বলেনঃ তিনি অন্ধ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১১০ হিজরী সালে মৃত্যু বরণ করেন।
رجل به طب একজন মানুষের শরীরে অসুখ রয়েছেঃ طب শব্দের ‘তোয়া’ বর্ণে যের দিয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ যাদু করা হয়েছিল। যখন কোনো লোককে যাদু করা হয় তখন বলা হয়ঃطب الرجل লোকটিকে যাদু করা হয়েছে।
অথবা যাদুর মাধ্যমে তাকে তার স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছেঃ يؤخذ শব্দের واو এর যেই হামযাহ রয়েছে, তাতে যবর দিয়ে এবং ‘খা’ বর্ণে তাশদীদসহ যবর দিয়ে পাঠ করতে হবে। অর্থাৎ যাদুর কারণে সে তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে অক্ষম হয়ে গেছে। সে এখন সহবাস করতে পারেনা। যাদুকর যে কালাম বা মন্ত্র পাঠ করে, তাকে الأخذة (আল-উখযাহ) বলা হয়।
এতে কোনো দোষ নেইঃ অর্থাৎ যাদুর প্রভাব দূর করতে গিয়ে ‘নুশরাহ’এর আশ্রয় গ্রহণ করাতে কোনো দোষ নেই। কেননা যারা নুশরাকে বৈধ বলেছেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাদুগ্রস্তকে সুস্থ করা। সাঈদ বিন মুসায়্যিবের এ কথা ঐ প্রকার নুশরার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যা যাদু হিসাবে জ্ঞাত নয়।
হাসান বসরী (রঃ) থেকে বর্নিত আছে, তিনি বলেছেনঃ «لا يحل السحر إلا الساحر» ‘‘একমাত্র যাদুকর ছাড়া অন্য কেউ যাদু অপসারণ করতে পারেনাঃ
ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনুল জাওযী (রঃ) এই আছারটি ‘জামেউল মাসানিদ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
এখানে হাসান বিন আবুল হাসান আলবসরী উদ্দেশ্য। তাঁর নাম হচ্ছে ইয়াসার আল-আনসারী আল-বসরী। তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য ইমাম, ফকীহ এবং মর্যাদাবান তাবেয়ীদের অন্যতম ব্যক্তি। প্রায় নববই বছর বয়সে তিনি ১১০ হিজরী সালে মৃত্যু বরণ করেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, النشرة حل السحر عن المسحور ‘নুশরাহ’ হচ্ছে যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির উপর থেকে যাদুর প্রভাব দূর করা। নুশরাহ দু’ধরনের। প্রথমটি হচ্ছে, যাদুকৃত ব্যক্তির উপর হতে যাদুর ক্রিয়া নষ্ট করার জন্য অনুরূপ যাদু দ্বারা চিকিৎসা করা। আর এটাই হচ্ছে শয়তানের কাজ। হাসান বসরী (রঃ) এর বক্তব্য দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নাশের (যাদুর চিকিৎসক) ও মুনতাশার (যাদুগ্রস্ত রোগী) উভয়ই শয়তানের পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে শয়তানের নৈকট্য হাসিল করে। যার ফলে শয়তান যাদুকৃত রোগীর উপর থেকে তার প্রভাব মিটিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ঝাড়-ফুঁক, আল্লাহ তাআলার কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা সম্বলিত দুআগুলো পাঠ করা এবং বৈধ ঔষধ প্রয়োগ করা। এ ধরণের চিকিৎসা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা শরীয়তে জায়েয আছে।
ব্যাখ্যাঃ নুশরাহ তথা যাদুর বৈধ চিকিৎসার বর্ণনায় ইবনু আবী হাতিম এবং আবুশ শাইখ লাইছ বিন আবী ছুলাইম থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, নিম্নের আয়াতগুলো আল্লাহ তাআলার হুকুমে যাদুর চিকিৎসায় ফলদায়ক ও উপকারী। একটি পাতিলে পানি রেখে আয়াতগুলো পাঠ করে তাতে ফুঁ দেয়া হবে। অতঃপর সেই পানি যাদুগ্রস্ত রোগীর মাথায় ঢালা হবে। আয়াতগুলো এইঃ
مَا جِئْتُمْ بِهِ السِّحْرُ إِنَّ اللَّهَ سَيُبْطِلُهُ إِنَّ اللَّهَ لَا يُصْلِحُ عَمَلَ الْمُفْسِدِينَ (81) وَيُحِقُّ اللَّهُ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ
‘‘যা কিছু তোমরা এনেছ তা সবই যাদু। আল্লাহ্ এখনই একে ব্যর্থ করে দিবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কর্মকে সার্থক হতে দেন না। আর অপরাধীদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন আল্লাহ্ তার ফরমানের সাহায্যে সত্যকে সত্যে পরিণত করেই দেখিয়ে দেন। (সূরা ইউনূসঃ ৮১-৮২)
فَوَقَعَ الْحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ فَغُلِبُوا هُنَالِكَ وَانْقَلَبُوا صَاغِرِينَ وَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ قَالُوا آَمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ
‘‘সুতরাং এভাবে প্রকাশ হয়ে গেল সত্য বিষয় এবং ভুল প্রতিপন্ন হয়ে গেল যা কিছু তারা করেছিল। ফলে তারা সেখানেই পরাজিত হলো এবং বিজয়ী হওয়ার পরিবর্তে তারা নিজেরাই লাঞ্ছিত হলো এবং যাদুকররা সেজদায় পড়ে গেলো। তারা বলতে লাগল, আমরা ঈমান আনয়ন করলাম মহাবিশ্বের রবের প্রতি। (সূরা আরাফঃ ১১৮-১২১)
إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَى
‘‘এরা যা কিছু বানিয়ে এনেছে, তা তো যাদুকরের কলাকৌশল। যাদুকর যেখানেই আসুক না কেন কখনো সফল হতে পারেনা’’। (সূরা তোহাঃ ৬৯)
ইমাম ইবনে বাত্তাল বলেনঃ ওহাব বিন মুনাবিবহ (রঃ)এর কিতাবে রয়েছে যে, সাতটি সবুজ রঙের বরই পাতা নিয়ে দু’টি পাথর দিয়ে তা পিষবে। অতঃপর তা পানিতে মিশাবে এবং তাতে আয়াতুল কুরসী ও চারকুল পাঠ করবে। অতঃপর পানি থেকে তিন অঞ্জলী পান করবে এবং বাকী পানি দিয়ে গোসল করবে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে যাদুর সকল প্রভাব দূর হয়ে যাবে। কোন পুরুষকে যদি যাদুর মাধ্যমে তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হতে অক্ষম করে দেয়া হয়, তাহলে সেই পুরুষের জন্য এ পদ্ধতি খুবই উপকারী।[1] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) নুশরাহ্ তথা যাদু দ্বারা যাদুগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা করতে নিষেধ করা হয়েছে।
২) নিষিদ্ধ বস্ত্ত ও বৈধ বস্ত্তর মধ্যে পার্থক্য করতে পারলেই সমস্যা ও সন্দেহ মুক্ত হওয়া যায়।