ইমাম মালেক (রঃ) মুয়াত্তায় বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ করেছেনঃ
«اللَّهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ»
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তিতে পরিণত করোনা, যার এবাদত করা হবে। ঐ জাতির উপর আল্লাহর লা’নত, যারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে।[1]
ব্যাখ্যাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশঙ্কা করেছিলেন যে, ইহুদী-খৃষ্টানরা তাদের নবীদেরকে নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ি করেছিল, তাঁর উম্মতও তাঁকে নিয়ে তেমনই বাড়াবাড়ি করতে পারে। ইহুদী-খৃষ্টানরা আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে তাদের নবীদের এবাদত করা শুরু করেছিল। নবীদের প্রতি অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনই তাদেরকে এই পথে নিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ
‘‘হে নবী! তুমি বলোঃ হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করোনা এবং ঐ সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তির অনুসরণ করোনা, যারা ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে’’। (সূরা মায়েদাঃ ৭৭)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রবের কাছে এই আকাঙ্খা পেশ করেছেন যে, তাঁর কবরকে যেন এমন একটি মূর্তিতে পরিণত না করেন, যার এবাদত করা হবে। আর ইহা জানা কথা যে, বর্তমানে কবরের জন্য বিভিন্ন প্রকার এবাদত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদীছে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ তাঁর কবরকে যদি এবাদতের স্থানে পরিণত করার আশঙ্কা না থাকত, তাহলে তাঁর কবরকে উঁচু করা হত এবং খোলা মাঠে প্রকাশ করা হত। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর কবরকে মসজিদ বানানো হতে পারে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর দুআ কবুল করেছেন, তাঁর কবরকে হেফাযত করেছেন এবং তিনটি দেয়াল দ্বারা তাঁর কবরকে বেষ্টিত করে দিয়েছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ
فأجاب رب العالمين دعاءه وأحاطه بثلاثة الجدران
‘‘রাববুল আলামীন তাঁর দুআ কবুল করেছেন এবং তিনটি প্রাচীর দিয়ে তাঁর কবরকে ঘিরে দিয়েছেন’’।
ইবনে জারীর সুফিয়ান হতে, তিনি মানসূর হতে এবং তিনি মুজাহিদ হতে أفرأيتم اللات والعزى এর ব্যাখ্যায় বলেন, লাত এমন একজন সৎ লোক ছিলেন, যিনি হাজীদেরকে ছাতু খাওয়াতেন। অতঃপর তিনি যখন মৃত্যু বরণ করলেন, তখন লোকেরা তার কবরের পাশে অবস্থান করতে লাগল। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আবুল জাওযা একই কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘লাত’ হাজীদেরকে ছাতু খাওয়াতেন।
ব্যাখ্যাঃ ইবনে জারীর হচ্ছেন আবু জাফর বিন জারীর। তিনি তাফসীরুল কাবীরের লেখক। এটি হচ্ছে সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট তাফসীর। ইবনে জারীর ছিলেন মুসলিম জাতির মুজতাহিদ ইমামদের অন্যতম। ‘আল-আহকাম’ নামে তাঁর আরেকটি কিতাব রয়েছে।[2]
তিনি হাজীদেরকে ছাতু খাওয়াতেন। তিনি যখন মৃত্যু বরণ করলেন, তখন লোকেরা তার কবরে অবস্থান করতে লাগলঃ এখান থেকেই লেখক এই অধ্যায়ের শিরোণাম রচনা করেছেন। লোকেরা লাতের নেক আমল দেখে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল এবং তাকে মূর্তি বানিয়ে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে লাগল এবং তার এবাদত করতে লাগল। পরে সে জাহেলী যামানার লোকদের অন্যতম বৃহৎ মূর্তিতে পরিণত হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
«لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم زَائِرَاتِ الْقُبُورِ وَالْمُتَّخِذِينَ عَلَيْهَا الْمَسَاجِدَ وَالسُّرُجَ»
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারতকারিনী মহিলাদেরকে এবং কবরকে মসজিদে পরিণতকারী ও কবরে বাতি প্রজ্বলিতকারীদেরকে অভিসম্পাত করেছেন’’।[3]
ব্যাখ্যাঃ এ হাদীছটি সহীহ। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এ হাদীছকে সহীহ বলেছেন। সুনান গ্রন্থকারগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এ দ্বারা দলীল গ্রহণ সঠিক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। সুনান গ্রন্থকারদের কেউই এই হাদীছের দোষ বর্ণনা করেন নি। হাদীছটির বিরোধী অন্য কোন হাদীছও নেই। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১। মূর্তি বা প্রতিমার তাফসীর জানা গেল। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত যারই এবাদত করা হোক না কেন, সেটিই মূর্তি সমতুল্য।
২) এবাদতের ব্যাখ্যা জানা গেল। অর্থাৎ কবরকে অতিরিক্ত সম্মান করা কবরবাসীর এবাদতের নামান্তর।
৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করেছেন একমাত্র তা থেকেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন।
৪) নবীদের কবরকে মসজিদ বানানোর বিষয়টিকে মূর্তি পূজার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
৫) যারা কবরকে মসজিদ বানায় তাদের উপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কঠিন গযব নাযিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৬) এ অধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সর্ববৃহৎ মূর্তি ‘‘লাতের’’ এবাদতের সূচনা কিভাবে হয়েছে, তা জানা গেল।
৭) লাত নামক মূর্তির স্থানটি মূলতঃ একজন নেককার লোকের কবর।
৮) লাত প্রকৃতপক্ষে কবরস্থ ব্যক্তির নাম। মূর্তির নামেই কবরের নাম করণ করা হয়েছে।
৯) কবর যিয়ারতকারিনী মহিলাদের উপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিশাপ।
১০) যারা কবরে বাতি জ্বালায় তাদের প্রতিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিশাপ।
[2] - তবে সঠিক কথা হচ্ছে এই কিতাবটি ইবনে জারীর তাবারীর নয়। যতদূর জানা যায় কিতাবুল আহকাম হচ্ছে মুহিববুদ দ্বীন তাবারীর লেখা। আল্লাহই ভাল জানেন।
[3] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ মহিলাদের কবর যিয়ারত। ইমাম আলবানী এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা, হাদীছ নং- ২২৫।