ব্যাখ্যাঃ এই অধ্যায় থেকে জানা গেল, যে বস্ত্ত মানুষকে শির্কের দিকে নিয়ে যায়, তা গ্রহণ করা হারাম। কেননা এটিই পরে মানুষকে আল্লাহর সাথে শির্কে উৎসাহিত করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদতে লিপ্ত করে। নিম্নের হাদীছগুলোতে এর বিশদ বিবরণ আসছে।
সহীহ বুখারীতে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে যে, উম্মে সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা হাবাশায় যে গীর্জাটি দেখেছিলেন এবং তাতে তিনি যেসব প্রতিকৃতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেনঃ
أُولَئِكَ قَوْمٌ إِذَا مَاتَ فِيهِمُ الْعَبْدُ الصَّالِحُ أَوِ الرَّجُلُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ أُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘তারা এমন লোক, তাদের মধ্যে যখন কোন নেককার বান্দা মৃত্যু বরণ করত, তখন তারা তার কবরের উপর মসজিদ তৈরী করত এবং মসজিদে ঐগুলো স্থাপন করত। এরাই হচ্ছে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট লোক। তারা দুটি ফিতনাকে একত্র করেছে। একটি হচ্ছে কবর পূজার ফিতনা। অপরটি হচ্ছে প্রতিকৃতি পূজার ফিতনা।
ব্যাখ্যাঃ উম্মে সালামা হচ্ছেন হিন্দা বিনতে আবু উমাইয়্যা ইবনুল মুগীরা বিন আব্দুল্লাহ আল-কুরাশী আল-মাখযুমী। চতুর্থ হিজরীতে তাঁর স্বামী আবু সালামা মৃত্যু বরণ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিবাহ করেন। আবার কেউ কেউ বলেনঃ তৃতীয় হিজরী সালে তা হয়েছিল। উম্মে সালামা স্বামী আবু সালামার সাথে ইতিপূর্বে হাবশায় হিজরত করেছিলেন। ৬২ হিজরী সালে উম্মে সালামা ইন্তেকাল করেন।
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, উম্মে হাবীবা ও উম্মে সালামা উভয়ে বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উল্লেখ করেছিলেন। জ্ঞাতব্য যে, খৃষ্টানদের এবাদতখানাকে গীর্জা বলা হয়।
উম্মে সালামা যেহেতু তাঁর স্বামী আবু সালামার সাথে হাবশায় হিজরত করেছিলেন, তাই তিনি সেখানকার গীর্জা ও গীর্জার মধ্যে প্রতিকৃতিগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। অতঃপর তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই সেখান থেকে ফিরে এসে পুনরায় মক্কায় হিজরত করেন। হাবাশার অধিবাসীরা খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে হতে কতিপয় লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
এরাই হচ্ছে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট লোক। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তারা সর্বাধিক নিকৃষ্ট লোক হওয়ার কারণ হিসাবে কবরের উপর মসজিদ বানানো এবং তাতে সৎ লোকদের প্রতিকৃতি স্থাপন করা ব্যতীত তাদের আর কোনো আমলের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কেননা কবরের উপর মসজিদ বানানোই পরবর্তীতে কবরবাসী এবং প্রতিকৃতিগুলোর এবাদতের মাধ্যম ও কারণে পরিণত হয়। এ জন্যই তারা সৃষ্টির সর্বাধিক নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়েছে।
প্রিয় পাঠক! বর্তমান কালে এই উম্মতের লোকেরা শির্কের যেসব পথে অগ্রসর হচ্ছে, যেমন কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা, কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং কবরের এবাদত করা তা উপরে উল্লেখিত গীর্জার শির্কের চেয়েও অধিক ভয়াবহ। তারপরও লোকেরা এই শির্ককেই দ্বীন বানিয়ে নিয়েছে। অথচ এটিই হচ্ছে সেই শির্ক, যাকে আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন এবং যা থেকে নিষেধ করার জন্য আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং অনেক কিতাব নাযিল করেছেন।
তারা দু’টি ফিতনাকে একত্রিত করেছে। একটি হচ্ছে কবর পুজার ফিতনা। অপরটি হচ্ছে মূর্তি পূজার ফিতনা। এটি হচ্ছে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ)এর উক্তি। লেখক এখানে তাঁর নাম উল্লেখ না করেই উক্তিটি নকল করেছেন। কারণ এই কিতাবটির প্রত্যেক পাঠকই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে আরো একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু ঘনিয়ে আসল, তখন তিনি নিজের মুখমণ্ডলকে স্বীয় চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলতেন। আবার অস্বস্তিবোধ করলে তা চেহারা থেকে সরিয়ে ফেলতেন। এমতাবস্থায় তিনি বললেনঃ
«لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا لَوْلاَ ذَلِكَ لأُبْرِزَ قَبْرُهُ غَيْرَ أَنَّهُ خَشِىَ أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدًا»
‘‘ইহুদী-খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর লা’নত। তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে। ইহুদ-নাসারাদের কাজ থেকে মুমিনদেরকে সতর্ক করাই ছিল এ কথার উদ্দেশ্য। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ কবরকে এবাদত খানায় পরিণত করার আশঙ্কা না থাকলে তাঁর কবরকে উঁচু স্থানে উন্মুক্ত রাখা হত। কিন্তু তিনি আশঙ্কা করলেন যে, তার কবরকে মসজিদে পরিণত করা হতে পারে’’।[1]
ব্যাখ্যাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীঃ ‘‘ইহুদী-খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর লা’নত’’ এখান থেকেই শিরোনাম রচনা করা হয়েছে। কবরের পাশে যারা নামায আদায় করে, তাদের উপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লা’নত বর্ষণ করেছেন। যদিও সে আল্লাহর জন্যই নামায পড়ে থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি কবরের পাশে নামায আদায় করে এবং কবরকে মসজিদে পরিণত করে, সে অভিশপ্ত। কারণ কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হলে তা কবরের এবাদতের দিকে নিয়ে যাবে। সুতরাং কবরের উপর মসজিদ নির্মাণকারী যদি অভিশপ্ত হয়, তাহলে ঐ সমস্ত লোকের কী হুকুম হবে, যারা কবরে দাফনকৃত লোকদের জন্য বিভিন্ন প্রকার এবাদত পেশ করে এবং তাদের কাছে এমন জিনিষ প্রার্থনা করে, যা তাদের ক্ষমতাধীন নয়?
কবরবাসীর এবাদতের জন্য কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং ইহাকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা হয়। উল্লেখিত হাদীছে শুধু ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকেই লানত করা হয়নি; বরং যারাই তাদের অনুরূপ অথবা তার চেয়েও অধিক ভয়াবহ শির্কে লিপ্ত হবে, তারাই অভিশপ্ত হবে। ইহুদী-খৃষ্টানদের কাজ থেকে এই উম্মতকে সাবধান করার উদ্দেশ্যেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদী-খৃষ্টানদের উপর লা’নত বর্ষণ করেছেন। তারা যদি ইহুদী-খৃষ্টানদের মত কাজ করে তাহলে তারা তাদের মত শাস্তি পাবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি তাঁর কবরকে মসজিদ বানানোর আশঙ্কা না করতেন, তাহলে তাঁকেও তাঁর সাহাবীদের সাথে বাকী গোরস্থানে কবর দেয়া হত।
خَشِيَ শব্দের خا ‘খা’ বর্ণে যবর ও পেশ উভয়টি দিয়েই বর্ণিত হয়েছে। যবর দিয়ে পড়া হলে এর অর্থ হবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাঁর কবরটি মসজিদে পরিণত হওয়ার ভয় করেছিলেন। তাই তিনি যেখানে ইন্তেকাল করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করার হুকুম করেছেন। আর যদি পেশ দিয়ে পড়া হয়, তাহলে তার অর্থ হবে, সাহাবীগণ আশঙ্কা করেছিলেন যে, এই উম্মতের কতিপয় লোক তাঁর কবরকে সেজদার স্থানে পরিণত করতে পারে। বাড়াবাড়ি ও অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে এই উম্মতের কিছু লোক তাঁর কবরকে মসজিদ বানাতে পারে এই ভয়েই সাহাবীগণ তাঁকে খোলা মাঠে দাফন করেন নি। তা ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরকে মসজিদ বানাতে বার বার সাবধান করেছেন এবং যারা এরূপ করে তাদের উপর লা’নত বর্ষণ করেছেন।
ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ এ জন্যই মুসলিমগণ যুগে যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরকে কেন্দ্র করে শির্ক সংঘটিত হওয়ার সকল দরজা বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাঁর কবরের চতুর্দিকের দেয়ালগুলো উঁচু করে দেয়া হয়েছে, সেখানে প্রবেশের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং তাকে সকল দিক থেকেই ঘিরে রাখা হয়েছে। অতঃপর মুসলিমগণ আশঙ্কা করল যে, কবরটি যদি নামাযীদের সামনে পড়ে, তাহলে মুসাল্লীগণ কবরকে কিবলা বানিয়ে নিতে পারে এবং তাঁর কবরের দিকে ফিরে নামায আদায় করাকে তাঁর জন্য এবাদত হিসাবে কল্পনা করতে পারে। তাই কবরের উত্তর দিকের দুই পার্শ্ব থেকে এমনভাবে দু’টি প্রাচীর বানানো হয়েছে, যা ত্রিভুজ আকারে উত্তর দিকে একসাথে মিলিত হয়েছে। এতে করে আর তারা কবরকে কিবলা বানাতে পারবেনা।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর দুআ কবুল করেছেন এবং তাঁর কবরকে হেফাযত করেছেন। তিনি দুআয় বলেছেনঃ
«اللَّهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ»
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তিতে পরিণত করোনা, যার এবাদত করা হবে। ঐ জাতির উপর আল্লাহর লা’নত, যারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে।[2]
জুনদুব বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে এ কথা বলতে শুনেছিঃ
«إِنِّى أَبْرَأُ إِلَى اللَّهِ أَنْ يَكُونَ لِى مِنْكُمْ خَلِيلٌ فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِى خَلِيلاً كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلاً وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أُمَّتِى خَلِيلاً لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيلاً أَلاَ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّى أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ»
‘‘আমি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করছি। কেননা আল্লাহ তাআলা আমাকে তাঁর খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমনি তিনি ইবরাহীম (আঃ)কে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমি যদি আমার উম্মত হতে কাউকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করতাম, তাহলে অবশ্যই আবু বকরকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করতাম। সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে। সাবধান, তোমরা কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করোনা। আমি তোমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করছি’’।[3]
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছের বর্ণনাকারী হচ্ছেন জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ বিন সুফিয়ান আল-বাজালী। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। ৬০ হিজরী সালের পরে তিনি ইন্তেকাল করেন।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ মুসলিমদের সকল জামআতই কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। কারণ এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীছ রয়েছে। ব্যাখ্যাকার বলেনঃ ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল, ইমাম শাফেঈ এবং ইমাম মালেক (রঃ)-এর অনুসারীগণ কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা হারাম বলেছেন।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা হারাম হওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীত এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এরপর তিনি দলীল হিসাবে অনেক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেনঃ নবী-রাসূল, সৎ লোক এবং রাজা-বাদশাহদের কবরের উপর নির্মিত এ কবরগুলো ভেঙ্গে ফেলা অথবা অন্য সরিয়ে ফেলা আবশ্যক। এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে বলে আমার জানা নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তেও কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। আর এ কাজ যারা করেছে তাদেরকে তিনি লানত করেছেন। কবরের পাশে মসজিদ নির্মিত না হলেও সেখানে যারা নামায পড়বে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লা’নত প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। কবরকে এবাদত খানায় পরিণত করার আশঙ্কা না থাকলে তাঁর কবরকে উন্মুক্ত রাখা হত, -আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার এ বাণী দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে মসজিদ বানানোর মত লোক ছিলেন না। যে স্থানকে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে সে স্থানকেই মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। বরং এমন প্রত্যেক স্থানকেই মসজিদ বলা হয়, যেখানে নামায আদায় করা হয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ» «جُعِلَتْ لِىَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا‘‘পৃথিবীর সব স্থানকেই আমার জন্য মসজিদ বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পবিত্র করে দেয়া হয়েছে’’।[4]
ব্যাখ্যাঃ আমাদের সম্মানিত ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) বলেনঃ কবরের উপরে মসজিদ নির্মাণ করা নিষেধ সংক্রান্ত হাদীছগুলোর ব্যাখ্যায় উপরোক্ত কথা বলেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘জীবন্ত অবস্থায় যাদের উপর দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে, আর যারা কবরকে মসজিদে পরিণত করে, তারাই হচ্ছে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক।[5]
ব্যাখ্যাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমণের পূর্বে জাহেলী যামানায় যেমন শির্ক সংঘটিত হয়েছিল, এই উম্মতের মধ্যে সে রকম শির্কই সংঘটিত হয়েছে। জ্ঞানীদের নিকট এ বিষয়টি অস্পষ্ট নয়। শুধু তাই নয়, এই উম্মতের বর্তমান সময়ের লোকগণ শির্কী কাজে একাধিক ক্ষেত্রে জাহেলী যামানার লোকদের শির্কের চেয়েও অধিক এগিয়ে রয়েছে।
১) এই উম্মতের পরবর্তী যুগের লোকেরা কঠিন বিপদ মুহূর্তেও আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যদেরকে এখলাসের সাথে আহবান করে এবং আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়। অথচ জাহেলী যামানার লোকেরা যখন বিপদে পড়ত, তখন আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্যান্য যেসব বস্ত্তর উপাসনা করত, সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে এককভাবে আল্লাহকেই ডাকতো এবং তাঁর কাছেই উদ্ধার কামনা করতো।
২) বর্তমান কালের এক শ্রেণীর মুসলিম বিশ্বাস করে, আল্লাহ ব্যতীত তাদের মৃত মাবুদরা পৃথিবীর কাজ-কর্ম পরিচালনা করে থাকে। এরা রুবুবীয়াত এবং উলুহীয়াত- এ উভয় ক্ষেত্রেই শির্কে লিপ্ত রয়েছে। তাদের শির্কী কথা আমরা তাদের জবান থেকে শুনেছি। ওমানের অধিবাসী ইবনে কামাল এবং অন্যদেরকে বলতে শুনেছি, তারা বলে থাকে, যে ব্যক্তি আব্দুল কাদের জিলানীকে ডাকে, আব্দুল কাদের জিলানী তার ডাক শুনে এবং শুনার সাথে সাথে উপকারও করে। সম্ভবতঃ তাদের ধারণা আব্দুল কাদের জিলানী মৃত্যুর পরও গায়েবের খবর রাখেন। এদের বিবেক নষ্ট হয়ে গেছে এবং তারা গোমরাহ হয়ে গেছে। আল্লাহর কিতাবে নাযিলকৃত সত্যকে তারা অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنْ تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ
‘‘তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের সে ডাক শুনে না। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয় না। কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ক অস্বীকার করবে। আল্লাহ্র ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবেনা’’। (সূরা ফাতিরঃ ১৪)
মুশরিকরা আল্লাহ ব্যতীত যেসব মাবুদের এবাদত করত আল্লাহ তাআলা তাদের সেসব মাবুদ সম্পর্কে যে খবর দিয়েছেন, তা তারা বিশ্বাস করেনি এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন, তাতেও তারা ঈমান আনয়ন করেনি। বরং তারা অহংকার ও দাপটের সাথে ঈমান প্রত্যাখ্যান করেছে এবং কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে। তারা অহংকারের সাথে দলীল ও যুক্তি সবই অস্বীকার করেছে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) যে ব্যক্তি সৎ লোকের কবরের পাশে আল্লাহর এবাদত করার জন্য মসজিদ বানায়, তার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর হুঁশিয়ারী রয়েছে। যদিও এবাদতকারীর নিয়ত সহীহ হয়।
২) মূর্তি বানানোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং এ ব্যাপারে কঠোর ধমকি এসেছে।
৩) কবরকে মসজিদ বানানো থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করার মধ্যে বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। প্রথমে তিনি সুস্পষ্ট করে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। অতঃপর মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে তিনি তা বারবার বলেছেন। অতঃপর যখন তাঁর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হল তখন তিনি পূর্বের বর্ণনাকে যথেষ্ট মনে করেন নি। বরং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় আবারও সতর্ক করেছেন।
৪) নিজ কবরের অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই তাঁর কবরের পাশে এসব কাজ অর্থাৎ কবর পূজা থেকে নিষেধ করেছেন।
৫) নবীদের কবরগুলোকে এবাদতখানায় পরিণত করা ইহুদ-নাসারাদের রীতি।
৬) এ জাতীয় কাজ যারা করে তাদের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অভিসম্পাত।
৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সতর্ক করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর কবরকে মসজিদ বানানো থেকে আমাদেরকে সাবধান করা।
৮) তাঁর কবরকে উন্মুক্ত না রাখার কারণ এ হাদীছে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
৯) এ অধ্যায়ে কবরকে মসজিদ বানানোর মর্মার্থ ব্যক্ত করা হয়েছে।
১০) যারা কবরকে মসজিদে পরিণত করে এবং যাদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে, -এ দু’ধরনের লোকের কথা একসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শির্ক সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই এমন কিছু বিষয়ের বর্ণনা করেছেন, যা মানুষকে শির্কের দিকে নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তিনি শির্কের শেষ পরিণামও বর্ণনা করেছেন।
১১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ইন্তেকালের পাঁচ দিন পূর্বে স্বীয় খুতবায় কবরের উপর মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। এখানে বিদআতী লোকদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দু’টি দলের প্রতিবাদ রয়েছে। কিছু সংখ্যক জ্ঞানী ব্যক্তি এ বিদআতীদেরকে মুসলমানদের ৭২ দলের বাইরে বলে মনে করেন।[6] এসব বিদআতী হচ্ছে রাফেযী ও জাহমীয়া। এই রাফেযী দলের কারণেই শির্ক এবং কবর পূজা শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম কবরের উপর তারাই মসজিদ নির্মাণ করেছে।
১২) এই অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছ থেকে জানা গেল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও মৃত্যু যন্ত্রণা হয়েছিল।
১৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা খলীল বানিয়ে সম্মানিত করেছেন।
১৪) খুল্লাতের স্তর মুহাববত ও ভালবাসার স্তরের চেয়েও অধিক উর্ধ্বে।
১৫) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, সাহাবীদের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিক রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
১৬) এই হাদীছে আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে।
[2] - মুআত্তা ইমাম মালেক। ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ শাইখের তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৭৫০।
[3] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা নিষেধ।
[4] - বুখারী, অধ্যায়ঃ পৃথিবার সব স্থানকেই আমার জন্য মসজিদ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
[5] - মুসনাদে আহমাদ। আবু হাতিম এ হাদীসটি তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সহীহ ওয়া যঈফ আল জামে আস সাগীর।
[6] - অর্থাৎ তাদের বিদআত এতই মারাত্মক ও ক্ষতিকর, যার কারণে তারা মুসলমানদের অন্যান্য গোমরাহ ফির্কার অন্তর্ভূক্ত হওয়ারও উপযুক্ত নয়। তাই কোন কোন আলেম তাদেরকে নিরেট কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত করে দিয়েছেন।