তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি ৩য় অধ্যায় - শির্ক হতে ভয়-ভীতি সম্পর্কে (باب: الخوف من الشرك) শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) ১ টি

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ

‘‘আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করার গুনাহ মাফ করবেন না। শির্ক ছাড়া অন্যান্য যেসব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮)

ব্যাখ্যাঃ মুশরিকের জাহান্নামী হওয়া একটি সাধারণ হুকুম। সে জাহান্নামে প্রবেশ করে তথায় চিরকাল বসবাস করবে। এ বিষয়ে আহলে কিতাব তথা ইহুদী, নাসারা, মূর্তিপূজক এবং অন্যান্য কাফেরের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যে ব্যক্তি অহংকার বশত কুফরী করে এবং যে ব্যক্তি অন্য কোন কারণে কুফরী করে, হকপন্থীদের নিকট তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে মিল্লাতে ইসলামীয়ার বিরোধী এবং ইসলাম গ্রহণ করার পর যার উপর কুফরীর হুকুম লাগানো হয়েছে, তার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কেননা সে এমন বিষয়কে অস্বীকার করেছে, যা অস্বীকার করা কুফরী। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করেছে, তার জান্নাতে প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত। তবে যে ব্যক্তি এমন কবীরা গুনাহ করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল, যার উপর সে মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল ছিলনা। সে বিনা আযাবে প্রথমেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যদি কবীরা গুনাহ করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। আল্লাহ্ তাআলা যদি তাকে ক্ষমা করে দেন তাহলে সে প্রথমেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তিনি যদি তাকে ক্ষমা না করেন, তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তথায় চিরকাল থাকবে।

ব্যাখ্যাকারী বলেনঃ আমি বলছি, এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত। এ ব্যাপারে তাদের মাঝে কোন মতভেদ নেই। শির্ক থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক হওয়ার বিষয়ে এটি একটি অন্যতম বিরাট আয়াত। আল্লাহ্ তাআলা মুশরিককে ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করেছেন। সেখানে সে চিরকাল লাঞ্ছিত অবস্থায় থাকবে। এটি একটি সাধারণ হুকুম। এই হুকুমকে কোন কিছুর সাথে শর্তযুক্ত করা হয়নি। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ ‘‘শির্ক ছাড়া অন্যান্য যে সব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন’’। সুতরাং ক্ষমা পাওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে শির্ক থেকে বেঁচে থাকা। ফলে যেই গুনাহর প্রকৃত অবস্থা ঠিক এ রকমই অর্থাৎ যাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না, তাতে লিপ্ত ব্যক্তির নাজাতের কোন আশা নেই। তবে মৃত্যুর পূর্বে তাওবা করলে সে কথা ভিন্ন। ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার কাছে এ দু’আ করেছিলেনঃ

وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ

‘‘আমাকে এবং আমার সন্তানদের মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করো’’ (ইবরাহীমঃ ৩৫) ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন আল্লাহর খাঁটি বন্ধু। খুল্লাত তথা খাঁটি বন্ধুত্বের স্তর হাবীব বা মুহাববাতের স্তর হতে অনেক উর্ধ্বে। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা তাঁর দু’জন প্রিয় বান্দাকে খলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ইবরাহীম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইবরাহীম (আঃ)এর কথা আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে শির্ক হতে বাঁচাও। এই আয়াতটি বান্দার জন্য ভয়ের কারণ। ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ্ তাআলা একটি উম্মত বানিয়েছেন এবং বেশ কিছু বিষয় দিয়ে তাকে পরীক্ষা করেছেন। আর তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও যদি ইবরাহীম (আঃ) শির্ককে ভয় করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃوَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّى ‘‘এবং ইবরাহীমের কিতাবে, যে তার দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছিল’’। (সূরা নাজমঃ ৩৭) আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে জবেহ করার আদেশ দিলে তিনি তাঁর প্রভুর সেই আদেশ পালন করেছেন। তিনি মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেছেন এবং মুশরিকদের কড়া প্রতিবাদ করেছেন। এত কিছু করার পরও তিনি শির্কের ফিতনায় পড়ার আশঙ্কা করতেন। কেননা তিনি জানতেন আল্লাহর হেদায়াত ও তাওফীকই কেবল তাঁকে এ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে। স্বীয় ক্ষমতা ও কৌশল প্রয়োগ করে এ থেকে বাঁচার কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে ইবরাহীম আত্ তাইমী অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেনঃ ইবরাহীমের পরে আর কে মসীবত থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?[1]

এটি এমন একটি বিষয় যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে কেউ নিরাপদ নয়। সম্মানিত তিন যুগের পর এই উম্মতের অনেক জ্ঞানী লোকও এই অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে মূর্তিগুলোকেই মাবুদ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেগুলোর পূজা করা হয়েছে। ইবরাহীম খলীল (আঃ) নিজের উপর এবং তাঁর সন্তানদের উপর যেই বিষয়ের ভয় করতেন, তাতে সম্মানিত তিন যুগের পর এই উম্মতের অধিকাংশ লোকই লিপ্ত হয়েছে। কবরগুলোর উপর মসজিদ ও গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে এবং তাতে নানা প্রকার এবাদত পেশ করা হচ্ছে। লোকেরা এটিকেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছে। এই কবর ও মাজারগুলো নূহ (আঃ)এর জাতির মূর্তির স্থলাভিষিক্ত। এগুলোর মধ্যে এবং লাত, মানাত, উয্যা এবং আরব ও অন্যদের মূর্তির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

প্রিয় পাঠক! এই উম্মতের আখেরী যামানার লোকদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করুন। জাহেলী যামানার আরব ও অন্যান্য মুশরিকদের অবস্থার সাথে একদম মিলে গেছে। তাদের শির্ক তাওহীদে উলুহীয়াতের মধ্যেই সীমিত নয়; এবাদতের সীমা পার হয়ে রুবুবীয়াতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। ইবরাহীম খলীল (আঃ) যেই কারণে নিজের উপর এবং তাঁর বংশধরের উপর শির্কের ভয় করেছেন আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইবরাহীমের ২৬ নং আয়াতে তাঁর কথা উল্লেখ করে বলেনঃ

رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘‘হে আমার প্রতিপালক! এরা অনেক মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব, যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার অন্তর্ভূক্ত এবং যে কেউ আমার নাফরমানী করবে নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। ইবরাহীম (আঃ)এর যামানায়, তার পূর্বে এবং তাঁর পরে বহু জাতি বিভ্রান্ত হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে মানব জাতির অবস্থা এবং তারা যেই বড় বড় শির্কে লিপ্ত হয়েছে তা বুঝতে সক্ষম হবে। অথচ এই শির্কে লিপ্ত হতে নিষেধ করার জন্য এবং যারা এতে লিপ্ত হবে, তাদেরকে শাস্তির ভয় দেখানোর জন্যই আল্লাহ্ তাআলা নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। যারা শির্ক বর্জন করবে তাদের জন্য নবী-রাসূলগণ ছাওয়াবের ঘোষণাও দিয়েছেন। কুরআন থেকে বিমুখ থাকার কারণে এবং আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে যেই আদেশ দিয়েছেন ও যা থেকে নিষেধ করেছেন তা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে আল্লাহ্ তাআলা অনেক জাতিকে ধ্বংস করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ইসলামের উপর অটল রাখেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাওহীদের উপর দৃঢ়পদ রাখেন। তিনিই এর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ পাপের কাজ হতে বিরত রাখতে পারেনা এবং আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আনুগত্যের কাজে অন্য কোন তাওফীক দাতা নেই। আল্লাহ্ তাআলা সূরা মায়েদার ১১৮ নং আয়াতে বলেনঃ

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো, তবে তুমিই পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাবান’’। এই আয়াতে ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) খৃষ্টান মুশরিকদের ক্ষমা বা শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর উপর সোপর্দ করে দিয়েছেন, তেমনি ইবরাহীম (আঃ)ও তাদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।[2] আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যেই কুরআন নাযিল হয়েছে তাতে মুশরিকদের ব্যাপারে তাঁর হুকুম হল তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। উভয় আয়াতের মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মুশরিকদের ব্যাপারে তাঁর ফয়সালা প্রদান করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ফুসসিলাতের ৪২ নং আয়াতে বলেনঃ

لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ

‘‘এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’’। (সূরা ফুস্সিলাতঃ ৪২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«أخوف ما أخاف عليكم الشرك الأصغر فسئل عنه فقال الرياء»

‘‘আমি তোমাদের জন্য যে জিনিসের সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হচ্ছে শির্কে আসগার অর্থাৎ ছোট শিরক। শির্কে আসগার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, ছোট শির্ক হচ্ছে রিয়া’’ অর্থাৎ মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করা’’।[3] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের উপর শির্কের ভয় করতেন। অথচ তারা কেবল এক আল্লাহরই এবাদত করতেন, তাদেরকে যেই আদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা শুধু তাই করতেন। সুতরাং তারা হিজরত করেছেন, তাদের নবী তাদেরকে যেই তাওহীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, তারা তা খুব ভালভাবেই বুঝেছিলেন এবং এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা এবং শির্ক থেকে মুক্ত থাকার যেই হুকুম আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে নাযিল করেছেন, তাও তারা খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছেন। সুতরাং যারা ইল্ম ও আমলে সাহাবীদের সমকক্ষ নন, তাদের উপর শির্কের ভয় করবেন না- এটা কিভাবে হতে পারে?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে বড় শির্ক প্রবেশ করবে বলে আগাম সংবাদ দিয়েছেন। ছাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِى بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى تَعْبُدَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِى الأَوْثَانَ

‘‘আমার উম্মতের বিরাট একটি জামাআত মুশরিকদের সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত এবং তাদের একটি দল মূর্তিপূজায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না’’।[4] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন, তাই হয়েছে। অধিকাংশ অঞ্চলেই এই ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছে। শির্ক নিষিদ্ধ হওয়া এবং অনেক সহীহ হাদীছ ও কুরআনের অনেক সুস্পষ্ট আয়াতে তা থেকে ভয় দেখানোর পরও লোকেরা শির্ককেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ

‘‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করবে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিবেন, তার স্থান হবে জাহান্নাম’’। (সূরা মায়েদাঃ ৭২) আল্লাহ্ তাআলা সূরা হজ্জের ৩০ ও ৩১ নং আয়াতে বলেনঃ

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ حُنَفَاء لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ

‘‘সুতরাং তোমরা বর্জন করো মূর্তিপূজার অপবিত্রতা এবং দূরে থাকো মিথ্যা কথা থেকে। আল্লাহ্‌র দিকে একনিষ্ঠ হয়ে, তাঁর সাথে শরীক না করে। এটিই হচ্ছে সেই তাওহীদ যার আলোচনা পূর্বের অধ্যায়েও করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে শির্ক থেকে সতর্ক করে সূরা হজ্জের ৩১ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاء فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

‘‘যে কেউ আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করল সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে নিক্ষেপ করল’’। এই আয়াতের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পরও যে ব্যক্তি এবাদতের ক্ষেত্রে শির্ক থেকে বাঁচতে পারবেনা তার হেদায়াতের কোন আশা নেই।

ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«مَنْ مَاتَ وَهْوَ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ»

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অনুরূপ কাউকে আহবান করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[5]

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে শির্ক থেকে সাবধান ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন মৃত অথবা অনুপস্থিত ব্যক্তিকে আহবান করে এবং স্বীয় মুখমণ্ডল ও অন্তরকে তার দিকেই ধাবিত করে, তার কাছেই আশা করে, তাকেই ভয় করে, চাই তার কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করুক বা না করুক- এটিই হচ্ছে সেই শির্ক, যা আল্লাহ্ তাআলা ক্ষমা করবেন না। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে সুপারিশকারী বানানো হারাম করেছেন এবং যারা এরূপ করবে কঠোর ভাষায় তাদের প্রতিবাদ করেছেন। কেননা এটি ইখলাসের পরিপন্থী। আর বান্দা যে সমস্ত বিষয়কে ভয় করে, যা কিছু সে কামনা করে, যার মাধ্যমে সে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে এবং যে সমস্ত বিষয়কে সে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে তাতে মন-প্রাণ ও মুখমণ্ডলসহ আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার নামই হচ্ছে ইখলাস। আর এটি জানা কথা যে, বান্দা যখন কোনো সুপারিশকারীর দিকে দৃষ্টি দিবে এবং তার কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করবে, সে অন্তর ও মুখমণ্ডলসহ আল্লাহ্ তাআলা থেকে বিমুখ হল এবং তিনি ব্যতীত অন্যের দিকে মুখ ফিরাল। আর এটিই ইখলাসের পরিপন্থী। শাফাআত অধ্যায়ে এ বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আসবে ইনশা-আল্লাহ্।

সহীহ মুসলিমে সাহাবী জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন

«مَنْ لَقِىَ اللَّهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ»

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[6]

ব্যাখ্যাঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যু বরণ করবে,- এ কথার মধ্যেই ইখলাসের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে এ কথার আলোচনা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে- এটিই হচ্ছে শির্কের ব্যাখ্যা। সুতরাং যে ব্যক্তি শির্ক করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তার শির্ক কম হোক বা বেশী, তাতে কিছু আসে যায়না। শির্কে আকবার করলে কোন আমলই কবুল হওয়ার যোগ্য থাকেনা। শির্কে আকবারে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং তথায় চিরস্থায়ী হবে। তবে শির্কে আসগার যেমন রিয়া করা, এরূপ কথা বলাঃ আল্লাহ্ যা চান এবং তুমি যা চাও, আল্লাহ্ এবং তুমি ব্যতীত আমার আর কেউ নেই, এ ধরণের কথা বলা কুফরী নয়। তবে এ ধরণের কথার কারণে বান্দার নেকীর পাল্লার তুলনায় গুনাহ্এর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।

কতক আলেম বলেনঃ এখানে শুধু শির্ক না করাকেই যথেষ্ট মনে করার কারণ হল এর দ্বারা তাওহীদের দাবী সাব্যস্ত হয়ে যায়। সেই সাথে এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক নবী-রাসূল প্রেরণের বিষয়টিও আবশ্যিকভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলদেরকে অস্বীকার করল, সে আল্লাহ্কেই অস্বীকার করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলাকে অস্বীকার করল, সে মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে। সুতরাং উপরোক্ত হাদীছগুলোতে শির্ক না করে মৃত্যু বরণ করার তাৎপর্য হল যেসব বিষয়ের উপর ঈমান আনয়ন করা জরুরী সে সকল বিষয়ের উপর ঈমান আনয়ন করে। ঈমানের যে সমস্ত বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে তাতে সেভাবেই এবং যে সমস্ত বিষয় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে সেভাবেই ঈমান আনয়ন করে থাকে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) শির্ককে ভয় করে চলতে হবে।

২) রিয়া শির্কের মধ্যে শামিল।

৩) রিয়া হল ছোট শির্কের অন্তর্ভূক্ত।

৪) সৎ লোকদের জন্য ভয়ের বস্ত্তসমূহের মধ্যে সর্বাধিক ভীতিপ্রদ বিষয় হচ্ছে শির্কে আসগার তথা ছোট শির্ক।

৫) জান্নাত ও জাহান্নাম মানুষের একদম কাছাকাছি।

৬) জান্নাত ও জাহান্নাম নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি একই হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

৭) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বানিয়ে মৃত্যু বরণ করলে মৃত ব্যক্তি যত বড় এবাদতকারীই হোক না কেন, সে জাহান্নামে যাবে।

৮) ইবরাহীম খলীল (আঃ)এর দুআর প্রধান বিষয় হচ্ছে, তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা তথা শির্ক থেকে রক্ষা করা হোক।

৯) رب أنهن أضللن كثيرا من الناس ‘‘হে আমার রব! এ মূর্তিগুলো বহু লোককে গুমরাহ করেছে’’ এ কথা দ্বারা ইবরাহীম (আঃ) বহু লোকের অবস্থা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করেছেন।

১০) এখানে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র তাফসীর রয়েছে। যা ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।

১১) শির্ক মুক্ত ব্যক্তির মর্যাদা।

[1] - এই অর্থেই ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালামের উক্তিটি এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ وَلَا أَخَافُ مَا تُشْرِكُونَ بِهِ إِلَّا أَن يَشَاءَ رَبِّي شَيْئًا ‘‘এবং তোমরা যাদেরকে তাঁর সাথে শরীক করছো তাদেরকে আমি ভয় করি না, তবে আমার রব যদি অন্য কিছু চান তাহলে অন্য কথা’’। (সূরা আনআমঃ ৮০) শুআইব আলাইহিস সালাম বলেছেনঃوَمَا يَكُونُ لَنَا أَن نَّعُودَ فِيهَا إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا ‘‘আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া আর কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে আমাদের রব আল্লাহ যদি না চান, তাহলে সে কথা ভিন্ন’’। (সূরা আরাফঃ ৮৯)



[2] - এখানে একটু অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এভাবে বললে বিষয়টি পরিস্কার হবে বলে মনে হচেছঃ ইবরাহীম খলীল (আঃ) বলেছেন

رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘‘হে আমার প্রতিপালক, এরা অনেক মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব, যে আমার অনুসরণ করে সে আমার অন্তর্ভূক্ত এবং যে কেউ আমার অবাধ্যতা করবে নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। এখানে ইবরাহীম (আঃ) তাওহীদের বিরোধীতাকারীদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন ঈসা (আঃ) তাঁর জাতির বিষয়টি আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেনঃ

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো, তবে তুমিই পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাবান’’।

মুশরেকদের বিষয়টি আল্লাহর দিকে সোপদ করে দেয়ার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। বরং যারা মুশরেক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, তাদের হুকুম আল্লাহ তাআলা আমাদের শরীয়তের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا

‘‘আল্লাহ অবশ্যই শির্ক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না৷ এ ছাড়া অন্যান্য যত গুনাহ হোক না কেন তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেছে সে তো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গুনাহ্র কাজ করেছে’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮)

[3] - মুসনাদে আহমাদ, দেখুন সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ৫৯১।

[4] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ ফিতনার আলোচনা। দেখুনঃ আলবানী (রঃ)এর তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৫৪০৬।

[5] - বুখারী, অধ্যায়ঃ আল্লাহর বাণীঃ আর এমন অনেক লোক রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষ সাব্যস্ত করে।

[6] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ যে ব্যক্তি শির্ক না করে মৃত্যু বরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।