বড় শির্ক ও ছোট শির্ক ছোট শির্কের প্রকারভেদ (ক . প্রকাশ্য শির্ক) মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি

তা’বীয-কবচের শির্ক বলতে বালা-মুসীবত, কুদৃষ্টি ইত্যাদি দূরীকরণ অথবা প্রতিরোধের জন্য দানা গোটা, কড়ি কঙ্কর, কাষ্ঠ খন্ড, খড়কুটো, কাগজ, ধাত ইত্যাদি শরীরের যে কোন অঙ্গে ঝুলানোকে বুঝানো হয়।

শরীয়তের দৃষ্টিতে রোগ নিরাময়ের জন্য দু’টি জায়িয মাধ্যম অবলম্বন করা যেতে পারে। যা নিম্নরূপ:

ক. শরীয়ত সমর্থিত মাধ্যম। যা দো’আ ও জায়িয ঝাঁড় ফুঁকের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। যা ক্রিয়াশীল হওয়া কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত। এ মাধ্যমটি গ্রহণ করা আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল হওয়াই প্রমাণ করে। কারণ, তিনি নিজেই বান্দাহ্কে এ মাধ্যম গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন।

খ. প্রকৃতিগত মাধ্যম। যা মাধ্যম হওয়া মানুষের বোধ ও বিবেক প্রমাণ করে। যেমন: পানি পিপাসা নিবারণের মাধ্যম। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তৈরিকৃত ওষুধ নির্ধারিত রোগ নিরাময়ের মাধ্যম।

তাবিজ কবচ উক্ত মাধ্যম দু’টোর কোনটিরই অধীন নয়। না শরীয়ত উহাকে সমর্থন করে, না প্রকৃতিগতভাবে উহা কোন ব্যাপারে ক্রিয়াশীল। অতএব তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

« وَإِنْ يَّمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ، وَإِنْ يُّرِدْكَ بِخَيْـرٍ فَلاَ رَادَّ لِفَضْلِهِ، يُصِيْبُ بِهِ مَنْ يَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهِ، وَهُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ »

‘‘যদি আল্ল­াহ্ তা’আলা তোমাকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন করেন তাহলে তিনিই একমাত্র তোমাকে তা থেকে উদ্ধার করতে পারেন। আর যদি তিনি তোমার কোন কল্যাণ করতে চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহের গতিরোধ করার সাধ্য কারোর নেই। তিনি নিজ বান্দাহদের মধ্য থেকে যাকে চান অনুগ্রহ করেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়ালু’’। (ইউনুস : ১০৭)

তিনি আরো বলেন:

« وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ »

‘‘একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপরই ভরসা করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো’’। (মায়িদাহ্ : ২৩)

আবু মা’বাদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:

مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا ؛ وُكِلَ إِلَيْهِ

‘‘কেউ কোন বস্ত্ত কোন মাকসুদে শরীর বা অন্য কোথাও ঝুলিয়ে রাখলে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে উহার প্রতিই সোপর্দ করেন তথা তার মাকসুদটি পূর্ণ করা হয়না বরং যা হবার তাই হয়ে যায়’’। (তিরমিযী, হাদীস ২০৭২)

’আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:

إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ

‘‘নিশ্চয়ই ঝাঁড় ফুঁক, তাবিজ কবচ ও ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার্য যে কোন বস্ত্ত শির্ক’’। (আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৩ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৫৯৬)

’উক্ববা বিন্ ’আমির (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

أَقْبَلَ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم رَهْطٌ، فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ، فَقَالُوْا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! بَايَعْتَ تِسْعَةً وَأَمْسَكْتَ عَنْ هَذَا؟ قَالَ: إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيْمَةً، فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا، فَبَايَعَهُ وَ قَالَ: مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ

‘‘রাসূল (সা.) এর নিকট দশ জন ব্যক্তি আসলে তিনি তম্মধ্যে নয় জনকেই বায়’আত করান। তবে এক জনকে বায়’আত করাননি। সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি নয় জনকেই বায়’আত করিয়েছেন। তবে একে করাননি কেন? তিনি বললেন: তার হাতে তাবিজ আছে। অতঃপর লোকটি তাবিজটি ছিঁড়ে ফেললে রাসূল (সা.) তাকে বায়’আত করিয়ে বললেন: যে তাবিজ কবচ ঝুলালো সে শির্ক করলো’’। (আহমাদ : ৪/১৫৬)

সাঈদ বিন্ জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

مَنْ قَطَعَ تَمِيْمَةً مِنْ إِنْسَانٍ كَانَ كَعِدْلِ رَقَبَةٍ

‘‘যে ব্যক্তি কারোর তাবিজ কবচ কেটে ফেললো তার আমলনামায় একটি গোলাম আযাদের সাওয়াব লেখা হবে’’।

বিশেষভাবে জানতে হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলী এবং কোর’আন মাজীদের আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীস দিয়ে তাবিজ কবচ করার ব্যাপারে সাহাবাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিলো।

আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আমর বিন্ ’আস্ (রা.) ও ’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এ জাতীয় তাবিজ কবচ জায়িয হওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। আবু জা’ফর মুহাম্মাদ্ আল্ বাক্বির ও ইমাম আহমাদ (এক বর্ণনায়) এবং ইমাম ইবনুল্ কাইয়িম (রাহিমাহুমুল্লাহ্) ও এ মতের সমর্থন করেন।

অন্য দিকে ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ্, ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আব্বাস, হুযাইফা, ’উক্ববা বিন্ ’আমির, ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উক্বাইম এবং ’আলক্বামা, ইব্রাহীম বিন্ ইয়াযীদ্ নাখা’য়ী, আস্ওয়াদ্, আবু ওয়া’ইল্, ’হারিস্ বিন্ সুওয়াইদ্, ’উবাইদাহ্ সাল্মানী, মাসরূক্ব, রাবী’ বিন্ খাইসাম্, সুওয়াইদ্ বিন্ গাফলা (রাহিমাহুমুল্লাহ্) সহ আরো অন্যান্য বহু সাহাবী ও তাবিয়ীন তাবিজ ও কবচ না জায়িয বা শির্ক হওয়ার ব্যাপারে মত ব্যক্ত করেন। ইমাম আহমাদও (এক বর্ণনায়) এ মত গ্রহণ করেন। চাই তা কোর’আন ও হাদীস এবং আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলী দিয়ে হোক অথবা চাই তা অন্য কিছু দিয়ে হোক। কারণ, হাদীসের মধ্যে তাবিজ ও কবচ শির্ক হওয়ার ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাতে কোন পার্থক্য করা হয়নি এবং এ ব্যাপকতা হাদীস বর্ণনাকারীরাও বুঝেছেন। শুধু আমরাই নয়।

অন্য দিকে তাবিজ ও কবচ জায়িয হওয়ার ব্যাপারটিকে ঝাঁড় ফুঁকের সাথে তুলনা করা যায়না। কারণ, ঝাঁড় ফুঁকের মধ্যে কাগজ, চামড়া ইত্যাদির প্রয়োজন হয়না যেমনিভাবে তা প্রয়োজন হয় তাবিজ ও কবচের মধ্যে। বরং তাবিজ ও কবচ না জায়িয হওয়ার ব্যাপারকে শির্ক মিশ্রিত ঝাঁড় ফুঁকের সাথে সহজেই তুলনা করা যেতে পারে।

যখন অধিকাংশ সাহাবা ও তাবিয়ীন সে স্বর্ণ যুগে কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক তাবিজ ও কবচ দেয়া না জায়িয বা অপছন্দ করেছেন তা হলে এ ফিতনার যুগে যে যুগে তাবিজ ও কবচ দেয়া বিনা পুঁজিতে লাভজনক একটি ভিন্ন পেশা হিসেবে রূপ নিয়েছে কিভাবে তা জায়িয হতে পারে? কারণ, এ যুগে তাবিজ ও কবচ দিয়ে সকল ধরনের হারাম কাজ করা হয় এবং এ যুগের তাবিজদাতারা এর সাথে অনেক শির্ক ও কুফরের সংমিশ্রণ করে থাকে। তারা মানুষকে সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল না করে নিজের তাবিজ ও কবচের উপর নির্ভরশীল করে। এমনকি অনেক তাবিজদাতা এমনও রয়েছে যে, কেউ তার নিকট এসে কোন সামান্য সমস্যা তুলে ধরলে সে নিজ থেকে আরো কিছু বাড়িয়ে তা আরো ফলাও করে বর্ণনা করতে থাকে। যাতে খদ্দেরটি কোনভাবেই হাতছাড়া না হয়ে যায়। তাতে করে মানুষ আল্লাহ্ভক্ত না হয়ে তাবিজ বা তাবিজদাতার কঠিন ভক্ত হয়ে যায়।

মোটকথা, কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক তাবিজ কবচ দেয়া বহু হারাম কাজ ও বহু শির্কের গুরুত্বপূর্ণ বাহন। যা প্রতিহত করা দল মত নির্বিশেষে সকল মুসলমানেরই কর্তব্য। এরই পাশাপাশি তাবিজ ও কবচ ব্যবহারে কোর’আন ও হাদীসের প্রচুর অপমান ও অসম্মান হয় যা বিস্তারিতভাবে বলার এতটুকুও অপেক্ষা রাখে না।