খৃস্টান প্রচারকগণ আমাদের বুঝাতে চান যে, ইসলামেই শুধু জিহাদ আছে! অথচ বাইবেল, বেদ, গীতা ও সকল ধর্মগ্রন্থেই জিহাদ বা যুদ্ধ বিদ্যমান। ইসলামে রাষ্ট্র ও নাগরিক ও ধর্মের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যই জিহাদের বিধান। কিতাল বা জিহাদ বৈধ হওয়ার প্রথম শর্ত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “রাষ্টপ্রধান ঢাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবে” (বুখারী ও মুসলিম)। দ্বিতীয় শর্ত রাষ্ট্র বা মুসলিমের নিরাপত্তা। আল্লাহ বলেন: “যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে” (সূরা ২২-হজ্জ ৩৯)। তৃতীয় শর্ত সন্ধি ও শান্তির সুযোগ গ্রহণ। আল্লাহ বলেন: “আর যদি তারা সন্ধির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও তার প্রতি ঝুঁকে পড়, আর আল্লাহর উপর নির্ভর কর, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” (সূরা ৮-আনফাল: ৬২)। চতুর্থ শর্ত: শুধু যোদ্ধা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত। আল্লাহ বলেন: “তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের সাথে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে। কিন্তু সীমালঙ্ঘন করবে না, আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না” (সূরা ২-বাকারা: ১৯০)।
যুদ্ধের ময়দানেও ধর্মযাজক, নারী, শিশু বা কোনো অযোদ্ধাকে আক্রমণ নিষেধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যুদ্ধে তোমরা প্রতারণা বা ধোঁকার আশ্রয় নেবে না, চুক্তিভঙ্গ করবে না, কোনো মানুষ বা প্রাণীর মৃতদেহ বিকৃত করবে না বা অসম্মান করবে না, কোনো শিশু-কিশোরকে হত্যা করবে না, কোনো মহিলাকে হত্যা করবে না, কোনো গীর্জাবাসী, সন্ন্যাসী বা ধর্মযাজককে হত্যা করবে না, কোনো বৃদ্ধকে হত্যা করবে না, কোনো অসুস্থ মানুষকে হত্যা করবে না, কোনো বাড়িঘর ধ্বংস করবে না, খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া গরু, উট বা কোনো প্রাণী বধ করবে না, যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাছ কাটবে না...। তোমরা দয়া ও কল্যাণ করবে, কারণ আল্লাহ দয়াকারী- কল্যাণকারীদেরকে ভালবাসেন” (বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৯/৯০)।
কিতাবুল মোকাদ্দসের জিহাদের চিত্র ভিন্ন। শুধু যুদ্ধের ময়দানেই নয়, যুদ্ধবন্দী, নিরস্ত্র নারী, পুরুষ, শিশু ও অবলা প্রাণী নির্বিচারে হত্যা করতে (গণনা পুস্তক ৩১/১৭-১৮; দ্বিতীয় বিবরণ ২০/১৩-১৬; ১ শমূয়েল ২৭/৮-৯), বিধর্মীদের উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলতে (যাত্রাপুস্তক ২৩/২৩-২৪; যাত্রপুস্তক ৩৪/১২-১৩), সরলপ্রাণ বিধর্মীদেরকে খানাপিনার নামে ডেকে নিয়ে হত্যা করতে (১ রাজাবলি ১৮/৪০; ২ রাজাবলি ১০/১৮-২৮), নিরস্ত্র বন্দীদেরকে জবাই করতে বা পুড়িয়ে মারতে (২ শমূয়েল ১২/২৯-৩১) নির্দেশনা প্রদান করেছে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’।
অযোদ্ধা ও যুদ্ধবন্দী নারী, পুরুষ ও শিশুদের নির্বিচারে ও গণহারে হত্যার বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসের বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুদ্ধবন্দীদের কত বেশি কষ্ট দিয়ে হত্যা করা যায় সে বিষয়েও আগ্রহ লক্ষণীয়। লোহার মইয়ের নিচে রেখে, লোহার কুড়ালির নিচে রেখে এবং ইটের পাঁজার মধ্যে ঢুকিয়ে বা অনুরূপভাবে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা দিয়ে নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যার নির্দেশনা বাইবেলে প্রচুর। এগুলি থেকে মনে হয়, বাইবেলের জিহাদ বা যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, এমনকি অন্যের দেশ দখলের জন্যও যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ মূলত হত্যা ও ধ্বংসের মাধ্যমে আনন্দলাভের জন্য। ইঞ্জিল শরীফে এ সকল কর্মের বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে (নতুন নিয়ম, ইব্রীয় ১১/৩২-৩৪)।
বাইবেলে যুদ্ধ, হত্যা ও প্রতিশোধের ক্ষেত্রে কোনোরূপ নৈতিকার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় নি। ইসলামে যুদ্ধের জন্য গোপনীয়তা ও শত্রুপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য কৌশল অবলম্বন বৈধ করেছে। কিন্তু চুক্তিভঙ্গ করা, প্রবঞ্চনা করা, নিরস্ত্রকে আক্রমন করা, অযোদ্ধা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা, আহতদের হত্যা করা, মৃতদেহ অপমান করা ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এরূপ সকল কর্মই বাইবেলীয় জিহাদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই।
ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন: আমরাই শান্তি চাই ও প্রতিষ্ঠা করি? কেননা ঈসা কোনো যুদ্ধ করেনি। আর মুহাম্মাদ (সা) অনেক যুদ্ধ করে মানুষ হত্যা করেছে, তাই তিনি শান্তি ও ভালবাসার নবী হতে পারেন না। (নাঊযু বিল্লাহ!)
সম্মানিত পাঠক, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও ভালবাসা প্রতিষ্ঠার জন্যই জিহাদ করেছেন। রাষ্ট্র থাকলেই যুদ্ধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে যুদ্ধকে যথাসম্ভব কম ধ্বংসাত্মক করতে হবে এবং অযোদ্ধা লক্ষ্য থেকে দূরে রাখতে হবে। ইসলামে এ কাজটি সর্বোত্তমভাবে করা হয়েছে তাত্ত্বিকভাবে এবং প্রায়োগিকভাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব কম প্রাণহানি ঘটাতে। শুধু জুলুম বা আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং তার সারাজীবনের সকল যুদ্ধে মুসলিম ও কাফির মিলে সর্বমোট প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। যে দেশে প্রতি মাসেই শতশত মানুষ খুন হতো, সে দেশে মাত্র সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে সকল হানাহানি রোধ করে তিনি বিশ্বব্যাপী চিরস্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পক্ষান্তরে বাইবেলের একেক যুদ্ধেই হাজার হাজার “কাফির” হত্যার গৌরবময় বিবরণ লেখা হয়েছে। মহাভারত, গীতা বা রামায়ণের যুদ্ধেরও কাছাকাছি অবস্থা।
আমরা মুসলিমগণ বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত ঈসা (আঃ)-ও শান্তির নবী ছিলেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফ প্রমাণ করে তিনি অশান্তির নবী ছিলেন। ইঞ্জিলে তিনি বলেন: “মনে করিও না যে, আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে আসিয়াছি; শান্তি দিতে আসি নাই, কিন্তু খড়্গ দিতে আসিয়াছি (I came not to send peace but a sword)। কেননা আমি পিতার সহিত পুত্রের, মাতার সহিত কন্যার এবং শ্বাশুড়ির সহিত বধূর বিচ্ছেদ জন্মাইতে আসিয়াছি।” (মথি ১০/৩৪-৩৫)
ইঞ্জিলের যীশু যুদ্ধ করার সুযোগ পান নি, তবে তাঁর রাজত্বের বিরোধীদের গণহত্যা করতে তাঁর নির্দেশ দেখুন: "But those mine enemies, which would not that I should reign over them, bring hither, and slay them before me", “পরন্তু আমার এই যে শত্রুগণ ইচ্ছা করে নাই যে, আমি তাহাদের উপরে রাজত্ব করি, তাহাদিগকে এই স্থানে আন, আর আমার সাক্ষাতে বধ কর।” (লূক ১৯/২৭)
শুধু রাজত্ব অপছন্দ করার কারণে ধরে এনে জবাই!! তাও আবার নিজের সামনে! জবাই-এর সময় কিভাবে মানুষ ছটফট করে তা দেখতে? মানুষের রক্ত দেখে মন ঠান্ডা করতে? এরূপ ভয়ঙ্কর নির্দেশ কী কোনো মানুষ প্রদান করতে পারেন?
ঈসায়ী প্রচারকগণ মুসলিমদেরকে বলেন: “ইসলাম যদি সঠিক হয় তাহলে মুসলিমদের মধ্যে এত দল কেন?” সরল মুসলিমগণ না জানলেও, খৃস্টানগণ ভালভাবেই জানেন যে, খৃস্টানদের দলাদলির কাছে মুসলিমদের দলাদলি কিছুই নয়। পাঠক “ত্রিত্ববাদের ব্যাখ্যা” অনুচ্ছেদে এবং উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আর্টিকেলগুলি ইন্টারনেটে পড়লেই বুঝতে পারবেন যে, মুসলিম, ইয়াহূদী, বিধর্মী ও খৃ্স্টধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ (Crusades) ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা (Inquisition)-ই নয়, খৃস্টানগণ নিজেদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ-মারামারি করে অন্তত কয়েক কোটি খৃস্টান নিহত হয়েছেন। অগণিত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিককে সামান্য মতভেদের কারণে হত্যা করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দস ও ইঞ্জিলের জিহাদ ও শত্রু হত্যা বিষয়ক উপরের নির্দেশনাগুলির তাঁরা ঠিকমতই পালন করেছেন। এজন্যই নোবেল বিজয়ী প্রসিদ্ধ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell: ১৮৭২-১৯৭০) বলেন:
"You find as you look around the world that every single bit of progress in human feeling, every improvement in the criminal law, every step towards the diminution of war, every step towards better treatment of coloured races, or every mitigation of slavery, every moral progress that there has been in the world, has been consistently opposed by the organized Churches of the world. I say quite deliberately that the Christian religion, as organized in the churches, has been and still is the principal enemy of moral progress in the world." (Bertrand Russell, Why I am not a Christian, pp 20-21, quoted from Dr. Abdul Hamid Qadri, Dimensions of Christianity, pp 40-41.)
“বিশ্বের চারিদিকে তাকালে আপনি দেখবেন যে, বিশ্বের যেখানেই মানবীয় অনুভবের যে কোনো ক্ষুদ্রতম অগ্রগতি, অপরাধ-আইনের যে কোনো উন্নয়ন, যুদ্ধ হ্রাসে যে কোনো পদক্ষেপ, কাল বা অ-সাদা বর্ণের মানুষদের সাথে উন্নততর আচরণের ক্ষেত্রে যে কোনো পদক্ষেপ, দাসপ্রথা বিলুপ্তির যে কোনো প্রচেষ্টা এবং নৈতিক উন্নয়ন যে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তারই বিরোধিতা করেছে খৃস্টীয় চার্চ নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আমি পরিপূর্ণ সতর্কতা ও সুচিন্তিতভাবে বলছি যে, চার্চ পরিচালিত খৃস্টধর্মই বিশ্বের নৈতিক উন্নয়নের প্রধান শত্রু ছিল এবং এখনো আছে।”
বর্তমানেও উচ্চশিক্ষিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘উদার’ খৃস্টানদের মধ্যে আমরা যে সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাই সেরূপ সাম্প্রদায়িকতা আমরা মুর্খ কোনো মুসলিম জঙ্গির মধ্যেও দেখতে পাই না। শান্তি ও ভালবাসার প্রচারক খৃস্টানগণ, অন্য ধর্মের পবিত্র ব্যক্তি বা গ্রন্থের অবমাননা, হত্যা ও জোরপূর্বক ধর্মান্তর ছাড়া কিছুই বুঝেন না। কুরআন পোড়ানো, টয়লেটে ফেলা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য সিনেমা-কার্টুন বানানো ইত্যাদি খৃস্টান পাদরি ও পণ্ডিতদের সুপরিচিত কর্ম।
আমেরিকার প্রসিদ্ধ ও প্রভাবশালী সাংবাদিক ও লেখিকা অ্যান কালটার (Ann Coulter) জঙ্গিবাদ দমনের জন্য সকল মুসলিম দেশ দখল করে মুসলিমদেরকে জোরপূর্বক খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করার দাবি জানিয়ে লিখেন: "we should invade their countries, kill their leaders and convert them to Christianity." “আমাদের উচিত তাদের দেশগুলি আক্রমন করা, তাদের নেতাদেরকে হত্যা করা এবং ধর্মান্তরিত করে তাদেরকে খৃস্টান বানানো।” (The Wisdom of Ann Coulter, The Independent (Dhaka), 8/9/2006, p 12.) এরূপ দাবী খৃস্টান পণ্ডিতগণ পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় প্রতিদিন করছেন।
অথচ মুসলিম অন্য মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার বা কাউকে জোর পূর্বক ধর্মান্তরিত করার কথা চিন্তাও করেন না। আমরা দেখছি যে, সবচেয়ে সহিংস মুসলিম সন্ত্রাসীও অন্যের ধর্মকে অবমাননা করার চেষ্টা করছে না বা অন্য ধর্মের মানুষকে জবরদস্তি করে মুসলিম বানানোর আহবান করছে না। শান্তি ও ভালবাসার প্রচারক! ঈসায়ী পাদরিগণ কুরআন পোড়াচ্ছেন, টয়লেটে ফেলছেন! মুসলিমদের নবীকে নিয়ে ঘৃণ্য কার্টুন ও সিনেমা তৈরি করছেন। সারা বিশ্বের মুসলিমগণ এ ঘৃণ্য বর্বরতার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা মার্কিন বা ডেনিশ পতাকায় অথবা এ সব দেশের রাজনীতিবিদদের কুশপুত্তলিকায় অগ্নিসংযোগ করেছেন। কিন্তু কখনোই কোনো মুসলিম খৃস্টানদের পবিত্র ব্যক্তি বা গ্রন্থের অবমাননা করেন নি বা করতে বলেন নি।