(ক) ৩, ৫ ও ১০-এর বিভ্রাট
বনী ইস্রায়েলের মূল পিতা ইসরায়েল (ইয়াকুব আ)-এর ১২ পুত্রের একপুত্র বিন্যামীন (বিন্ইয়ামীন)। তাঁর পুত্রগণের বিষয়ে সাংঘর্ষিক বর্ণনা লক্ষ্য করুন:
১-বংশাবলি ৭/৬: “বিন্যামীনের সন্তান- বেলা, বেখর ও যিদীয়েল, তিন জন।”
পক্ষান্তরে ১-বংশাবলি ৮/১: “বিন্যামীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বেলা, দ্বিতীয় অস্বেল, তৃতীয় অহর্হ, চতুর্থ নোহা ও পঞ্চম রাফা।”
কিন্তু আদিপুস্তক ৪৬/২১: “বিন্যামীনের পুত্র বেলা, বেখর, অস্বেল, গেরা, নামন, এহী, রোশ, মুপ্পীম, হুপ্পীম ও অর্দ।”
বিন্যামিনের সন্তান সংখ্যা প্রথম বক্তব্যে তিনজন এবং দ্বিতীয় বক্তব্যে পাঁচজন। তাদের নামের বর্ণনাও পরস্পর বিরোধী, শুধু বেলার নামটি উভয় শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকিদের নাম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর তৃতীয় শ্লোকে বিন্যামীনের সন্তান সংখ্যা দশজন। নামগুলিও আলাদা। তৃতীয় শ্লোকের নামগুলির সাথে প্রথম শ্লোকের সাথে দুজনের নামের এবং দ্বিতীয় শ্লোকের দুজনের নামের মিল আছে। আর তিনটি শ্লোকের মিল আছে একমাত্র “বেলা” নামটি উল্লেখের ক্ষেত্রে।
(খ) মাত্র তিন লক্ষের হেরফের!
দায়ূদের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি যোয়াব লোকসংখ্যা গণনা করেন। এ বিষয়ে শমূয়েলের দ্বিতীয় পুস্তকের ২৪ অধ্যায়ের ৯ম শ্লোকটি নিম্নরূপ: “পরে যোয়াব গণিত লোকেদের সংখ্যা রাজার কাছে দিলেন; ইস্রায়েলে খড়্গ-ধারী আট লক্ষ বলবান লোক ছিল; আর যিহূদার পাঁচ লক্ষ লোক ছিল।”
অপর দিকে বংশাবলি প্রথম খন্ডের ২১ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোক নিম্নরূপ: “আর যোয়াব গণিত লোকদের সংখ্যা দায়ূদের কাছে দিলেন। সমস্ত ইস্রায়েলের এগার লক্ষ খড়্গধারী লোক, ও যিহূদার চারি লক্ষ সত্তর সহস্র খড়্গধারী লোক ছিল।”
প্রথম বর্ণনায় ইস্রায়েলের যোদ্ধাসংখ্যা ৮ লক্ষ এবং যিহূদার ৫ লক্ষ। আর দ্বিতীয় বর্ণনামতে ১১ লক্ষ ও ৪ লক্ষ ৭০ হাজার। উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরীত্যের পরিমাণ দেখুন! ইস্রায়েলের জনসংখ্যা বর্ণনায় মাত্র ৩ লক্ষের কমবেশি এবং যিহূদার জনসংখ্যার বর্ণনায় ত্রিশ হাজারের কমবেশি। পবিত্র আত্মার কারসাজি?!
(গ) ভুলটি কার? যীশুর? পবিত্র আত্মার? না বেনামি লেখকের?
মার্ক লিখেছেন ২/২৫-২৬: “তিনি (যীশু) তাহাদিগকে (ইয়াহূদী ফরীশীগণকে) কহিলেন, দায়ূদ ও তাঁহার সঙ্গীরা খাদ্যের অভাবে ক্ষুধিত হইলে তিনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহা কি তোমরা কখনো পাঠ কর নাই? তিনি ত অবিয়াথর মহাযাজকের সময়ে ঈশ্বরের গৃহে প্রবেশ করিয়া, যে দর্শন-রুটী যাজকবর্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও ভোজন করা বিধেয় নয়, তাহাই ভোজন করিয়াছিলেন, এবং সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন।”
১ শমূয়েল ২১ ও ২২ অধ্যায় থেকে প্রমাণিত যে, এ কথাটি ভুল। কারণ ‘দর্শন-রুটী’ ভোজন করার সময় দায়ূদ ‘একা’ ছিলেন, তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। কাজেই ‘ও তাঁহার সঙ্গীরা’ এবং ‘সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন’ দুটি কথাই ভুল। এছাড়া এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মহাযাজকের নাম ছিল ‘অহীমেলক’। ‘অবিয়াথর’ এ সময়ে যাজক ছিলেন না। অর্থাৎ যীশু অথবা পবিত্র আত্মা কিতাবুল মোকাদ্দস জানতেন না!
অন্যত্র ঈসা মাসীহ বলেছেন: “আর স্বর্গে কেহ উঠে নাই; কেবল যিনি স্বর্গ হইতে নামিয়াছেন, সেই মনুষ্যপুত্র, যিনি স্বর্গে থাকেন।” (যোহন ৩/১৩) তাওরাতের ভাষ্যে এ কথাটি ভুল। কারণ হনোক (Enoch: ইদরীস) এবং এলিয় (Eli'jah: আল-ইয়াসা’) উভয়ে স্বর্গে গমন করেছেন (আদিপুস্তক ৫/২৩-২৪; ২ রাজাবলি ২/১-১১।) অর্থাৎ যীশু বা ইঞ্জিল লেখক পবিত্র(!) আত্মা ‘আল্লাহর কালাম’ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন।
যীশুর পিতামাতা তাঁকে নিয়ে মিসর থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে নাসরৎ নামক শহরে বসবাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে মথি বলেন: “এবং নাসরৎ নামক নগরে গিয়া বসতি করিলেন; যেন ভাববাদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন।” (মথি ২/২৩) ইঞ্জিলের এ কথাটি অসত্য; কোনো ভাববাদীর কোনো পুস্তকেই এ কথা নেই। কিন্তু পবিত্র আত্মা তা জানতেন না!
ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা ৩০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে যীশুকে ইয়াহূদীদের কাছে ধরিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে মথি বলেন ২৭/৯: “তখন যিরমিয় ভাববাদী দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হইল, ‘আর তাহারা সেই ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রা লইল।” কথাটি অসত্য। এ বাক্যটি বা এ অর্থে কোনো বাক্য যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তকের কোথাও নেই।
যীশুর বংশাবলি-পত্রে লূক লিখেছেন (৩/২৭): “ইনি যোহানার পুত্র, ইনি রীষার পুত্র, ইনি সরুববাবিলের পুত্র, ইনি শল্টীয়েলের পুত্র ইনি নেরির পুত্র”।
পুরাতন নিয়ম থেকে প্রমাণিত যে এখানে তিনটি অসত্য তথ্য রয়েছে: প্রথমত: “রীষা সরুববাবিলের পুত্র” কথাটি অসত্য। মথি লিখেছেন (১/১২-১৩) “সরুববাবিলের পুত্র অবীহূদ।” লূক ও মথি দুজনের কথাই অসত্য। কারণ ১ বংশাবলি ৩/১৯-এ রয়েছে যে, সরুববাবিলের ৫টি পুত্র ছিল, তাদের মধ্যে (রীষা) বা (অবীহূদ) নামে কোনো পুত্র ছিল না। দ্বিতীয়ত: সরুববাবিল শল্টীয়েলের পুত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন পদায়ের পুত্র। হ্যাঁ, তিনি শল্টীয়েলের ভাতিজা ছিলেন। (১ বংশাবলি ৩/১৭-১৮) তৃতীয়ত: শল্টীয়েলের পিতার নাম নেরি ছিল না। তার পিতার নাম ছিল যিকনিয় (যিহোয়াখীন)। (১ বংশাবলি ৩/১৭ ও মথি ১/১২)
(ঘ) যীশুর পিতার দুজন পিতা!
আমরা দেখেছি যে, প্রচলিত ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম নয়। এর মধ্যে আল্লাহর কোনো বাণী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মূল বিষয় যীশু খৃস্ট। অথচ যীশু খৃস্টের পরিচয়েও ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য! এক ব্যক্তির দুজন পিতা!!
মথি এবং লূক উভয়ে যীশুর বংশ তালিকা প্রদান করেছেন (মথি: ১/১-১৬ ও লূক: ৩/২৩-৩৮)। যদি কেউ উভয় তালিকার তুলনা করেন তাহলে উভয়ের মধ্যে অনেক বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা দেখতে পাবেন, যেগুলির মধ্যে রয়েছে:
- যীশুর দাদার নাম: মথি বলেন: যাকোব কিন্তু লূক বলেন: এলি। দু পিতার একপুত্র!
- মথি থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র শলোমনের বংশধর। লূক থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র নাথন-এর বংশধর।
- মথির ভাষ্যে দায়ূদ থেকে ব্যবিলনের নির্বাসন পর্যন্ত যীশুর পূর্বপুরুষগণ সকলেই সুপ্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। লূকের বর্ণনায় দায়ূদ ও নাথন বাদে যীশুর পুর্বপুরুষগণের মধ্যে কেউই রাজা বা কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন না।
- মথির বিবরণ অনুযায়ী দায়ূদ থেকে যীশু পর্যন্ত উভয়ের মাঝে ২৬ প্রজন্ম। আর লূকের বর্ণনা অনুযায়ী উভয়ের মাঝে ৪১ প্রজন্ম।
- মথি বলেন (১/১৭): “এভাবে ইব্রাহিম থেকে দাউদ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; ব্যাবিলনে বন্দী হবার পর থেকে মসীহ্ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ।”
এখানে দুটি সুনিশ্চিত ও প্রমাণিত অসত্য তথ্য বিদ্যমান:
প্রথমত, এখানে বলা হলো: যীশুর বংশতালিকা তিন অংশে বিভক্ত, প্রত্যেক অংশে ১৪ পুরুষ, তাহলে মোট ৪২ পুরুষ। এ কথাটি সুস্পষ্ট ভুল। মথির ১/১-১৭-র বংশ তালিকায় যীশু থেকে আবরাহাম পর্যন্ত ৪২ পুরুষ নয়, বরং ৪১ পুরুষের উল্লেখ রয়েছে। যে কোনো পাঠক গণনা করলেই তা জানতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, মথির বক্তব্য: “দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ”- মারাত্মক ভুল। ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায় থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এ পর্যায়ে ১৮ পুরুষ ছিল, ১৪ পুরুষ নয়। আরো লক্ষণীয় যে, বংশাবলি ও মথি- বাইবেলের দু স্থানেই স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তির জনক। মথি তালিকার বিভিন্ন স্থান থেকে চার পুরুষ ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও লিখেছেন যে, পূর্ববতী ব্যক্তি পরের ব্যক্তির সরাসরি জনক। তিনি এতেও ক্ষান্ত হন নি। উপরন্তু এদের মাঝে যে আর কেউ ছিল না নিশ্চিত করতে এ পর্যায়ে সর্বমোট ১৪ পুরুষ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
এজন্য প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ কার্ডিনাল জন হেনরী নিউম্যান (১৮০১-১৮৯০) আফসোস করে বলেন, “খৃস্টধর্মে একথা বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনে এক হয় বা তিন ও এক একই সংখ্যা। কিন্তু এখন একথাও বিশ্বাস করা জরুরী হয়ে গেল যে, ১৪ এবং ১৮ একই সংখ্যা; কারণ পবিত্র গ্রন্থে কোনো ভুল থাকার সম্ভাবনা নেই!”
আমরা তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি, ৪১ ও ৪২ একই সংখ্যা!