৬. তাকে (ভালো) উপদেশ দেওয়া, যখন সে কোনো বিষয় বা ব্যাপারে উপদেশ বা পরামর্শ চায়; অর্থাৎ সে কোনো বিষয় বা ব্যাপারে যা উত্তম ও সঠিক মনে করবে, তা তাকে বলে দেবে; আর এটা এ জন্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إِذَا اسْتَنْصَحَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيَنْصَحْ لَهُ » . (رواه البخاري).
“যখন তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের কাছে উপদেশ বা পরামর্শ চাইবে, তখন সে যেন তাকে ভালো উপদেশ দেয়।”[1] তিনি আরও বলেন:
« الدِّينُ النَّصِيحَةُ ، قُلْنَا : لِمَنْ ؟ قَالَ : لِلَّهِ ، وَلِكِتَابِهِ ، وَلِرَسُولِهِ ، وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ ، وَعَامَّتِهِمْ » . (رواه مسلم).
“দীন হচ্ছে (জনগণের) কল্যাণ কামনা করা। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? তিনি বললেন: আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল, মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও সমস্ত মুসলিমের জন্য।”[2] আর মুসলিম ব্যক্তি তো তাদের সকলের মধ্য থেকে একজন।
৭. নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, তার জন্যও তা পছন্দ করা এবং নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে, তার জন্যও তা অপছন্দ করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« لا يُؤمِنُ أحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحبُّ لِنَفْسِهِ ، و يكرَهُ لَهُ ما يَكرَهُ لِنَفْسِهِ » . (رواه البخاري و مسلم و أحمد).
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করবে এবং তার নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে, তার ভাইয়ের জন্যও তা অপছন্দ করবে।”[3] তিনি আরও বলেন:
« مَثَلُ المُؤْمِنينَ في تَوَادِّهِمْ وتَرَاحُمهمْ وَتَعَاطُفِهمْ ، مَثَلُ الجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الجَسَدِ بِالسَّهَرِ والحُمَّى » . (متفق عليه).
“পারস্পরিক ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মায়া-মমতার দৃষ্টিকোণ থেকে গোটা মুসলিম জাতি একটি দেহের সমতুল্য; যখন তার একটি অঙ্গ ব্যথিত হয়, তখন তার গোটা শরীর তা অনুভব করে— সেটা জাগ্রত অবস্থায়ই হউক, কিংবা জ্বরের অবস্থায়।”[4] তিনি আরও বলেন:
« المُؤْمِنُ للْمُؤْمِنِ كَالبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضَاً » . (متفق عليه).
“এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরস্বরূপ, এর এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে।”[5]
৮. যেখানেই তার সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার দরকার, সেখানেই তাকে সাহায্য করা এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন না করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« انْصُرْ أخَاكَ ظَالماً أَوْ مَظْلُوماً ، فَقَالَ رجل : يَا رَسُول اللهِ ، أنْصُرُهُ إِذَا كَانَ مَظْلُوماً ، أرَأيْتَ إنْ كَانَ ظَالِماً كَيْفَ أنْصُرُهُ ؟ قَالَ : تحْجُزُهُ أَوْ تمْنَعُهُ مِنَ الظُلْمِ فَإِنَّ ذلِكَ نَصرُهُ » . (متفق عليه).
“তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে যালেম হউক অথবা মাযলুম; একথা বলার পর এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! সে যদি মাযলুম হয়, আমি তাকে সাহায্য করব— এটা বুঝতে পারলাম; সে যালিম হলে আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করব— সে ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? তখন তিনি বললেন: তাকে যুলুম করা থেকে বিরত রাখ, বাধা দাও; এটাই হল তাকে সাহায্য করা।”[6] তিনি আরও বলেন:
« المُسْلِمُ أخُو المُسْلم : لاَ يَظْلِمُهُ ، وَلاَ يَخْذُلُهُ ، وَلا يَحْقِرُهُ » . (متفق عليه).
“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই; সে তার প্রতি যুলুম করবে না, তাকে অপমান করবে না এবং তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না।”[7] তিনি আরও বলেন:
« ما من امرئٍ مسلمٍ ينصُرُ مسلماً في موضعٍ يُنْتَهَكُ فيه عرضُهُ ، وتُسْتَحَلُّ فيه حرمتُهُ إلاَّ نصرهُ اللهُ في موطنٍ يُحِبُّ فيه نَصْرَهُ ، وما من امرئٍ مسلمٍ خَذَلَ مسلماً في موطنٍ تُنْتَهَكُ فيه حرمتُهُ إلاَّ خذلهُ اللهُ في موضعٍ يُحِبُّ فيه نَصْرَهُ » . (رواه أحمد).
“যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি অপর কোনো মুসলিমকে সাহায্য করবে এমন কোনো স্থানে, যেখানে তার চরিত্রকে কলুষিত করা হয় এবং তার সম্মানকে নষ্ট করা হয়, আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য পাওয়াটাকে পছন্দ করবে। আর যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি অপর কোনো মুসলিমকে অপমান করবে এমন কোনো স্থানে, যেখানে তার সম্মানকে নষ্ট করা হয়, আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন স্থানে অপমানিত করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য পাওয়াটাকে কামনা করবে।”[8] তিনি আরও বলেন:
« مَنْ رَدَّ عَنْ عِرْضِ أَخِيهِ رَدَّ اللَّهُ عَنْ وَجْهِهِ النَّارَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ » . (رواه الترمذي).
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মান-সম্মান নষ্ট করা থেকে নিজে বিরত থাকবে বা কাউকে বিরত রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।”[9]
৯. তাকে কোনো মন্দ কিছুর দ্বারা আক্রমণ না করা অথবা তাকে কোনো অপছন্দনীয় কিছুতে না জড়ানো; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ » . (رواه مسلم).
“প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান অপর সব মুসলিমের জন্য হারাম।”[10] তিনি আরও বলেন:
« لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يُرَوِّعَ مُسْلِمًا » . (رواه أحمد و أبو داود).
“কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য অপর কোনো মুসলিমকে ভয় দোখানো বৈধ নয়।”[11] তিনি আরও বলেন:
« لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يُشِيرَ إِلَى أَخِيهِ بِنَظْرَةٍ تُؤْذِيهِ » . (رواه أحمد).
“কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকানো বৈধ নয়, যে দৃষ্টি তাকে কষ্ট দেয়।”[12] তিনি আরও বলেন:
« إِنَّ اللَّهَ يَكْرَهُ أَذَى الْمُؤْمِنِيْنَ » . (رواه أحمد).
“আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের কষ্টকে অপছন্দ করেন।”[13] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
« الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ » . (متفق عليه).
“মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্যান্য মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।”[14] তিনি আরও বলেন:
« الْمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ المؤمِنُونَ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ » . (رواه أحمد و الترمذي و الحاكم).
“মুমিন সেই ব্যক্তি, যার কাছে অন্যান্য মুমিনগণ তাদের জীবন ও সম্পদের ব্যাপারে নিরাপদে থাকে।”[15]
১০. তার সাথে বিনয়ী হওয়া এবং তার উপর অহঙ্কার প্রদর্শন না করা; আর নিজে বসার জন্য তাকে তার বৈধ বসার জায়গা থেকে উঠিয়ে না দেওয়া; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨ ﴾ [لقمان: ١٨]
“আর তুমি মানুষের প্রতি অবজ্ঞাভরে তোমার গাল বাঁকা কর না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন উদ্ধত, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।”[16] তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إِنَّ اللَّهَ أَوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ » . (رواه أبو داود و ابن ماجه).
“আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট অহী পাঠিয়েছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও, যাতে কেউ কারও উপর অহঙ্কার প্রকাশ না করে।”[17] তিনি আরও বলেন:
« ما تَواضعَ أحدٌ لله إلا رفعهُ اللهُ تعالى » . (رواه الترمذي).
“যে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় প্রকাশ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করবেন।”[18] তাছাড়া একথা সর্বজন বিদিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মুসলিমের সাথে বিনয়ী ছিলেন, অথচ তিনি হলেন নবী-রাসূলগণের সর্দার; তাছাড়া তিনি নিঃস্ব ও মিসকীনদের সাথে হাঁটতে এবং তাদের সমস্যা সমাধান করতে উদ্ধতভাব ও অহঙ্কার প্রদর্শন করতেন না, বরং তিনি বলতেন:
« اللَّهُمَّ أَحْيِنِى مِسْكِيناً ، وَأَمِتْنِى مِسْكِيناً ، وَاحْشُرْنِى فِى زُمْرَةِ الْمَسَاكِينِ » . (رواه ابن ماجه و الحاكم).
“হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীন অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখ, মিসকীন অবস্থায় মৃত্যু দান করিও এবং মিসকীনদের মাঝে আমার হাশরের ব্যবস্থা করিও।”[19] তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
« لا يُقِيمَنَّ أحَدُكُمْ رَجُلاً مِنْ مَجْلِسِهِ ثُمَّ يَجْلِسُ فِيهِ ، وَلكِنْ تَوَسَّعُوا وَتَفَسَّحُوا » . (متفق عليه).
“তোমাদের কেউ যেন কোনো ব্যক্তিকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেখানে না বসে; বরং তোমরা জায়গা বিস্তৃত করে দাও এবং ছড়িয়ে বসো।”[20]
[2] মুসলিম, হাদিস নং- ২০৫
[3] বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ; তবে « و يكرَهُ لَهُ ما يَكرَهُ لِنَفْسِهِ » কথাটি বুখারী ও মুসলিমে নেই; বরং তা ইমাম আহমাদ রহ. এর ‘আল-মুসনাদ’ এর মধ্যে রয়েছে, যার শব্দগুলো নিম্নরূপ:
« وَأَنْ تُحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ ، وَتَكْرَهَ لَهُمْ مَا تَكْرَهُ لِنَفْسِكَ »
“তোমার নিজের জন্য তুমি যা পছন্দ করবে, জনগণের জন্যও তা পছন্দ করা এবং তোমার নিজের জন্য তুমি যা অপছন্দ করবে, তাদের জন্যও তা অপছন্দ করা।” — (হাদিস নং- ২২১৮৩)।
[4] বুখারী, হাদিস নং- ৫৬৬৫; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭৫১
[5] বুখারী, হাদিস নং- ৪৬৭; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭৫০
[6] বুখারী, হাদিস নং- ৬৫৫২; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭৪৭
[7] বুখারী, হাদিস নং- ৬৫৫১; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭০৬
[8] আহমাদ।
[9] তিরমিযী, হাদিস নং- ১৯৩১
[10] মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭০৬
[11] আহমাদ ও আবূ দাউদ এবং হাদিসটি সহীহ।
[12] আহমাদ ।
[13] আহমাদ রহ. উৎকৃষ্ট সনদে হাদিসটি বর্ণনা করছেন।
[14] বুখারী, হাদিস নং- ১০; মুসলিম, হাদিস নং- ১৭১
[15] আহমাদ, তিরমিযী ও হাকেম এবং হাদিসটি সহীহ।
[16] সূরা লোকমান, আয়াত: ১৮
[17] আবূ দাউদ ও ইবনু মাজাহ এবং হাদিসটি সহীহ।
[18] তিরমিযী, হাদিস নং- ২০২৯
[19] ইবনু মাজাহ ও হাকেম।
[20] বুখারী, হাদিস নং- ৫৯১৪; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৮১২