মুসলিম ব্যক্তি স্বীকার করে যে, পিতার উপর তার সন্তানের কতগুলো অধিকার রয়েছে, যা আদায় করা তার উপর ওয়াজিব এবং এমন কতগুলো আদব রয়েছে, যেগুলো তার সন্তানের সাথে রক্ষা করে চলা আবশ্যক; উদাহরণস্বরূপ সেসব অধিকার ও আদব হলো— তার জন্য ভালো মা পছন্দ করা, সুন্দর নাম রাখা, তার জন্মের সপ্তম দিবসে তার পক্ষ থেকে আকীকা করা, খাতনা করা, তাকে স্নেহ করা, তার সাথে কোমল আচরণ করা, তার জন্য ব্যয় করা এবং তাকে উত্তম শিক্ষা দেওয়া; আর তার শিক্ষাদীক্ষা, আদব-কায়দা, ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশাবলী গ্রহণ এবং ইসলামের ফরয, সুন্নাত ও আদবসমূহ পালন ও অনুশীলনের ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করা; এমনকি যখন বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করা; অতঃপর তাকে এ ব্যাপারে স্বাধীনতা দেওয়া— সে কী তার তত্ত্ববধানে থেকে যাবে, না কী পৃথকভাবে জীবনযাপন করবে এবং নিজ হাতে তার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থন তৈরি করবে। আর তার জন্য এসব অধিকার ও আদবের প্রশ্নে আল-কুরআন ও সুন্নাহ’র নিম্নোক্ত দলীলসমূহ রয়েছে:
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ۞وَٱلۡوَٰلِدَٰتُ يُرۡضِعۡنَ أَوۡلَٰدَهُنَّ حَوۡلَيۡنِ كَامِلَيۡنِۖ لِمَنۡ أَرَادَ أَن يُتِمَّ ٱلرَّضَاعَةَۚ وَعَلَى ٱلۡمَوۡلُودِ لَهُۥ رِزۡقُهُنَّ وَكِسۡوَتُهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ ﴾ [البقرة: ٢٣٣]
“আর জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্য পান করাবে, এটা সে ব্যক্তির জন্য, যে স্তন্যপান কাল পূর্ণ করতে চায়। পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের (মাতাদের) ভরণ-পোষণ করা।”[1] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ عَلَيۡهَا مَلَٰٓئِكَةٌ غِلَاظٞ شِدَادٞ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦ ﴾ [التحريم: ٦]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাব ফেরেশ্তাগণ, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদেশপ্রাপ্ত হয় তা-ই কর।”[2] সুতরাং এ আয়াতের মধ্যে পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার নির্দেশ রয়েছে; আর এটা সম্ভব হবে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার দ্বারা; আর আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে দেয় কোন্ কোন্ বিষয়ে তাঁর আনুগত্য করা হবে, সে বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া; আর এটা জ্ঞান অর্জন ব্যতীত সম্ভব নয়। আর সন্তান যখন ঐ ব্যক্তির গোটা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একজন সদস্য, তখন উপরিউক্ত আয়াতটি এমন এক দলীল হবে, যা পিতা কর্তৃক তার সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া, ভালো পথে পরিচালিত করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা, তাকে কুফর, অবাধ্যতা ও যাবতীয় অন্যায় অনাচার থেকে দূরে রাখার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি তার উপর ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত করবে, যাতে তিনি এর দ্বারা তার সন্তানকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেন। যেমনিভাবে প্রথম আয়াত:
وَٱلۡوَٰلِدَٰتُ يُرۡضِعۡنَ أَوۡلَٰدَهُنَّ حَوۡلَيۡنِ كَامِلَيۡنِۖ
(আর জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্য পান করাবে) -এর মধ্যে দলীল রয়েছে পিতার উপর সন্তানের ব্যয়ভার বহন করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে; কেননা, তার সন্তানকে দুধ পান করানোর কারণেই স্তন্যদায়ীনীর জন্য খরচ বরাদ্দ করাটা আবশ্যক হয়। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُمۡ خَشۡيَةَ إِمۡلَٰقٖۖ
“তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না।”[3]
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন মহাপাপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি বলেন:
« أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ ، ثُمَّ أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ خَشْيَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ ، ثُمَّ أَنْ تُزَانِيَ بِحَلِيلَةِ جَارِكَ » . (متفق عليه).
“কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর তোমার সাথে খাবে, এই ভয়ে তোমার সন্তানকে হত্যা করা; অতঃপর তোমার কর্তৃক তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা।”[4] সুতরাং সন্তানদেরকে হত্যা করা থেকে নিষেধ করার বিষয়টিই আবশ্যক করে দেয় তাদের প্রতি স্নেহ ও মমতার বিষয়টিকে এবং আরও জরুরি করে দেয় তাদের শরীর, বুদ্ধি ও মনকে সংরক্ষণ করার বিষয়টিকে। আর সন্তানের জন্য ‘আকীকার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« الغلامُ مُرتَهَنُ بعَقيِقتِه ، تُذبَحُ عنه يوم السابع ، ويُسمى فيه ، ويُحلَق رأسُه » . (رواه البخاري و أصحاب السنن).
“নবজাতক দায়বদ্ধ তার আকীকার শর্তে, যা তার পক্ষ থেকে যবেহ করা হবে তার জন্মের সপ্তম দিবসে; আর সে দিনে তার নাম রাখা হবে এবং তার মাথা মুণ্ডন করা হবে।”[5] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« الْفِطْرَةُ خَمْسٌ : الاخْتِتَانُ ، وَالاسْتِحْدَادُ ، وَقَصُّ الشَّارِبِ ، وَتَقْلِيمُ الأَظْفَارِ ، وَنَتْفُ الإِبْطِ » . (رواه البخاري) .
“ফিতরাত (মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব) পাঁচটি: খাতনা করা, (নাভীর নীচে) খুর ব্যবহার করা, গোঁফ ছোট করা, নখ কাটা ও বগলের পশম উপড়ে ফেলা।”[6] তিনি আরও বলেন:
« أكرموا أولادكم وأحسنوا أدبهم » . (رواه ابن ماجه) .
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে আদর যত্ন কর এবং তাদের আদব-কায়দাকে সুন্দর কর।”[7] তিনি আরও বলেন:
« سَوُّوا بَيْنَ أَوْلادِكُمْ فِي الْعَطِيَّةِ ، فَلَوْ كُنْتُ مُفَضِّلا لَفَضَّلْتُ النِّسَاءَ » . (رواه البيهقي و الطبراني).
“তোমরা উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর; কারণ, আমি যদি কাউকে (এ ক্ষেত্রে) প্রাধান্য দিতাম, তাহলে নারীদেরকে প্রাধান্য দিতাম।”[8] তিনি আরও বলেন:
« مُرُوا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ , وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِينَ , وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِى الْمَضَاجِعِ » . (رواه أبو داود).
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সালাতে জন্য নির্দেশ দাও, যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয়; আর তাদেরকে সালাতের জন্য প্রহার কর, যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হয় এবং তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও।”[9] আর ‘আসার’ -এর মধ্যে এসেছে: পিতার উপর সন্তানের অন্যতম অধিকার হলো তার আদব-কায়দাকে সুন্দর করে দেওয়া এবং তার জন্য সুন্দর নাম রাখা।[10] আর ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: পিতার উপর সন্তানের অন্যতম অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া ও তীর নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তার জন্য শুধু পবিত্র ও হালাল রিযিকের ব্যবস্থা করা।[11] তিনি আরও বলেন:
« تزوجوا في الحجر الصالح ؛ فإن العرق دساس » .
“তোমরা ভালো বংশে বিয়ে কর; কারণ, বংশের শিরা-উপশিরা গুপ্তচরের মত।”[12] আর এক আরব বেদুইন তার সন্তানদের প্রতি সদয় ইহসান করেছেন তাদের মাকে পছন্দ করার মাধ্যমে; সুতরাং তিনি কবিতার ভাষায় বলেন:
وَأَوَّلُ إحْسَانِي إلَيْكُمْ تَخَيُّرِي
لِمَاجِدَةِ الْأَعْرَاقِ بَادٍ عَفَافُهَا
(আর তোমাদের প্রতি আমার প্রথম ইহসান হলো আমি বাছাই করেছিতোমাদের মাকে গৌরবময় বংশ থেকে, যার পবিত্রতা বা নিষ্কলুষতা সুস্পষ্ট)।[13]
>[2] সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬
[3] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩১
[4] বুখারী, হাদিস নং- ৬৪২৬; মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৭
[5] বুখারী ও সুনান চতুষ্টয়।
[6] বুখারী, হাদিস নং- ৫৫৫২
[7] ইবনু মাজাহ রহ. হাদিসটি দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন, হাদিস নং- ৩৬৭১
[8] বায়হাকী ও ত্ববারানী; আর হাফেয ‘আসকলানী হাদিসের সনদকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[9] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪৯৫
[10] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২৯
[11] প্রাগুক্ত
[12] আলবানী ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস হাদিসটিকে ‘মাউদু‘’ বলেছেন।
[13] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২৯