ঈদের সালাতের পূর্বে জামাতবদ্ধভাবে তাকবীর দেওয়ার হুকুমের ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা

প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি বিশ্বের প্রতিপালক, সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, তাঁর পরিবার পরিজন এবং তাঁর সকল সাহাবীগণের উপর। অতঃপর শাইখ আহমাদ ইবন মুহাম্মদ জামাল (আল্লাহ তার পছন্দনীয় ব্যাপারে তাকে তাওফীক দান করুন) কিছু এলাকা ভিত্তিক দৈনিক পত্রিকায় যা প্রচার করেছেন তা অবগত হয়েছি। মাসজিদে ঈদের সালাতের পূর্বে জামাতবদ্ধভাবে তাকবীর দেওয়া বিদ‘আত হিসাবে নিষেধ করায় তিনি আশ্চর্য্যবোধ করেছেন। তিনি তার উল্লেখিত লেখায় চেষ্টা করেছেন জামাতে তাকবীর দেওয়ার দলীল পেশ করে বলতে যে, তা বিদ‘আত নয় এবং তা থেকে নিষেধ করা ঠিক নয়, তার এ মতকে কিছু লেখকও সমর্থন দিয়েছেন।

যে ব্যক্তির আসল ব্যাপার জানা নেই, তার উপর গড়মিল লাগার ভয়ে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, তাকবীর দেওয়ার সঠিক নিয়ম হলো: ঈদের রাত্রি, রমাযানে ঈদের সালাতের পূর্বে, যিল- হজ্জের প্রথম দশ দিন এবং তাশরিকের দিনগুলোতে। এ সময়গুলোতে তাকবীর দেওয়া শরীয়তসম্মত এবং এতে বহু ফযিলত রয়েছে। ঈদুল ফিতরে তাকবীর দেওয়ার প্রমাণ হলো:

﴿ وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

“যেন তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদেরকে হেদায়েত দান করার কারণে আল্লহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। [সূরা বাকারা/১৮৪]

জিল হজ্জের প্রথম দশ দিন এবং তাশরিকের দিনগুলোতে তাকবীর দেওয়ার প্রমাণ হলো:

﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ ﴾ [الحج: ٢٨]

“যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুস্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসাবে দিয়েছেন ওর উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। [সূরা হজ্জ/২৮]

এবং

﴿ ۞وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ ﴾ [البقرة: ٢٠٣]

“আর তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর। [সূরা বাকারা/২০৩]

এ নির্দিষ্ট দিনগুলোতে যে যিকির পাঠ করা বৈধ তা হলো: তাকবীরে মুতলাক ও মুকাইয়াদ বা সাধারণ তাকবীর ও নির্দিষ্ট তাকবীর। আর এর প্রমাণ হলো হাদীস ও সালাফ তথা সম্মানিত পূর্বসূরীদের আমল।

বৈধ তাকবীরের নিয়ম হলো: প্রত্যেক মুসলিম একাকী জোরে আওয়াজ করে তাকবীর দিবে যেন অন্যরা শুনতে পায়, অতঃপর তারাও শুনে শুনে তাকবীর দিবে।

আর জামাতবদ্ধভাবে বিদ‘আতী তাকবীর হলো: দুইজন বা ততোধিক লোক একসাথে একই সুরে নির্দিষ্ট শব্দে আওয়াজ করে তাকবীর দিবে, একসাথে শুরু করবে এবং এক সাথেই শেষ করবে, এ পদ্ধতির যেমন কোনো ভিত্তি নেই তেমনি এর কোনো দলীলও নেই, বরং তা তাকবীরের শব্দের ক্ষেত্রে বিদ‘আত; যা করার প্রমাণ আল্লাহ অবতীর্ণ করেননি। কাজেই যে ব্যক্তি এ রকম তাকবীরের নিন্দা করবে সে হক্বের উপর থাকবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হলো,

«من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد»

“যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করবে যা আমার শরীয়ত সমর্থিত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”

এবং তাঁর বাণী :

«وإياكم ومحدثات الأمور فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة»

“(দ্বীনে) নব রচিত কর্মসমূহ হতে সাবধান থাক! কেননা প্রতিটি নব রচিত কর্ম হচ্ছে বিদ‘আত এবং সকল বিদ‘আত হচ্ছে ভ্রষ্টতা।”[1]

আর জামাতবদ্ধভাবে তাকবীর দেওয়া যেহেতু নব আবিষ্কৃত কাজ সুতরাং তা বিদ‘আত, আর মানুষ যদি শরীয়ত বিরোধী কোনো আমল করে তবে অবশ্যই এর নিন্দা করতে হবে এবং তাদেরকে নিষেধ করতে হবে, কেননা ইবাদত হলো “তাওক্বীফী” বা কুরআন ও হাদীসের উপর সীমাবদ্ধ, কাজেই কুরআন ও হাদীস যা প্রমাণ করবে শুধু তাই করা বৈধ। আর শর‘ঈ প্রমাণের বিরোধী মানুষের কোনো কথা ও মতামত কোনো প্রমাণ হতে পারে না, এমনিভাবে ‘মাসালেহ মুরসালা’ বা ‘জনস্বার্থ’ ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রমাণ হতে পারে না। বরং ইবাদত সাব্যস্ত হয় কুরআন, হাদীস ও সুস্পষ্ট ‘ইজমা’র দ্বারা।

বৈধ তাকবীর হলো : শর‘ঈ প্রমাণের ভিত্তিতে তাকবীরের যে শব্দ এবং পদ্ধতি সাব্যস্ত আছে, এর দ্বারা কোনো মুসলিম একাকী তাকবীর দেওয়া বৈধ।

সৌদী আরবের মুফতী মহামান্য শাইখ মুহাম্মদ ইবন ইব্রাহীম জামাতী তাকবীরের নিন্দা করে তা নিষেধ করেছেন এবং এ ব্যাপারে ফাতাওয়াও প্রকাশ করেছেন এবং আমার নিকট থেকেও এর নিন্দার বহু ফাতাওয়া প্রকাশিত হয়েছে। এমনিভাবে ফাতাওয়া ও গবেষণার স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে তা নিষেধের ফাতাওয়া বের হয়েছে। আর শাইখ হামূদ ইবন আব্দুল্লাহ আল তুয়াইজিরী তা নিন্দা করা ও নিষেধের ব্যাপারে মূল্যবান পুস্তক লিখেছেন এবং তা ছাপিয়ে প্রচার করা হচ্ছে, এতে তিনি জামাতী তাকবীর নিষেধের যথেষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এসেছেন।

আর ইবন উমর এবং অন্যান্য লোকজনের মিনাতে তাকবীর দেওয়ার ব্যাপারে শাইখ আহমাদ যে প্রমাণ পেশ করেছেন এর মধ্যে জামাতে তাকবীর দেওয়ার কোনো দলীল নেই, কারণ ইবন উমর ও লোকজনের মিনাতে তাকবীর দেওয়া জামাতবদ্ধভাবে ছিল না বরং তা ছিল শর‘ঈ তাকবীর। কেননা সুন্নাতের উপর আমল করতে গিয়ে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি একাকী জোরে আওয়াজ করে তাকবীর দিতেন এবং তা শুনে লোকজনও আলাদা আলাদাভাবে তাকবীর দিত। এতে ইবন উমর ও লোকজনের মধ্যে এমন কোনো কথা হয়নি যে, তারা জামাতবদ্ধভাবে একই সুরে একসাথে শুরু করবে এবং একসাথে শেষ করবে, যেমন বর্তমানে লোকজন জামাতী তাকবীর দিয়ে থাকে। এমনিভাবে সলফে সালেহীন থেকে তাকবীরের ব্যাপারে যত বর্ণনা আছে তা সবই শর‘ঈ পদ্ধতির উপর সীমাবদ্ধ। যে ব্যক্তি এর উল্টা বুঝবে তার প্রমাণ পেশ করা উচিৎ। তদ্রূপ ঈদের সালাত, তারাবীহ, রাত্রির সালাত এবং বিতর সালাতের জন্য মানুষকে ডাকা সবই বিদ‘আত, এর কোনো ভিত্তি নেই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু সহীহ হাদীস এসেছে যে, তিনি ঈদের সালাত আযান এবং ইকামা ব্যতীত আদায় করেছেন। আমার জানা মতে কোনো আলেম বলেননি যে, মানুষকে ডাকার জন্য নির্দিষ্ট শব্দ রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা বলবে সে যেন প্রমাণ পেশ করে, আসলে এর কোনো প্রমাণ নেই। যে কোনো ইবাদত কথা হোক বা কাজ হোক কুরআন ও হাদীসের বিনা দলীলে কারো জন্য সাব্যস্ত করা উচিৎ নয়। যেমন পূর্বে বলা হয়েছে।

বিদ‘আত প্রচলনের নিষেধ এবং এ থেকে সতর্ক থাকার শর‘ঈ প্রমাণাদি থাকার কারণে বিদ‘আত প্রচলন করা উচিৎ নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ﴾ [الشورا: ٢١]

“তাদের কি শরীক রয়েছে যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধান গড়বে যার অনুমতি আল্লাহ তাদের দেননি। [সূরা শূরা/২১]

এবং পূর্বে উল্লেখিত দু’টি হাদীস, আর তা হলো:

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد»

“যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো জিনিস সৃষ্টি করবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত”।

আর জুম‘আর খুৎবায় তাঁর ভাষণ ছিল:

«أما بعد، فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة»

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো: আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলো: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হেদায়েত। আর নিকৃষ্টতর কাজ হলো এর নব আবিষ্কৃত কাজ, এবং প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।” এ অর্থে বহু হাদীস ও বাণী রয়েছে।

আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য এবং শাইখ আহমাদসহ সকল মুসলিম ভাইয়ের জন্য দ্বীন সম্পর্কে বুঝার এবং এর উপর কায়েম থাকার তাওফীক প্রার্থনা করছি, আমাদের সকলকে যেন সঠিক পথের পথ প্রদর্শক করে হক্ব প্রতিষ্ঠার সহযোগী বানিয়ে দেন, এবং আমাদেরসহ সকল মুসলিমকে যেন এর পরিপন্থী বিষয়গুলো থেকে রক্ষা করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহান করুনাময়। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর তাঁর পরিবার পরিজন এবং তাঁর সকল সাহাবীগণের উপর।

নির্বাহী পরিচালক

দাওয়া, ইরশাদ, ফাতওয়া ও গবেষণা অফিসআল্লামা আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায র:

>
[1] আহমাদ ১৬৬৯৫, আবু দাউদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৬৭৬ এবং ইবনে মাজাহ ৪২