(৩) ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়া :

ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়া আবশ্যকীয় বিষয়, যা না পড়লে ছালাত হয় না। কিন্তু ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে ছালাত সরবে হোক বা নীরবে হোক প্রত্যেক ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। সূরা ফাতিহা না পড়ার পক্ষে যে সমস্ত বর্ণনা পেশ করা হয়, মুহাদ্দিছগণের নিকট সেগুলো সবই জাল ও যঈফ। এ নিয়ে তিন ধরনের আলোচনা রয়েছে। (এক) ছালাত জেহরী কিংবা সের্রী হোক অর্থাৎ সরবে ক্বিরাআত পড়া হোক আর নীরবে পড়া হোক ইমামের পিছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পড়তে পারবে না (দুই) সরবে ক্বিরাআত পড়া হলে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না। ইমাম নীরবে ক্বিরাআত পড়লে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পড়বে (তিন) সকল ছালাতে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। সর্বশেষ আমলটিই সর্বাধিক দলীল ভিত্তিক। প্রথম মতের পক্ষে কোন দলীলই নেই। শুধু অপব্যাখ্যা ও দলীয় গোঁড়ামীর কারণে এটি বাজারে চলছে। যদিও অধিকাংশ মুছল্লী এরই জালে আটকা পড়েছে। দ্বিতীয় মতের পক্ষে কিছু আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সূরা ফাতিহা না পড়ার দলীলগুলো পর্যালোচনা করা হল :

(1) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ انْصَرَفَ مِنْ صَلَاةٍ جَهَرَ فِيْهَا بِالْقِرَاءَةِ فَقَالَ هَلْ قَرَأَ مَعِىْ أَحَدٌ مِنْكُمْ آنِفًا فَقَالَ رَجُلٌ نَعَمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ إِنِّىْ أَقُوْلُ مَالِىْ أُنَازِعُ الْقُرْآنَ قَالَ فَانْتَهَى النَّاسُ عَنْ الْقِرَاءَةِ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ فِيْمَا جَهَرَ فِيْهِ رَسُوْلُ اللهِ مِنْ الصَّلَوَاتِ بِالْقِرَاءَةِ حِيْنَ سَمِعُوْا ذَلِكَ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ .

(১) আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা জেহরী ছালাতের সালাম ফিরিয়ে বললেন, এই মাত্র আমার সাথে তোমাদের কেউ কি ক্বিরাআত পড়ল? জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি পড়েছি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের সাথে কুরআন নিয়ে ঝগড়া করতে চাই না। উক্ত কথা শুনার পর লোকেরা জেহরী ছালাত সমূহে ক্বিরাআত পড়া হতে বিরত থাকল।[1]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন,

وَقَوْلُهُ فَانْتَهَى النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ الزُّهْرِىِّ وَقَدْ بَيَّنَهُ لِى الْحَسَنُ بْنُ الصَّبَّاحِ قَالَ حَدَّثَنَا مُبَشِّرٌ عَنِ الْأَوْزَاعِىِّ قَالَ الزُّهْرِىُّ فَاتَّعَظَ الْمُسْلِمُونَ بِذَلِكَ فَلَمْ يَكُونُوا يَقْرَءُونَ مَعَهُ فِيْمَا يَجْهَرُ بِهِ

মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া বলেন, ‘লোকেরা ক্বিরাআত পড়া বন্ধ করল’ এই কথাটি যুহরীর। এটা আমার কাছে বর্ণনা করেছেন হাসান ইবনু ছাবাহ। তিনি বলেন, মুবাশ্শার আমাকে আওযাঈ থেকে হাদীছ শুনিয়েছেন যে, যুহরী বলেছেন, মুসলিমরা এ ব্যাপারে উপদেশ গ্রহণ করেছে তাই তারা জেহরী ছালাতে ক্বিরাআত পড়ত না।[2]

মূলকথা হল ‘লোকেরা ক্বিরাআত পড়া বন্ধ করে দিল’ অংশটুকু যুহরীর পক্ষ থেকে সংযোজিত এবং মারাত্মক ভুল। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন,

فَانْتَهَى النَّاسُ إلَى آخِرِهِ مُدْرَجٌ فِي الْخَبَرِ مِنْ كَلَامِ الزُّهْرِيِّ بَيَّنَهُ الْخَطِيْبُ وَاتَّفَقَ عَلَيْهِ الْبُخَارِيُّ فِي التَّارِيْخِ وَأَبُوْدَاوُد وَيَعْقُوْبُ بْنُ سُفْيَانَ وَالذُّهْلِيُّ وَالْخَطَّابِيُّ وَغَيْرُهُمْ

‘মানুষরা ক্বিরাআত বন্ধ করে দিল’ অংশটুকু যুহরীর বক্তব্য হিসাবে হাদীছের সাথে সংযোজিত হয়েছে। খত্বীব এটি বর্ণনা করেছেন আর ইমাম বুখারী ‘তারীখের’ মধ্যে এর প্রতি একমত পোষণ করেছেন। অনুরূপ আবুদাঊদ, ইয়াকুব ইবনু সুফিয়ান, যুহলী, খাত্ত্বাবী সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছও একই মত ব্যক্ত করেছেন।[3] উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছকে আলবানী ছহীহ বলেছেন এবং জেহরী ছালাতে ক্বিরাআত না পড়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে তিনি যে অংশটুকু দ্বারা দলীল পেশ করেছেন তা মুহাদ্দিছগণের নিকট বিতর্কিত, যে পূর্বের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে।

(২) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ صَلَّى رَسُوْلُ اللهِ صَلاَةً فَلَمَّا قَضَاهَا قَالَ هَلْ قَرَأَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مَعِىْ بِشَىْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ أَنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنِّىْ أَقُوْلُ مَا لِىْ أُنَازِعُُ الْقُرْآنَ إِذَا أَسْرَرْتُ بِقِرَاءَتِى فَاقْرَءُوْا مَعِىْ وَإِذَا جَهَرْتُ بِقِرَاءَتِىْ فَلاَ يَقْرَأَنَّ مَعِىْ أَحَدٌ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) একদা কোন এক ছালাত আদায় করে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আমার সঙ্গে কুরআনের কিছু অংশ পড়েছে? জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি পড়েছি। তখন তিনি বললেন, কুরআনের সাথে আমার ঝগড়া করা উচিৎ নয়। যখন আমি নীরবে ক্বিরাআত পড়ব তখন তোমরা আমার সঙ্গে পড়বে আর যখন স্বরবে পড়ব তখন তোমরা আমার সঙ্গে কেউ পড়বে না।[4]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি মুনকার। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, যাকারিয়া নামক ব্যক্তি এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছে। সে অস্বীকৃত রাবী ও পরিত্যক্ত।[5] ইমাম বায়হাক্বী বলেন, এই বর্ণনার সনদে ভুল রয়েছে।[6] ইয়াকূব ইবনে সুফিয়ান বলেন, নিঃসন্দেহে এটা ভুল।[7]

(৩) عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ يُصَلِّى بِالنَّاسِ وَرَجُلٌ يَقْرَأُ خَلْفَهُ فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ مَنْ ذَا الَّذِىْ يُخَالِجُنِىْ سُوْرَتِىْ فَنَهَاهُمْ عَنِ الْقِرَاءَةِ خَلْفَ الإِمَامِ.

(৩) ইমরান ইবনু হুছাইন (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা মুছল্লীদের সাথে ছালাত পড়ছিলেন, আর জনৈক ব্যক্তি তার পিছনে ক্বিরাআত পড়ছিল। যখন তিনি ছালাত শেষ করলেন তখন বললেন, কোন্ ব্যক্তি সূরা পড়ে আমার সাথে দ্বন্দ্ব করল? অতঃপর তিনি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পড়তে নিষেধ করলেন।[8]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ ও মুনকার। ইমাম দারাকুৎনী ও বায়হাক্বী উভয়ে হাদীছটি বর্ণনা করে দুর্বল বলেছেন। এর সনদে হাজ্জাজ নামে একজন রাবী আছে। তার হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয় না।[9]

(৪) عَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ مَنْ قَرَأَ خَلْفَ الْإِمَامِ مُلِئَ فُوْهُ نارًا.

(৪) যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করবে তার মুখে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে।[10]

তাহক্বীক্ব : ডাহা মিথ্যা বর্ণনা। মুহাম্মাদ তাহের পাট্টানী বলেন, ‘এর সনদে মামূন বিন আহমাদ আল-হারভী আছে। সে বড় মিথ্যুক। জাল হাদীছ বর্ণনাকারী’।[11]

(5) قَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ وَدِدْتُ أَنَّ الَّذِىْ يَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ فِىْ فِيْهِ حَجَرٌ.

(৫) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, আমার ইচ্ছা করে ঐ ব্যক্তির মুখে পাথর মারতে, যে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করে।[12]

তাহকবীক্ব : উক্ত বর্ণনা মুনকার, ছহীহ নয়।[13] কারণ নিম্নের হাদীছটি তার প্রমাণ-

عَنْ يَزِيْدَ بْنِ شَرِيْكٍ أَنَّهُ سَأَلَ عُمَرَ عَنِ الْقِرَاءَةِ خَلْفَ الإِمَامِ فَقَالَ اقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ قُلْتُ وَإِنْ كُنْتَ أَنْتَ؟ قَالَ وَإِنْ كُنْتُ أَنَا قُلْتُ وَإِنْ جَهَرْتَ؟ قَالَ وَإِنْ جَهَرْتُ.

একদা ইয়াযীদ ইবনু শারীক ওমর (রাঃ)-কে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ কর। আমি বললাম, যদি আপনি ইমাম হৌন? তিনি বললেন, যদিও আমি ইমাম হই। আমি পুনরায় বললাম, যদি আপনি জোরে ক্বিরাআত পাঠ করেন? তিনি বললেন, যদিও আমি জোরে ক্বিরআত পাঠ করি।[14]

(৬) قَالَ ابْنُ مَسْعُوْدٍ وَدِدْتُ أَنَّ الَّذِىْ يَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ مُلِئَ فُوْهُ تُرَابًا.

(৬) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পড়ে তার মুখে মাটি নিক্ষেপ করতে আমার ইচ্ছা করে।[15] আসওয়াদ থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[16] অন্য বর্ণনায় আবর্জনা মারার কথা রয়েছে।[17]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ।[18] ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, এটি মুরসাল। এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না।[19]

(7) عَنْ سَعْدٍ قَالَ وَدِدْتُ أَنَّ الَّذِىْ يَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ فِىْ فِيْهِ جَمْرَةً.

(৭) সা‘দ (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করে আমার ইচ্ছা হয় তার মুখে আগুনের অঙ্গার ছুড়ে মারতে।[20]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ ও মুনকার।[21] ইমাম বুখারী বলেন, এর সনদে ইবনু নাজ্জার নামে অপরিচিত রাবী আছে।[22]

(8) عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ قَيْسٍ قَالَ لَأَنْ أَعُضَّ عَلَى جَمْرَةٍ أَحَبَّ إِلَّى مِنْ أَنْ أَقْرَأَ خَلْفَ الْإِمَامِ.

(৮) আলক্বামা বিন কায়েস বলেন, আমার নিকট জ্বলন্ত অঙ্গার কামড়ে ধরা অধিক উত্তম, ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পড়ার চেয়ে।[23] আসওয়াদ থেকেও অনুরূপ একটি বর্ণনা আছে।[24]

তাহক্বীক্ব : এর সনদ যঈফ ও ত্রুটিপূর্ণ।[25] বুকাইর ইবনু আমের নামে একজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে।[26]

(9) قَالَ حَمَّادٌ وَدِدْتُ أَنَّ الَّذِىْ يَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ مُلِئَ فُوْهُ سُكْرًا.

(৯) হাম্মাদ বলেন, আমার ইচ্ছা হয় ঐ ব্যক্তির মুখে মদ নিক্ষেপ করি, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পড়ে।[27]

তাহক্বীক্ব : যঈফ। ইমাম বুখারী বলেন, এ সমস্ত বর্ণনা যাদের নামে বর্ণনা করা হয়েছে, তাদের পরষ্পরের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি।[28]

(১০) عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَجْلاَنَ قَالَ قَالَ عَلِىٌّ مَنْ قَرَأَ مَعَ الْإِمَامِ فَلَيْسَ عَلَى الْفِطْرَةِ.

(১০) আলী (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে ক্বিরাআত পাঠ করে সে (ইসলামের) ফিতরাতের উপর নেই।[29]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি ছহীহ নয়। ইমাম বুখারী বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়। কারণ মুখতার অপরিচিত। সে তার পিতা থেকে শুনেছে কি-না তা জানা যায় না।[30] ইবনু হিববান তাকে বাতিল বলেছেন।[31]

জ্ঞাতব্য : উক্ত বর্ণনাগুলো ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার বিরুদ্ধে পেশ করা হয়। যদিও তাতে সূরা ফাতিহার কথা নেই। জেহরী ছালাতে সূরা ফাতিহার পরের সাধারণ ক্বিরাআত পড়ার কথা বলা হয়েছে,[32] যা প্রকৃতপক্ষেই নিষিদ্ধ। এটা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।[33] এর পক্ষে অনেক ছহীহ আছারও আছে। অতএব এগুলো ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার বিরুদ্ধে পেশ করা অন্যায়।

(11) عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ مَنْ قَرَأَ خَلْفَ الْإِمَامِ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ.

(১১) যায়েদ বিন ছাবিত বলেন, যে ইমামের পিছনে কিছু পড়বে তার ছালাত হবে না।[34]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা।[35] এর সনদে আহমাদ ইবনু আলী ইবনু সালমান মারূযী নামে একজন রাবী আছে। সে হাদীছ জাল করত। ইবনু হিববান বলেন, এই হাদীছের কোন ভিত্তি নইে।[36]

(১২) عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ يَقُوْلُ مَنْ صَلَّى رَكْعَةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَلَمْ يُصَلِّ إِلاَّ أَنْ يَكُونَ وَرَاءَ الإِمَامِ.

(১২) জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলতেন, যে ব্যক্তি এক রাক‘আত ছালাত আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা.পড়ল না তার ছালাত হবে না। তবে ইমামের পিছনে থাকলে হবে।[37]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, এটা বাতিল বর্ণনা। মালেক থেকে বর্ণিত হয়নি।[38] মূলতঃ ‘তবে ইমামের পিছনে থাকলে হবে’ এই অংশটুকু ত্রুটিপূর্ণ।[39] তাছাড়া বর্ণনাটি মাওকূফ। উল্লেখ্য যে, মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ বইয়ে বর্ণনাটিকে রাসূল (ছাঃ)-এর নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা প্রতারণার শামিল।[40]

(13) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِىِّ تَكْفِيْكَ قِرَاءَةُ الْإِمَامِ خَافَتَ أَوْ جَهَرَ.

(১৩) ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ইমামের ক্বিরাআতই তোমার জন্য যথেষ্ট। ইমাম আস্তে পড়ুন আর জোরে পড়ুন।[41]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর মধ্যে আছেম নামে একজন রাবী আছে। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, সে নির্ভরযোগ্য নয়।[42]

(14) عَنِ الْحَارِثِ قَالَ رَجُلٌ لِلنَّبِىِّ أَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ أَوْ أُنْصِتُ؟ قَالَ بَلْ أَنْصِتْ فَإِنَّهُ يَكْفِيْكَ .

(১৪) হারেছ থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল আমি কি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করব না চুপ থাকব? তিনি বললেন, চুপ থাক। ঐ ক্বিরাআতই তোমার জন্য যথেষ্ট।[43]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, গাস্সান নামক ব্যক্তি দুর্বল। অনুরূপ কায়স ও মুহাম্মাদ বিন সালেম উভয়েই যঈফ।[44]

(১৫) قَالَ الشَّعْبِىُّ أَدْرَكْتُ سَبْعِيْنَ بَدْرِيَّا كُلُّهُمْ يَمْنَعُوْنَ عَنِ الْقِرَأَةِ خَلْفَ الْإِمَامِ.

(১৫) শা‘বী (রহঃ) বলেন, আমি ৭০ জন বদরী ছাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছি তারা প্রত্যেকেই ইমামের পিছনে কিরাআত পড়তে নিষেধ করতেন।[45]

তাহক্বীক্ব : ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। উক্ত বর্ণনার কোন সনদ পাওয়া যায় না।

সুধী পাঠক! উক্ত বর্ণনাগুলোর অবস্থা পরিষ্কার। এগুলো নির্ভরযোগ্য কোন হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়নি। মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ, ত্বাহাবী প্রভৃতির মধ্যে এসেছে। এ ধরনের ভিত্তিহীন বর্ণনা আরো আছে।[46] তবে রাসূল (ছাঃ) থেকে কোন ছহীহ বর্ণনা নেই। সুতরাং এ সমস্ত বর্ণনা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যাবে না। মূলতঃ এই সমস্ত বিরোধের জন্ম হয়েছে ইরাকের কূফাতে। ইমাম তিরমিযী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক মন্তব্য করেন, أَنَا أَقْرَأُ خَلْفَ الْإِمَامِ وَالنَّاسُ يَقْرَءُوْنَ إِلَّا قَوْمًا مِنْ الْكُوفِيِّيْنَ ‘আমি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করি এবং অন্য মানুষেরাও করে। কিন্তু কূফাবাসী করে না’।[47] এগুলো পাঠকের সামনে পেশ করার কারণ হল, এই উদ্ভট বর্ণনাগুলো দ্বারা সাধারণ মুছল্লীদেরকে ধোঁকা দেয়া হয়। অতএব মুছল্লীদেরকে সাবধান থাকতে হবে।

জ্ঞাতব্য : ইবনু ওমর ও ইবনু মাসঊদ (রাঃ) জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করতেন না মর্মে কিছু আছার বর্ণিত হয়েছে।[48] যেগুলোকে কেউ কেউ বিশুদ্ধ বলেছেন।[49] তবে বহু ছাহাবী থেকে ইমামের পিছনে সরাসরি সূরা ফাতিহা পড়া সম্পর্কে অনেক ছহীহ আছার আছে। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ।

عَنْ يَزِيْدَ بْنِ شَرِيْكٍ أَنَّهُ سَأَلَ عُمَرَ عَنِ الْقِرَاءَةِ خَلْفَ الإِمَامِ فَقَالَ اقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ قُلْتُ وَإِنْ كُنْتَ أَنْتَ؟ قَالَ وَإِنْ كُنْتُ أَنَا قُلْتُ وَإِنْ جَهَرْتَ؟ قَالَ وَإِنْ جَهَرْتُ.

ইয়াযীদ ইবনু শারীক একদা ওমর (রাঃ)-কে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ কর। আমি বললাম, যদি আপনি ইমাম হোন? তিনি বললেন, আমিও যদি ইমাম হই। আমি পুনরায় বললাম, যদি আপনি জোরে ক্বিরাআত পাঠ করেন? তিনি বললেন, যদিও আমি জোরে ক্বিরআত পাঠ করি।[50]

রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদী শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। সুতরাং সেদিকেই ফিরে যেতে হবে।

[1]. আবুদাঊদ হা/৮২৬, ১/১২০ পৃঃ; তিরমিযী হা/৩১২, ১/৭১ পৃঃ; নাসাঈ হা/৯১৯।

[2]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম হা/৬৮, পৃঃ ৭১; তানক্বীহ, পৃঃ ২৮৮।

[3]. ঐ, তালখীছুল হাবীর, ১/২৪৬।

[4]. দারাকুৎনী হা/১২৮০।

[5]. দারাকুৎনী تفرد به زكريا الوقاد وهو منكر الحديث متروك।

[6]. বায়হাক্বী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম হা/২৮২, পৃঃ ৩২১- غلط فى إسناده।

[7]. هذا خطأ لاشك فيه ولا اوتياب -তানক্বীহুল কালাম, পৃঃ ২৮৯।

[8]. দারাকুৎনী হা/১২৫৩, ১/৩২৬; বায়হাক্বী, কুবরা হা/৩০২২, ২/১৬২।

[9]. দারাকুৎনী হা/১২৫৩, ১/৩২৬-لَمْ يَقُلْ هَكَذَا غَيْرُ حَجَّاجٍ وَخَالَفَهُ أَصْحَابُ قَتَادَةَ مِنْهُمْ شُعْبَةُ وَسَعِيدٌ وَغَيْرُهُمَا فَلَمْ يَذْكُرُوا أَنَّهُ نَهَاهُمْ عَنِ الْقِرَاءَةِ. وَحَجَّاجٌ لاَ يُحْتَجُّ بِهِ.।

[10]. ইবনু হিববান, কিতাবুয যু‘আফা; ইবনু হাজার, আদ-দিরাইয়া ফী তাখরীজি আহাদীছিল হেদায়াহ, পৃঃ ১/১৬৫ পৃঃ; ইবনু তাহের, তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃঃ ৯৩।

[11]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৬৯, ২/৪১-فِيْهِ مَأْمُوْنُ بْنُ أَحْمَدَ الْهَرُوِىُّ دَجَّالٌ يَرْوِى الْمَوْضُوْعَاتِ।

[12]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৮০৬।

[13]. আত-তামহীদ ১১/৫০ পৃঃ - فمنقطع لا يصح ولا نقله ثقة

[14]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩০৪৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৯২-এর আলোচনা দ্রঃ।

[15]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭৮৯; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৮০৭-৯; ইরওয়া হা/৫০৩।

[16]. মালেক মুওয়াত্ত্বা হা/১২৫; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৮০৬; ত্বাহাবী হা/১৩১০।

[17]. বায়হাক্বী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ৪৫৩।

[18]. ইরওয়াউল গালীল ২/২৮১ পৃঃ।

[19]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ২০-وهذا مرسل لا يحتج به।

[20]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৭৮২; ইরওয়াউল গালীল ২/২৮১ পৃঃ।

[21]. ইরওয়াউল গালীল ২/২৮১ পৃঃ।

[22]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ২০-وهذا مرسل وابن بجاد لم يعرف ولا سمي ولا يجوز لأحد أن يقول في في القارئ خلف الإمام جمرة لأن الجمرة من عذاب الله وقال النبي صلى الله عليه وسلم لا تعذبوا بعذاب الله ولا ينبغي لأحد أن يتوهم ذلك عن سعد مع إرساله وضعفه।

[23]. মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ হা/১২৩; শারহু মা‘আনিল আছার হা/৩১১৫; ইরওয়াউল গালীল ২/২৮১ পৃঃ।

[24]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৭৮৫।

[25]. ইরওয়াউল গালীল ২/২৮১ পৃঃ।

[26]. তাহক্বীক্ব মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ, ১/২০০ পৃঃ।

[27]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ২০; বায়হাক্বী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ৪৫৩।

[28]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ২০- لا يعرف لهذا الإسناد سماع بعضهم من بعض ولا يصح مثله।

[29]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক ২/১৩৯; হা/২৮০১; দারাকুৎনী হা/১২৭০; ইরওয়াউল গালীল ২/২৮৩ পৃঃ; মাযহাবী বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৭০।

[30]. ইরওয়াউল গালীল ২/২৮২ পৃঃ।-لا يصح لأنه لا يعرف المختار ولا يدرى أنه سمعه من ابيه ام لا.

[31].لا يصح إسناده وقال ابن حبان في كتاب الضعفاء هذا يرويه ابن أبي ليلى الأنصاري وهو باطل ويكفي في بطلانه إجماع المسلمين وعبد الله بن أبي ليلى هذا رجل مجهول -তাহক্বীক্ব মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ ১/১৯১ পৃঃ।

[32]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ২০।- فلو ثبت الخبران كلاهما لكان هذا مستثنى من الأول لقوله لا يقرأن إلا بأم الكتاب وقوله من كان له إمام فقراءة الإمام له قراءة جملة وقوله إلا بأم القرآن مستثنى من الجملة

[33]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৮৪১, তাহক্বীক্ব আলবানী, সনদ ছহীহ লিগায়রিহী; মুসনাদে আবী ইয়ালা হা/২৮০৫; ছহীহ মুসলিম হা/৮৭৮, ১/১৬৯-৭০; মিশকাত হা/৮২৩, পৃঃ ৭৮-৭৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত ২/২৭২ পৃঃ, হা/৭৬৬; আবুদাঊদ হা/৭৯৩, সনদ ছহীহ।

[34]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৮০৯, ১/৪১৩ পৃঃ; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৮০২; মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ হা/১২৮।

[35]. ইরওয়াউল গালীল হা/৫০৩; সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৯৩।

[36]. আল-মাজরূহীন ১/১৫১ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৯৩-এর আলোচনা দ্রঃ।

[37]. ক্বাযী আবুল হাসান খালাঈ, আল-ফাওয়াইদ ১/৪৭ পৃঃ; তিরমিযী হা/৩১৩, ১/৭১ পৃঃ; নবীজীর স. নামায, পৃঃ ১৭১; মাযাহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৬৭।

[38]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৯১, ২/৫৭ هذا باطل لا يصح عن مالك

[39]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৯১। আলবানী বলেন, - قلت والحديث صحيح بدون قوله إلا وراء الإمام ।

[40]. ঐ, পৃঃ ২৬৭।

[41]. দারকুৎনী হা/১২৬।

[42]. ইরওয়াউল গালীল ২/২৭৫ পৃঃ عاصم ليس بالقوي।

[43]. দারাকুৎনী হা/১২৫।

[44]. দারাকুৎনী হা/১২৫; ইরওয়াউল গালীল ২/২৭৬ পৃঃ تفرد به غسان وهو ضعيف وقيس ومحمد بن سالم ضعيفان।

[45]. রূহুল মা‘আনী ৯/১৫২; মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৭০।

[46]. ত্বাহাবী হা/১৩১৬; মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৭০।

[47]. তিরমিযী ১/৭১ পৃঃ।

[48]. মাজমাউয যওয়ায়েদ ২/১১০-১১১; ত্বাহাবী ১০৭; মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ, পৃঃ ৪৫; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ১/৩৭৬; মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৬৯; মালেক মুওয়াত্ত্বা, ১ম খন্ড হা/২৮৩; ত্বাহাবী পৃঃ ১২৯; নবীজীর স. নামায, পৃঃ ১৭০; মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৬৯।

[49]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৯২-এর আলোচনা দ্রঃ।

[50]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩০৪৭; সনদ ছহীহ, সিলাসলা যঈফাহ হা/৯৯২-এর আলোচনা দ্রঃ।