সমস্ত প্রশংসা মহাশক্তিশালী, মহাক্ষমাশীল, একক ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার। দুরূদ ও সালাম তাঁর (আল্লাহর) নির্বাচিত ও মনোনীত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পবিত্র পরিবার-পরিজন, শ্রেষ্ঠতম সাহাবীগণ, বিশেষ করে তাদের মধ্যে মুহাজির ও আনসারগণের ওপর বর্ষিত হোক।

অতঃপর, নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের আলোচনা করলে অন্তর প্রশান্ত হয়, ইলমের মজলিস ও পাঠালয় সুসজ্জিত হয়। কেনোই বা হবে না; তারা তো ছিলেন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা, সর্বোত্তম মানুষ, সর্বোত্তম উম্মত যাদেরকে মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে, সম্মান ও ফযীলতের অধিকারী, উচ্চ স্তর ও ইসলাম গ্রহণে তারাই ছিলেন অগ্রগামী।

আর তারা তো মুহাজির ও আনসার, যারা ইসলাম গ্রহণে প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা বৃক্ষের নিচে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেছেন তাদের প্রতিও আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন।

তারা তো এমন লোক, আল্লাহ তাদেরই অন্তরগুলোকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করেছেন, তাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দান করেছেন, তারাই তো ছিলেন প্রকৃত বিচক্ষণ জ্ঞানী।

তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। তাদের রব তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে সুসংবাদ দিচ্ছেন রহমত ও সন্তুষ্টির এবং এমন জান্নাতসমূহের যাতে রয়েছে তাদের জন্য স্থায়ী নি‘আমত।

তারা তো এমন মানব ছিলেন যারা নিজেদের জন্য তাকওয়া অনিবার্য করেছিলেন। তারা তাকওয়া জন্য অধিক উপযোগী ও তাকওয়াবান ছিলেন। তাদের অন্তরে আল্লাহ সাকীনা তথা প্রশান্তি নাযিল করেছেন যাতে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়। তারা তো এমনই লোক ছিলেন যারা ফিরে এসেছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নি‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘আমত ও অনুগ্রহসহ। কোনো মন্দ তাদেরকে স্পর্শ করে নি। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَسۡبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ٦٤﴾ [الانفال: ٦٤]

‍“হে নবী, আপনার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং যেসব মুমিন আপনার অনুসরণ করেছে তাদের জন্যও।‍” [সূরা আল- আনফাল, আয়াত: ৬৪]

তাদের মর্যাদা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেছেন,

﴿هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ٦٢﴾ [الانفال: ٦٢]

“তিনিই তোমাকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬২]

সেসব শ্রেষ্ঠতম পবিত্রতম, তাকওয়াবান ও নির্বাচিত সেরাগণ নিজেদের জীবন, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, ঘর-বাড়ি সব কিছুই ত্যাগ করেছেন। ফলে তারা নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে দেশ থেকে হিজরত করেছেন; এমনকি আল্লাহর জন্য নিজেদের পিতামাতা ও ভাইবোনও কুরবানী করেছেন।

তারা ধৈর্যের সাথে আত্মত্যাগ করেছেন, সাওয়াবের প্রত্যাশায় ধন-সম্পদ ব্যয় করেছেন, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে যারা তাদের সাথে শত্রুতামূলক আচরণ করেছেন তাদের মোকাবিলা করেছেন, সব প্রিয় ও অপ্রিয় কাজে সর্বদা তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করেছেন।

তারা তো এমনই মুহাজির যাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ী ও ধন-সম্পত্তি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অন্বেষণে রত থাকতেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করতেন। এরাই তো সত্যবাদী।

তাদেরই ভাই আনসারগণ ছিলেন সমবেদনা পোষণকারী, অন্যকে অগ্রাধিকার প্রদানকারী, আরবের উত্তম প্রতিবেশী, যাদের বাড়ি-ঘরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাপদ ও স্থিতিশীল স্থান হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তারা ছিলেন সচ্চরিত্রবান, পুষ্পিত মনোনীত লোক। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞ٩﴾ [الحشر: ٩]

“আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা মদীনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ঈমান এনেছিল (তাদের জন্যও এ সম্পদে অংশ রয়েছে), আর যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদেরকে ভালোবাসে। আর মুহাজেরদেরকে যা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা অনুভব করে না এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর মুহাজিরদেরকে অগ্রাধিকার দেয়।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৯][1]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতই তাদের (সাহাবীগণের) অগাধ ভালোবাসা তাদের অন্তরে লুকিয়ে রাখেন, তাদের প্রতি সম্মান-মর্যাদা পোষণ ও তাদেরকে ভালোবাসার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করেন, আর যারা তাদের অন্তরে সাহাবীগণের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন,

﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: ١٠]

“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]

বস্তুত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের ওপর তাঁর সাহাবীগণের অনেক অধিকার রয়েছে। এখানে এ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ আলোচনা করা হবে। বিশেষ করে তাদের জন্য, বর্তমান সময়ে যাদের অন্তরে ব্যাধির উদ্ভব হয়েছে, যারা সুযোগ পেলেই তাদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের তীর নিক্ষেপ করে, এমনকি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কতিপয় লোক তাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছে। ফলে তারা আধুনিক মিডিয়া ও যোগাযোগ মাধ্যমে সাহাবীগণের ব্যাপারে কতিপয় দ্বিধা-সংশয় প্রচার করে থাকেন। এ কারণে তাদের এ ফিতনা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী। এ কারণে সহজ-সরল ও সংক্ষিপ্তাকারে সাহাবীগণের মর্যাদা ও মুসলিমের ওপর তাদের অধিকার সম্পর্কে কিছু লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। এতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাকে দলীল ও তাদের উক্তি সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এ লেখা-লেখিতে আমি আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করছি, তাঁর কাছে প্রত্যাশা করছি তিনি যেন এ লেখাটি কবুল করে নেন এবং এর দ্বারা সবাইকে উপকৃত করেন।

>
[1] উপরোক্ত কথাগুলো (الذين سمحت نفوسهم থেকে এ পর্যন্ত) আবু নু‘আঈম আল-আসবেহানীর ‘আল-ইমামাহ’ পৃষ্ঠা (২০৯-২১০) থেকে কিছুটা পরিবর্তনসহ সংকলিত।