প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কলামিস্ট ও গল্পকার আনিসুল হক। তিনি একটি বই লিখেছেন ‘ছহি রাজাকারনামা’ নামে। কুরআনের আয়াত নিয়ে এ ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক রচনা বাংলা ভাষায় নজিরবিহীন। বাংলা সাহিত্যের সেরা কবি-সাহিত্যিকরা শত শত বছর ধরে পবিত্র কুরআনের প্রশংসা করে বহু কবিতা-গান রচনা করেছেন, এখনো করছে এবং ভবিষ্যতেও করবেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবি নবীন চন্দ্র সেনকে নিয়ে লেখা ‘নবীনচন্দ্র’ কবিতায় নিজেকে ‘কোরআনের কবি’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। নজরুল কোরআনের আমপারা অংশের কাব্যানুবাদ করেছেন। গানে ও কবিতায় পবিত্র কোরআনের সূরা ফাতেহার অনুবাদ করেছেন গোলাম মোস্তফা, সুফিয়া কামাল, ফররুখ আহমদ, মতিউর রহমান মল্লিকসহ বাংলাদেশের প্রথম সারির অনেক কবি-সাহিত্যিক।
বাংলা সাহিত্যের এক সময়ের জনপ্রিয় কবি ও চিন্তাবিদ শেখ ফজলুল করিম পবিত্র কুরআন নিয়ে রচনা করেছেন সুদীর্ঘ অনবদ্য কবিতা ‘কোর-আন’। এ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘বিশ্ব-মানব মঙ্গল-সেতু আমাদের ফোরকান’ এবং ‘বিশ্ব মানব মুক্তির হেতু আমাদের কোরআন’। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন কুরআনের গদ্য অনুবাদ করেছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কুরআনের কয়েকটি সূরার অনুবাদ করেছেন কবিতায়। অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও এদের বিরুদ্ধে কখনও কুরআন বিকৃতির অভিযোগ ওঠে নি। সচেতন মহল বিস্ময় প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের একজন মুসলমান লেখক ও সাংবাদিক হয়ে আনিসুল হক কীভাবে এ ধরনের ভয়াবহ বিকৃত রচনা লেখা লিখতে পারলেন?
তার একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনায় পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াতকে সম্পূর্ণ বিদ্রূপাত্মক ভাষায় লেখা হয়। লেখাটি নিয়ে ফেসবুক, ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সাইট এবং সচেতনমহলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত সচলায়তন ব্লগে আনিসুল হকের ‘ছহি রাজাকারনামা’ লেখাটি প্রকাশ পায়। সচেতন ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সঙ্গে সঙ্গে লেখাটি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য আনিসুল হকের এ লেখাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৯১ সালের ১২ এপ্রিল পূর্বাভাস পত্রিকায়। ১৯৯৩ সালে লেখাটি আনিসুল হকের ‘গদ্যকার্টুন’ বইতে স্থান পায়। ২০১০ সালে এই বইটি পুনরায় মুদ্রণ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সন্দেশ। বইটিতে পর্দানসিন নারী ও দাড়ি-টুপিধারী আলেমদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন শিশির ভট্টাচার্য।
পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে—‘সমস্ত প্রশংসা জগতের প্রতিপালক আল্লাহর’। আনিসুল হক তার ‘সহি রাজাকারনামা’য় লিখেছেন, ‘সমস্ত প্রশংসা রাজাকারগণের’। সূরা ফাতেহার আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’ আনিসুল হক ব্যঙ্গ ও বিকৃত করে লিখেছেন, ‘আর তোমরা রাজাকারের প্রশংসা করো, আর রাজাকারদের সাহায্য প্রার্থনা করো।’
পবিত্র কুরআনের সূরা দুহার ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো।’ আনিসুল হক বিদ্রূপ করে লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই রাজাকারগণের জন্য অতীতের চাইতে ভবিষ্যেক উত্তম করিয়া সৃজন করা হইয়াছে।’
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৩ নং আয়াতে বলা হয়, ‘আর তোমরা ভয় কর যে, ইয়াতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূর্ণ করতে পারবে না; তবে সেসব মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের ভালো লাগে বিয়ে করে নাও দুই, তিন বা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একজনকেই (বিবাহ কর), অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদের (বিবাহ কর)।’ আনিসুল হক এ আয়াতের বিপরীতে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘সেই ব্যক্তিই উত্তম রাজাকার, যে বিবাহ করিবে, একটি, দুইটি, তিনটি, চারটি, যেরূপ সে ইচ্ছে করে আর তাহার জন্য বৈধ করা হইয়াছে ডান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের, আর তাহারা ভোগ করিতে পারিবে বাঙালিরমণীগণকে, অপিচ তাহাদের সহিত আদল করিবার দরকার হইবে না। স্মরণ রাখিও, মালেগণিমতগণের সহিত মিলিত হইবার পথে কোনোরূপ বাধা থাকিলো না।’
পবিত্র কুরআনের সূরা মুরসালাতের ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়, ‘আমি কি আগের লোকদের (অবিশ্বাসী জালেম) ধ্বংস করিনি?’ আনিসুল হক এ আয়াতের ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘গ্যালিলিও নামের এক পাপিষ্ঠ অতীতে সত্য অস্বীকার করিয়াছিল এবং সে কি প্রাপ্ত হয় নাই চরম শাস্তি।’
পবিত্র কুরআনের সূরা নাবার ৩১-৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অপরদিকে পরহেজগার লোকদের জন্য রয়েছে চরম সাফল্য। (তা হচ্ছে) বাগবাগিচা, আঙ্গুর (ফলের সমারোহ), (আরো আছে) পূর্ণ যৌবনা সমবয়সী সুন্দরী তরুণী।’ আনিসুল হক এ আয়াতের বিকৃত করে লিখেছেন, ‘আর তাহাদের জন্য সুসংবাদ। তাহাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে রাষ্ট্রের শীর্ষপদ আর অনন্ত যৌবনা নারী আর অনন্ত যৌবন তরুণ। কে আছে, যে উত্তম সন্দেশ, মসৃণ তলদেশ ও তৈলাক্ত গুহ্যদেশ পছন্দ করে না।’
এভাবেই কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করে আনিসুল হক লিখেছেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রভু পাকিস্তানের প্রশংসা কর। নিশ্চয় তোমাদের প্রভু পাকিস্তানীরা ক্ষমতাশীল।’
আনিসুল হকের ‘ছহি রাজাকারনামা’ লেখাটির প্রতিটি বাক্যেই পবিত্র কুরআনের বাকভঙ্গি ও কুরআনের বাংলা অনুবাদের ক্লাসিক ভাষা ব্যবহার করে কুরআনের আয়াতকে ব্যঙ্গ ও বিকৃত করা হয়েছে। ২০১০ সালে ‘সন্দেশ’ থেকে প্রকাশিত আনিসুল হকের বইটিতে ‘ছহি রাজাকারনামা’ ছাড়াও ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’, ‘নমিনেশন ইন্টারভিউ গাইড’সহ কয়েকটি লেখায় ইসলামি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে।[দৈনিক আমার দেশ, বৃহস্পতিবার ২৮/০৩/২০১৩]