বিখ্যাত হুমায়ুন আজাদের কুখ্যাত পাক সার জমিন সাদ বাদ বেশ কবার শুরু করেছি। অতি কষ্টেও দশম পৃষ্ঠা পেরোতে পারি নি। সম্ভবত চতুর্থবারের মতো এবার শেষ করার পণ নিয়ে শুরু করি। এবারও বুঝি রণে ভঙ্গ দিতে হয়। একদিনে ৩৮ পৃষ্ঠা পড়া হয়। বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রত্যেক শব্দ-হরফের অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ হেন ব্যবহার নেই যা তিনি এখানে আনেন নি। জানি না শিল্পিত বর্ণনায় এমন অশিল্পীসুলভ উপন্যাস দ্বিতীয়টি রচনা করেছেন কিনা। অন্ধ বিদ্বেষ, নির্জলা মিথ্যা আর কল্পনার অপব্যবহার কী ও কেমন তা জানতে এরচে আদর্শ কোনো বই হয় না। সংবাদপত্রের মতো উপন্যাসও সমাজের দর্পণ। সে অর্থে আলোচ্য উপন্যাস প্রয়োজনীয় পাশ নাম্বারও পায় না। লেখক জোর করে যেসব চরিত্র ও চিত্র উপস্থাপন করেছেন তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের মুসলিমপ্রধান সমাজে একটিও দেখানো সম্ভব নয়। অথচ বিবেকের মাথা খেয়ে লেখক এমনই সব চরিত্র বাংলাদেশের ইসলাম ও ডানপন্থী বৃহত্তম দল দুটির ওপর চাপিয়েছেন। ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে সঙ্গে লেখক যে বাংলাদেশের একটি বড় দলের দালালির এজেন্ডাও রাখতেন, তা এ উপন্যাসেই প্রথম টের পেলাম।
প্রতিভা থাকলেই তা পূজনীয় নয়। সুন্দর প্রতিভার যিনি অসুন্দর প্রয়োগ ঘটান, তিনি স্রষ্টার অকৃতজ্ঞ বান্দাই শুধু নন; আত্মোম্ভরি প্রচণ্ড জ্ঞানী শয়তানেরও দাস। এতদিন ইসলামবিদ্বেষী জানা সত্ত্বেও লেখকের প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করতাম, এখন জানলাম তিনি শুধু জ্ঞানী নন; জ্ঞানপাপী। এমনকি জ্ঞানপাপীই শুধু নন, বিবেকপ্রতিবন্ধীও। যে কোনো জাতি-ধর্মের লেখক কিংবা বিদগ্ধ পাঠক এমন বিকারগ্রস্ত বাস্তবতাবিবর্জিত আরোপিত চরিত্রের উপন্যাসের নিন্দা না করে পারবেন না। এদেশের তথাকথিত কিছু প্রগতিশীল লেখক এর পক্ষে কীভাবে সাফাই গান তাও গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে নিজেকে প্রগতিশীলদের কাতারে দেখাতেই যে তারা এমন আবর্জনার গুণ গেয়ে থাকেন, তা গবেষণা ছাড়াই বলা যায়।
লেখক প্রতিটি পৃষ্ঠায় একাধিক প্যারায় বিভিন্ন মানুষ ও দলের চরিত্র হননের প্রয়াস পেয়েছেন। কোনোটাই সবার সামনে উপস্থাপনযোগ্য নয়। যে কোনো দৃষ্টান্ত দিলেই পাঠকমাত্র ঘেন্নায় নাকে হাত দিতে বাধ্য হবেন। তথাপি একটি প্যারা উল্লেখ করে সামান্য বিশ্লেষণ না করলে কেউ অযথা নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনতে পারেন। তাই বাধ্য হয়েই একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি : ‘জিহাদি হাফিজুদ্দিনটা একটু বেতমিজ, মুখে চমৎকার চাপদাড়ি, স্বাস্থ্যটাও ভালো; একাই দু-তিনটি দোকান ভাঙতে পারে, কয়েকটিতে আগুন লাগাতে পারে, গুলি চালাতে পারে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’ ব‘লে ছুরি ঢুকোতে পারে; ফিরে এসে একটির পর একটি এক্সএক্সএক্স দেখতে পারে, সবই ইন্ডিয়ান, বড়ো দুধ আর বড়ো মাজা ওর পছন্দ, চাকরানিটাকে ডেকে এনে ঘণ্টাখানেক ধ’রে অরাল-অ্যানাল-ভ্যাজাইনাল করতে পারে, তারপর উঠে গিয়েই মধুর স্বরে ওয়াজ করতে পারে, ফতোয়া দিতে পারে।’
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইসলামের শাশ্বত শান্তির সুমহান বাণী প্রচার করে বেড়ানো ওয়ায়েজদেরকে লেখক (১) জিহাদি ও জঙ্গি (২) ধর্ষক ও লম্পট এবং (৩) ভণ্ড ও চরিত্রহীন বানাতে চেয়েছেন। যে কিনা মুখে দাড়ি রেখে মানুষের বাড়ি বাড়ি খেয়ে মোটা-তাজা হয়ে সংখ্যালঘুদের দোকানপাট ভাঙে, তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, আল্লাহর নাম নিয়ে মানুষ খুন করে, তারপর ব্লু-ফিল্ম দেখে, ইন্ডিয়ান বারবণিতাদের দেখে কাজের মেয়ের সঙ্গে নানাভাবে বিকৃত যৌনাচার চালায়। আর এতসব অপকর্ম করে তিনি মধুর সুরে ওয়াজ করেন আর ফতোয়া দেন! পাঠক বলুন, এমন মারাত্মকসব বিপরীতমুখী চরিত্রের একজন ব্যক্তিও কি দেখাতে পারবেন?
কী বিপদের কথা, এত বড় বড় সব পণ্ডিত লেখকরা যখন ইসলামের হক-বাতিল নানা ফেরকাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, তখন তাদের মূর্খও বলতে পারি না। হতে পারে তারা সজ্ঞানে সবগুলো ইসলামের সপক্ষশক্তির চরিত্র হনন করে কেল্লা ফতে করতে চান। নিচের উদ্ধৃতি খেয়াল করুন। কিভাবে তিনি ইরানের কট্টর শিয়া আর আফগানের কট্টর সুন্নিদের এক কাতারে এনেছেন। বাংলাদেশের জামাতে ইসলামসহ সব ইসলামিদের একসঙ্গে ভজঘট পাকিয়েছেন :
‘জিহাদিদের একটি মহান গুণ হচ্ছে তারা মালাউন মেয়ে পছন্দ করে। আমিও করি, ওদের একটু খেলাতে পারলে ওরা উর্বশীদের মতো নাচে; আমার জিহাদিরা অবশ্য নাচটাচ পছন্দ করে না, ওরা ঢুকতে বেরোতে পারলেই শুকরিয়া আদায় করে। এতে প্রধান প্রতিভা তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, ও হয়তো ফেরেশতাদের কাছে থেকে কোনো হালুয়া লাভ করে; তবে মোঃ কেরামত আলি, মোঃ মোস্তফা, মোঃ আকবর আলিও কম যায় না, এটা আমি পছন্দই করি, জিহাদে কোনো কম যাওয়া-যাওয়ি নেই, তাতে জোশ কমে যায়। ওরা যখন একেকটি মালাউন মেয়ের ওপর চড়ে, তখন ওরা মনে করে ওরা একেকটি নাছারা নগর ধ্বংস করছে, যার নির্দেশ রয়েছে। আমি আশ্চর্য হই, ওরা রুহুল্লা খোমেনির কিছুই পড়ে নি, কিন্তু চিন্তা ও কর্মে তাঁকেও ছাড়িয়ে গেছে।’
না হলো না। আরও একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হয় : ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম আমাকে উদ্দীপ্ত করে, আমি প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করি, ওই উত্তেজনা দেহের বিশেষাঙ্গের উত্তেজনার থেকে অনেক বেশি তীব্র, অনেক বেশি প্রচণ্ড; আমি দেখতে পাই আমি বেঁচে উঠছি, আমি বেহেশতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। মওলানা মওদুদি, ইমাম গাজালি, আয়াতুল্লা খোমেনির বই, আর কোরান-হাদিছ, নেয়ামুল কোরআন, মুকছেদুল মমেনিন, বেহেস্তের জেওর প’ড়ে আমি বুঝতে পারি এতোকাল আমি ভুল পথে ছিলাম, দোজগের রাস্তায় ছিলাম, এখন আমি ঠিক পথে এসেছি; এখানে সব সময়ই খোয়াব, সব সময়ই উত্তেজনা; পৃথিবীতে মুছলমান আর ইছলাম ছাড়া আর কিছু থাকবে না, এ-বিশ্বাস আমাকে মাতাল ক’রে তোলে- নাউজুবিল্লা, ‘মাতাল’ শব্দটি ঠিক হয় নি, আল্লা আমাকে মাফ করবেন; এ-সময়ই আমি একটি চমৎকার জীবন পাই। জামাঈ জিহাদে ইছলামে যোগ দেয়ার পর প্রায় সবই পাই, বেহেশত তো পাবোই। যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আমি জামাঈ জিহাদে ইছলাম-এর ‘মদিনাতুন্নবি’ অঞ্চলের নেতা হয়ে উঠি, আমার খুব চেষ্টা করতে হয় না; আমার প্রধান নেতারা বুঝতে পারেন যে-তিরিশটি মাদ্রাছার তালেব এলেম নিয়ে এ-আঞ্চলিক সংঘটি গঠিত, ওই সব হাফেজিয়া ফোরকানিয়া কওমি কামিল দাখিল সাধারণ মাদ্রাছার তালেবানদের মাথায় ঘিলু নেই, যেমন তাদের মাথাও নেই, তাদের মগজ অন্য জায়গায়; তাই যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নেতা হয়ে উঠি, যা আমি কখনো হই নি।’
এ পর্যায়ে এসে আমি উপন্যাসের বাকি পৃষ্ঠাগুলোয়ও নজর বুলাই। আরও কত নোংরা বর্ণনা। অশ্লীল রচনা। লেখক প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় দিয়েছেন ইসলামপন্থী আর লেখকের ভাষায় জিহাদিদের ধর্ষণ ও নারীলিপ্সার কল্পিত দিগম্বর বর্ণনা। ইসলামের অনুসারীদের নানা চরিত্রহীনতা, নষ্টামী ও ভণ্ডামির চতুর উপস্থাপনা। শিল্পিত ভাষায় এবং অশ্লীল বয়ানে যে এমন সাহিত্য তৈরি হতে পারে তা এ উপন্যাস না পড়লে পাঠকের বিশ্বাস হত না। লেখক তার একাধিক বক্তব্যে নিজেকে শুধু নাস্তিক হিসেবেই প্রমাণ করেন নি, কুফরির শর্তগুলোও পূরণ করেছেন।
বইমেলা থেকে ফেরার পথে অজ্ঞাত পরিচয়ধারীদের হামলায় তিনি প্রচণ্ড আহত হন। পরবর্তীতে তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার মৃত্যুর পর এমন একজন ধর্মবিদ্বেষী আল্লাহদ্রোহীর জানাযা পড়াতে অস্বীকার করায় মসজিদের ইমামকে সমালোচনার শিকার হতে হয়। যে ইমাম তথা দীনদারদের সমালোচনা আর কলঙ্কিত করা ছিল মৃত লোকটির জীবনের প্রধানকর্ম তার জানাযা পড়াতে বাধ্য করা হয় তেমনি এক ইমামকে। নাস্তিক আর প্রগতিশীলদের স্ববিরোধ আর ভণ্ডামির এও এক নজির। আরে বাবা, এতই যদি তুমি ইসলামকে ঘৃণা করো, কুরআন আর আল্লাহকে অস্বীকার করো তবে কেন তোমাকে মৃত্যুর পর ইসলামের নিয়মে দাফন করা হবে? তোমাকে তো মাটিতে পুঁতে রেখে আসা উচিত।
এমন দেশ-ধর্ম ও বিবেকবিরোধী লেখার জন্য লেখকের মরণোত্তর ফাঁসি দেওয়া উচিত। আর আখিরাতে তাদের অবস্থা কী হবে সে তো বলাইবাহুল্য। যারা এখনো তার আদর্শের ধারক ও প্রচারক হয়ে বেঁচে আছেন, তাদেরকে সময়ের আগে সোজা হয়ে যাবার, সুপথে ফিরে শান্তির জীবন লাভের আহ্বান জানাই। মরার পর যখন আত্মীয়-পরিজন-সুহৃদরা আপনার জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ আর বেহেশত কামনা করবে, তার আগেই হেদায়েতের পথ ধরুন। পৃথিবীর জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি আল্লাহর দেয়া অবিনশ্বর জ্ঞানেরও স্বাদ নিন। নিজেকে জানুন এবং আল্লাহকে চিনুন।