ইসলামের প্রথম যুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে সব সাহাবী তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সাহায্য করে, সহযোগিতা করে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেদায়াতের যে আলোকবর্তিকা নিয়ে আসেন, তার অনুসরণ করে, তারা সবাই ছিল যুবক! ইসলামী দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অনেক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের হাতেই ন্যস্ত করেন এবং তাদের হাতে দায়িত্ব সমর্পণ করেন। যেমন, উসামা ইবনু যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর মত বড় সাহাবীদের উপস্থিতিতে মাত্র আঠারো বছর বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সেনাপতি নিয়োগ করেন। হুনাইনের যুদ্ধে যাওয়ার সময় উত্তাব ইবন উসাইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে মাত্র বিশ বছর বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার গভর্নর নিয়োগ করেন। এ ছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে ইসলামের ঝাণ্ডা বহন করা, ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত রাখা এবং ইসলামের আলোকে দুনিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুবকদের ভূমিকা বিষয়ে আরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
ইয়াহয়া ইবনে মঈন রহ. আহমদ ইবন হাম্বলকে হাদিস শেখার জন্য ইমাম শাফেয়ী রহ. এর বাহনের পিছনে হাটতে দেখে বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ! তুমি সুফিয়ান সাওরীর রহ. এর মত এত বড় মর্যাদাশীল হওয়া স্বত্বেও তার থেকে হাদিস শোনা ছেড়ে দিয়ে, এ যুবকের বাহনের পিছনে হাঁটছ এবং তার থেকে হাদিস শুনছ? আহমদ রহ. তাকে উত্তর দিয়ে বলেন, ‘যদি আপনি এ যুবককে চিনতে পারতেন, তবে আপনিও অপর পাশ দিয়ে হাঁটতেন’। সুফিয়ানে সাওরীর ইলম যদি উপরে হওয়ার কারণে ছুটে যায়, তবে নিচে হওয়ার কারণে তা আমি লাভ করতে পারব। আর এ যুবকের জ্ঞান যদি ছুটে যায়, তবে তা উপরে বা নীচে কোথাও পাওয়া যাবে না।
ইরাক থেকে একটি জামাত ওমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. এর নিকট আসলে, তাদের মধ্যে একজন যুবককে দেখতে পেল, সে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে সামনের দিক অগ্রসর হচ্ছে। তার অবস্থা দেখে ওমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. তাকে বলল, হে যুবক! তুমি থাম, বড়দের কথা বলতে দাও। তখন সে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! কোনো কোনো বিষয়ের সম্পর্ক বয়সের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। যদি বয়সের সাথে সম্পর্কিত হত, তাহলে মুসলিমদের মধ্যে খলিফা হওয়ার মত এমন অনেক ব্যক্তি আছে, যার বয়স আপনার থেকে অনেক বেশি। তার কথা শোনে ওমর ইবন আব্দুল আযীয বলল, ঠিক আছে তুমি বল।
মাকামাতের ব্যাখ্যায় আল্লামা মাসউদী রহ. একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, মাহদী বসরায় প্রবেশ করে দেখলেন, ইয়াস ইবন মুয়াবিয়া নামে একজন বাচ্চার পিছনে চারশত আলেম এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তারা সবাই ইয়াসের পিছনে হাঁটছে আর ইয়াস তাদের সামনে হাঁটছে। এ দৃশ্য দেখে মাহদী বলল, এদের মধ্যে কি সামনে বাড়িয়ে দেওয়ার মত এ বাচ্চা ছাড়া কোনো মুরব্বী নাই? তারপর মাহদী তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে বাবু তোমার বয়স কত? তখন সে বলল, -আল্লাহ তা‘আলা আমীরের হায়াতকে বৃদ্ধি করুক- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামা ইবন যায়েদ ইবন হারেসাকে যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উপস্থিতিতে ইসলামী সৈন্য দলের সেনাপতি নিযুক্ত করেন, তখন তার বয়স যত ছিল, বর্তমানে আমার বয়সও তাই। তার কথা শোনে মাহদী বলল, “আল্লাহ তোমার মধ্যে বরকত দান করুক” তুমি সামনেই থাক।
খতীব রহ. তারিখে বাগদাদে উল্লেখ করেন, ইয়াহয়া ইবন আকসাম বিশ বছর বয়সে বসরার গভর্নর নিযুক্ত হন। বয়স কম হওয়াতে লোকেরা তাকে খাট করে দেখল এবং তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বয়স কত? সে উত্তরে বলল, আমি উত্তাব ইবন উসাইদ হতে বড় যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বছর মক্কার কাযী নিয়োগ করে পাঠিয়েছিলেন। আমি মুয়ায ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বড়, যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামনের কাযী বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। আমি কা‘আব ইবন সুয়াইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বড় যাকে ওমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বসরার গবর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাদের এমনভাবে উত্তর দিলেন, যার মধ্যে তাদের অভিযোগের সব উত্তর প্রমাণসহ বিদ্যমান।
আবুল ইয়াকযান রহ. বলেন, হাজ্জাজ ইবন ইউছুফ মুহাম্মদ ইবন কাশেমকে সতের বছর বয়সে যুদ্ধের সেনাপতি বানান। তিনি পারসিকদের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হন। তারপর তাকে সিন্ধু প্রদেশের সেনাপতি বানালে তিনি সিন্ধু ও ভারত উপ মহাদেশ জয় করেন।
হাতীত আয-যাইয়াতকে হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের নিকট ধরে নিয়ে আসা হলে, হাজ্জাজ তাকে জিজ্ঞাসা করে বলল, তুমি কি হাতীত? সে বলল, হ্যাঁ আমি হাতীত, তুমি আমাকে তোমার যা ইচ্ছা তা জিজ্ঞাসা কর। আমি আল্লাহর নিকট তিনটি ওয়াদা করছি। তুমি যদি কোনো কথা জিজ্ঞাসা কর, সত্য বলব, যদি কষ্ট দাও ধৈর্য ধরব, আর যদি ক্ষমা কর, কৃতজ্ঞ হব। তার কথা শোনে হাজ্জাজ বলল, আমার সম্পর্কে তুমি কি ধারণ পোষণ কর? তখন হাতীত আয-যাইয়াত বলল, যমীনে তুমি আল্লাহর দুশমনদের মধ্য হতে একজন দুশমন। তুমি মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট কর, সামান্য অপরাধে মানুষ হত্যা কর। হাজ্জাজ বলল, আমীরুল মুমিনীন আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে তোমার মন্তব্য কি? সে বলল, সে তোমার চেয়েও বড় অপরাধী। তুমি তার অপরাধসমূহের একটি অপরাধ মাত্র।
দেখুন, একজন যুবকের সাহস, সততা ও প্রতিশ্রুতি কত দৃঢ় ও মজবুত। মৃত্যু নিশ্চিত জানা স্বত্বেও সে কোনো লুকোচুরির আশ্রয় নেয়নি।
আব্দুল্লাহ ইবন যিয়াদ তেইশ বছর বয়সে খুরাসানের গভর্নর নিযুক্ত হন। মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে ত্রিশ বছরের কম বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামনের গবর্নর বানান। নাহু ও আরবি ভাষার ইমাম ছিবওয়াই রহ. মাত্র বত্রিশ বছরে মারা যান। ইব্রাহীম নাখয়ী থেকে মানুষ হাদিস গ্রহণ করেন, তার বয়স মাত্র আঠারো বছর।
বুহতরী বলেন,
لا تنظرن إلى العباس من صغر في السن وانظر إلى الجد الذي شادا
إن النجوم نجومَ الأفق أصغرُها في العين أذهبُها في الجو إصعــادا
“আব্বাস বয়সে ছোট বলে তুমি তাকে তুচ্ছ মনে করো না। তুমি তার দৃঢ়তা ও জ্ঞানের গভীরতা দেখ। মরু ভূমিতে চলার জন্য পথনির্দেশক নক্ষত্রটি মহা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তবে দেখতে খুবই ছোট”।
যুবকরাই হলো, উম্মতের কাণ্ডারি, মজবুত খুঁটি, চালিকা শক্তি ও প্রাণ, যুবকদের ছোয়া ছাড়া কোনো দাওয়াত ও আন্দোলন কখনোই সফল হতে পারে না। যুবকদের শক্তি ও তাদের আন্দোলনের উপর ভিত্তি করেই যে কোনো আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মিশন সফল হয়।
মোটকথা, যে সমাজ বা দেশে যুব সমাজের চরিত্র ভালো থাকবে, সে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবন যাপন ঠিক থাকবে। আর যে সমাজে যুবকদের চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেবে, সে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবন যাপন ঠিক থাকবে না এবং সে সমাজের পতন ও ধ্বংস অনিবার্য।