যদি মৃতকে একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হয় বারবার জানাযার ছালাত আদায় করা, তাহলে তা নিকৃষ্ট বিদ‘আত হিসাবে পরিগণিত হবে। এটি সালাফে ছালেহীনের পথনির্দেশের বিরোধী এবং মৃতকে দ্রুত কাফন-দাফনের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশেরও বিরোধী। এছাড়া এর মাধ্যমে মৃতদের নিয়ে মানুষের মাঝে গর্ব-অহংকারের পর্দাতো উন্মুক্ত হয়ই। শুধু তাই নয়; বরং মৃতের কাফন-দাফনের বিষয়টি বিয়ের অনুষ্ঠানের মত হয়ে যায়।
আর বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, গায়েবানা জানাযা শরী‘আত সম্মত নয়। তবে মৃত ব্যক্তির জানাযা না কোথাও না পড়া হলে সেক্ষেত্রে তার গায়েবানা জানাযা পড়া যায়; যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন। অনুরূপভাবে দেশপ্রধান গায়েবানা জানাযার আদেশ করলে পড়া যেতে পারে। কেননা ইজতেহাদী কোন বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের অবাধ্য হওয়া উচিৎ নয়।
তবে কোনো জায়গা উত্তম হওয়ার কারণে অথবা সেখানে মৃত ব্যক্তির পরিবার-পরিজন থাকার কারণে সেখানে দাফন করার উদ্দেশ্যে যদি তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কোনো জায়গা উত্তম হওয়ার কারণে সেখানে মৃত দাফনের ভিড় পড়ে যেতে পারে এই আশংকায়, উক্ত জায়গা সংকীর্ণ হওয়ার কারণে অথবা ঠিকমত দাফনকার্য সম্পাদন করতে না পারার কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান মৃতকে সেখানে নিয়ে যেতে নিষেধ করেন, তাহলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমনিভাবে ওয়ারিছদের ক্ষতি হতে পারে এমন ব্যাপক পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ার আশংকা থাকলেও মৃতকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা যাবে না।
আবার কখনও মুর্দাকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করা আবশ্যক হয়ে পড়তে পারে। যেমনঃ কেউ যদি কাফের রাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করে, সেখানে মুসলিমদের ক্ববরস্থান না থাকে এবং ঐ দেশের অন্য কোথাও তাকে দাফন করা সম্ভব না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে মুসলিম রাষ্ট্রে স্থানান্তর করা আবশ্যক।
একই এলাকার একাধিক মসজিদে জানাযা পড়ানোর জন্য মৃত ব্যক্তিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করাও জঘন্য বিদ‘আত। অতএব, জানাযা পড়ার জন্য মৃত ব্যক্তির নিকটে যেতে হবে; তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে না।
২. জানাযার স্থান অত্যন্ত সংকীর্ণ হওয়ার কারণে মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়রা যদি ইমামের সাথে একই কাতারে দাঁড়ায়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে ইমাম ও প্রথম কাতারের মধ্যবর্তী স্থানেও যদি দাঁড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে ইমামের সাথে দাঁড়াবে না। তারা ইমামের ডান-বাম উভয় পাশে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু স্থানটি যদি প্রশস্ত হয়, তাহলে একই কাতারে ইমামের সাথে দাঁড়াবে না। কেননা জামা‘আতে ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে এমনভাবে দাঁড়ানো সুন্নাত পরিপন্থী। উল্লেখ্য যে, মৃত ব্যক্তির কতিপয় আত্মীয় ইমামের সাথে একই কাতারে দাঁড়ানোর জন্য সামনে যায় এবং মনে করে, এটিই সুন্নাত। কিন্তু মূলতঃ এমন আমল মারাত্মক ভুল, ইমামগণের উচিৎ মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে তোলা। সাথে সাথে তাদেরকে বলে দিতে হবে যে, ইহা সুন্নাত নয়।
৩. বিনা প্রয়োজনে ক্ববরস্থানে গাড়ী প্রবেশ করানো উচিৎ নয়। কেননা তা একদিকে যেমন স্থান সংকীর্ণ করে, অন্যদিকে তেমনি জানাযার দৃশ্যকে বিবাহ অনুষ্ঠানের দৃশ্যে পরিণত করে। ফলে তা মানুষকে আখেরাতের কথা স্মরণের বিষয়টি ভুলিয়ে দেয়।
৪. বর্তমানে শোক প্রকাশের সময় মুছাফাহা এবং কোলাকুলির যে রীতি মানুষ চালু করেছে, সালাফে ছালেহীন থেকে তার কোনো ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। অনুরূপভাবে শোকপ্রকাশকারীদের উদ্দেশ্যে মৃতের পরিবার-পরিজন কর্তৃক সারিবদ্ধ অবস্থানেরও কোন ভিত্তি আমার জানা নেই। কিন্তু কেউ কেউ বলে, যদি জানাযায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা অনেক হয় এবং মৃতের পরিবার-পরিজনের সংখ্যা বেশী হয়, তাহলে শোক প্রকাশকারীদের আরামের উদ্দেশ্যে তারা এরূপ সারিবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করে। এতে মৃতের পরিবার-পরিজনকে খুঁজে পেতে শোক প্রকাশকারীদের কষ্ট হয় না। তাদের উদ্দেশ্য সঠিক হলেও এমন আমল আমার পছন্দ নয়।
৫. জানাযা ও কাফন-দাফনে অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজ সে মৃত ব্যক্তির জানাযা ও কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করেছে; কিন্তু কাল তার জানাযায় অন্যরা অংশগ্রহণ করবে। অতএব, এসময় তাদেরকে দুনিয়াবী আলাপ-আলোচনা পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা এমন খোশ গল্প করলে একদিকে যেমন তারা আখেরাতের কথা স্মরণ করতে ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে তেমনি তা মৃতের শোকাহত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মনে আঘাত হানে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ববরস্থানে ক্ববর খনন সম্পন্ন হওয়ার আগে তাঁর ছাহাবীগণের সাথে বসে সময়োপযোগী আলোচনা করতেন। ছহীহ বুখারীতে আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমরা এক জানাযায় বাক্বী‘উল গারক্বাদ ক্ববরস্থানে ছিলাম। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বসলেন এবং আমরাও তাঁর পাশে বসলাম। তাঁর হাতে ছিল একটি লাঠি, অতঃপর তিনি মাথা নোয়ায়ে চিন্তামগ্ন অবস্থায় লাঠিটি দিয়ে মাটি খুঁটতে লাগলেন...।
মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাঊদসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমরা আনছারদের এক ব্যক্তির জানাযায় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হলাম। আমরা ক্ববরস্থানে পৌঁছে গেলাম, কিন্তু তখনও ক্ববর খনন সম্পন্ন হয় নি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে পড়লেন এবং আমরাও এমনভাবে বসে পড়লাম, যেন আমাদের মাথায় পাখি বসে আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে মাটি খুঁটতে খুঁটতে বললেন, ‘তোমরা প্রতিদিন ২/৩ বার আল্লাহ্র কাছে ক্ববরের আযাব থেকে পরিত্রাণ চাইবে’। অতঃপর তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে মৃত্যুর সময় এবং মৃত্যুর পরে মুমিন ও কাফিরের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করলেন।
উক্ত হাদীছদ্বয় থেকে আমরা জানতে পারলাম, জানাযা ও কাফন-দাফনে অংশগ্রহণকারীদের পারস্পরিক আলোচনা হবে মৃত্যু এবং মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়ে।
এই হাদীছদ্বয়ের আলোকে কেউ কেউ বলেন, এমন অবস্থায় মানুষদের উদ্দেশ্যে কিছু ওয়ায-নছীহত করা উচিৎ। সুতরাং কেউ দাঁড়িয়ে তাদের সামনে আলোচনা পেশ করবেন। কিন্তু হাদীছদ্বয় থেকে এমন দলীল গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্যে দাঁড়ান নি; বরং বসে বসে তাঁর আশেপাশের লোকদের সাথে কিছু কথা বলেছেন মাত্র।
৬. শোক প্রকাশকারীদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মৃতের পরিবার-পরিজন কর্তৃক বাড়ীতে অবস্থানের রীতি সালাফে ছালেহীনের যুগে ছিল না। সেজন্য কেউ কেউ স্পষ্টই বলেছেন যে, এমনটি করা বিদ‘আত। ‘আল-ইক্বনা ওয়া শারহুহু’ গ্রন্থকার বলেন, শোকপ্রকাশের জন্য বসা অপছন্দনীয়। অর্থাৎ মানুষ শোকাহত ব্যক্তিকে শোক জানাতে আসবে আর সে তাদের অপেক্ষায় বসে থাকবে, এমন রীতি অপছন্দনীয়। তাঁকে মৃতের পরিবার-পরিজনের উদ্দেশ্যে খাবার তৈরীর কথা বলা হলে তিনি বলেন, মৃতের পরিবার-পরিজনের উদ্দেশ্যে খাবার তৈরী করবে; তাদের নিকট আগত লোকজনের জন্য নয়। কেননা মৃতের বাড়ীতে আগতদের জন্য খাবার তৈরী করা অপছন্দনীয়। কারণ এতে মৃতের বাড়ীতে মানুষের সমবেত হওয়ার মত একটি অপছন্দনীয় কাজের প্রতি সাহায্য করা হয়।
মারওয়াযী (রহেমাহুল্লাহ) ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, এটি জাহেলী যুগের কর্মকাণ্ডের একটি। তিনি কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেন। অতঃপর তিনি জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর হাদীছ উল্লেখ করেন। জারীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর তার বাড়ীতে লোকজনের উপস্থিতি এবং তাদের জন্য খাবার তৈরীর বিষয়টি আমরা নিষিদ্ধ শোক-মাতমের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতাম। ইমাম নববী তাঁর ‘শারহুল মুহায্যাব’ গ্রন্থে বলেন, শোক প্রকাশের জন্য একত্রে বসাকে ইমাম শাফেঈ, মুহায্যাব গ্রন্থকার এবং শাফেঈ মাযহাবের সবাই অপছন্দনীয় গণ্য করেছেন। আবু হামেদসহ অন্যান্যগণ ইমাম শাফেঈ (রহেমাহুল্লাহ)-এর এই উক্তির ব্যাখ্যায় বলেছেন, এখানে শোক প্রকাশের জন্য বসার অর্থ হল, মৃতের পরিবার-পরিজনেরা বাড়ীতে একত্রে বসে থাকবে আর লোকজন তাদেরকে শোক জানাবে। সেজন্য মৃতের পরিবার-পরিজনের উচিৎ, নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে যাওয়া। এরপর তাদের সাথে কারো কোথাও দেখা হয়ে গেলে শোক জানাবে।
এখানে আরেকটি বিষয় হল, মৃতের পরিবারের সদস্যরা শোক প্রকাশকারীদের উদ্দেশ্যে বাড়ীর দরজা খুলে রেখে যেন বলতে চায়, আমরা আজ শোকাহত, তোমরা আমাদের উদ্দেশ্যে শোক প্রকাশ কর। অনুরূপভাবে পত্র-পত্রিকায় শোক প্রকাশের স্থান ঘোষণা করার অর্থও তাই। কারো শোক প্রকাশের প্রত্যাশী হয়ে মুছীবতের ঘোষণা দেওয়া কি সুন্নাত?! আল্লাহ্র তাক্বদীরকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিয়ে ধৈর্য্যধারণ করা এবং বিষয়টিকে তার এবং তার প্রভূর মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা কি উচিৎ ছিল না?! সকল সমস্যায় আল্লাহ্র ওয়াস্তে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া কি উচিৎ নয়।
কোন কোন এলাকায় তাঁবু খাটানো হয়, চেয়ার সাজানো হয় এবং আলোকসজ্জা করা হয়। আর উপস্থিতিদেরকে এত বেশী মাত্রায় প্রবেশ করতে এবং বের হতে দেখা যায় যে, বিয়ের অনুষ্ঠান এবং এর মধ্যে কোন পার্থক্যই করা যায় না।
আবার কখনও মৃতের রূহের মাগফেরাতের আশায় ক্বারী ও হাফেযদেরকে ভাড়া করে আনা হয়। অথচ এসব ক্ষেত্রে ভাড়া করা অন্যায়। মনে রাখতে হবে, এই অর্থলোভে ক্বুরআন পড়তে আসার কারণে ক্বারী কোন নেকী পাবে না। ফলে এভাবে ক্বারী ভাড়া করলে একদিকে যেমন সম্পদের ক্ষতি হয়, অন্যদিকে তেমন ঐসব ক্বারীকে অন্যায়ের প্রতি প্রলুব্ধ করা হয়।
এখন কেউ যদি বলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জাফর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের হত্যার খবর আসলে চিন্তামগ্ন হয়ে তিনি কি মসজিদে বসেন নি?
জবাবে বলব, হ্যাঁ, তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানুষ শোক জানাবে, সে উদ্দেশ্যে তিনি বসেন নি। সেজন্য তাঁকে কেউ শোক জানাতে বসেছিলেন মর্মে আমাদের কাছে কোন বর্ণনা আসে নি। অতএব, বাড়ীর দরজা খুলে রেখে শোক প্রকাশকারীদের সাক্ষাৎ প্রত্যাশী হওয়ার পক্ষে কোন দলীল এই ঘটনায় নেই।