ইজমার ব্যাপারে বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বতার ব্যাপারে একাধিক আলেম ইজমা সম্পন্ন হওয়ার কথা বলেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বতার ব্যাপারে আকল বা যুক্তিগত দলিল হলো এই যে, সর্বোর্ধ্বতা হলো পূর্ণাঙ্গতাবাচক একটি গুণ, আর নিম্নতা হলো অপূর্ণাঙ্গতাবাচক একটি গুণ। আর আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণাঙ্গতার গুণে গুণান্বিত এবং অপূর্ণাঙ্গতার গুণ থেকে পবিত্র।
ফিতরাতের দলিল হলো: এমন কোনো দো‘আ-প্রার্থনাকারী নেই আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকার সময় যার অন্তরাত্মা ঊর্ধ্বমুখি হয় না, যদিও কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে তার কোনো পড়াশোনা না থাকে, যদিও কোনো শিক্ষক তাকে শিখিয়ে না থাকে।
অকাট্য দলিলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য প্রমাণিত এই ঊর্ধ্বতার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের সঙ্গে থাকার কোনো সংঘর্ষ নেই। আর তা কয়েক কারণে:
প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে- যা বৈপরীত্য থেকে মুক্ত - এ দুটি বিষয়কে নিজের জন্য একত্র করে উল্লেখ করেছেন। অতএব এ দুটি যদি সাংঘর্ষিক হতো তবে আল কুরআন এ দুটোকে একত্র করে উল্লেখ করত না।
আর আল কুরআনের কোনো বিষয় যদি আপনার কাছে বৈপরীত্যপূর্ণ বলে মনে হয়, তাহলে তা বারবার ঘেঁটে দেখুন, যতক্ষণ না আপনার কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে না যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء: ٨٢]
তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ৮২)
দ্বিতীয়ত
‘সঙ্গে থাকা’ এবং উচুতে থাকা সৃষ্টিবস্তুর জন্যেও সম্ভব। যেমন চাদ। অতএব কেউ যদি রাতের বেলায় পথ চলার সময় বলে আমরা এ অবস্থায় চলছি যে, এখনো চাদ আমাদের সঙ্গেই আছে, তবে এটাকে বিপরীতমুখী কথা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যারা পথ চলে তারা জমিনে, আর চাদ হলো আকাশে। অতএব যদি একটি মাখলুখের ক্ষেত্রে এরূপ সম্ভব হয় তবে যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর ক্ষেত্রে এরূপ কেন সম্ভব হবে না।
‘বরং চাদ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন, সে আল্লাহর ছোট্ট মাখলুকের মধ্যে একটি। সে মুসাফির এবং অমুসাফিরের সঙ্গে আছে তারা যেখানেই থাক না কেন।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. এর এ কথার ব্যাখ্যায় শাইখ মুহাম্মদ খালীল আল হাররাস বলেন, ‘তিনি চাদের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়েছেন যা আকাশে স্থাপিত। চাদ মুসাফির ও অমুসাফির সবার সঙ্গেই আছে, তারা যেখানেই থাক না কেন। যদি এটা চাদের বেলায় সম্ভব হয় যা আল্লাহ তা‘আলার ছোট্ট মাখলুকের মধ্যে একটি, তাহলে যিনি সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি তাঁর বান্দাদের সকল বিষয় জানেন এবং তাদের সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান, যার হাতে আকাশ ও পৃথিবী ও সমগ্র মহাবিশ্ব ঠিক আমাদের হাতে থাকা ছোট্ট একটি গুটির মতো, তাঁর ব্যাপারে কি এটা বলা ঠিক হবে না যে তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন যদিও তিনি তাদের ঊর্ধ্বে, তাদের থেকে আলাদা এবং আরশের ওপরে?’[1]
তৃতীয়ত: যদি ধরে নিই যে ঊর্ধ্বতা এবং সঙ্গে থাকা এ দুটি বিষয় কোনো মাখলুকের ক্ষেত্রে একত্র হওয়া সম্ভব নয়, তবে এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় না যে, তা সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রেও অসম্ভব; কারণ আল্লাহ তা‘আলা হলেন উদাহরণহীন। তাঁর মতো কোনো জিনিস নেই।
﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]
তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।[2] (সূরা আশ-শূরা:১১)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. আল আকীদা আল ওয়াসিতিয়া গ্রন্থে বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের নিকটতা ও সঙ্গে থাকার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় যা এসেছে তা আল্লাহর সর্বোর্ধ্বতা ও সর্বোচ্চতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়; কারণ সকল গুণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা হলেন উদাহরণবিহীন। তিনি নিকটে থাকা সত্ত্বেও সর্বোর্ধ্বে, কাছে থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চতায়।’[3]
এ বিষয়ে খোলাসা কথা হলো:
১. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকার কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।
২. সঙ্গে থাকার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার জন্য উপযোগিভাবে প্রকৃত অর্থেই এবং তা কোনো মাখলুক কর্তৃক অন্যকোনো মাখলুকের সঙ্গে থাকার সদৃশ নয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের সঙ্গে থাকার দাবি হলো, তিনি তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা দ্বারা, শ্রবণ ও দর্শন দ্বারা, আধিপত্য ও ব্যবস্থাপনা দ্বারা এবং রুবুবিয়াতের অন্যান্য অর্থে, যদি সঙ্গে থাকার বিষয়টি অনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। আর যদি সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি অথবা গুণের সঙ্গে থাকার কথা উল্লিখিত হয় তখন ওপরে বর্ণিতভাবে সঙ্গে থাকার পাশাপাশি সাহায্য-সমর্থন করা, তাওফীক ও সঠিক পথ দেখানো ইত্যাদিও সঙ্গে থাকার অর্থে সন্নিবিষ্ট হবে।
৪. সঙ্গে থাকা এটা দাবি করে না যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকেন অথবা তাদের স্থলে অবস্থান করেন। ‘সঙ্গে থাকা’ কোনোভাবেই এ অর্থ বুঝায় না।
৫. ওপরে যা বর্ণিত হলো তা যদি অনুধাবন করে দেখি তবে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রকৃত অর্থে তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকা এবং প্রকৃত অর্থে আরশের ওপরে থাকা এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। পবিত্র মহান আল্লাহ তা‘আলা যার প্রশংসা করে আমরা শেষ করতে পারব না, তিনি নিজে যেভাবে নিজের প্রশংসা করেছেন তিনি ঠিক সে রকমই। সালাত ও সালাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীর প্রতি।
আল্লাহর মুখাপেক্ষী মুহাম্মাদ সালেহ আল উছাইমীন কর্তৃক রচিত।তারিখ: ২৭/১১/১৪০৩ হি.
[2] - দেখুন, মুহাম্মদ ইবনে আমীন আশ্শানকিতী, আদওয়াউল বয়ান, ------
[3] - শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া, পৃ. ১১৬