[একটি সন্দেহ ও তার উত্তর]

আর যদি মুশাব্বিহ তথা সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তি বলে: আমি আল্লাহ তা‘আলার অবতরণ, আল্লাহ তা‘আলার হাত ইত্যাদির দ্বারা তা-ই বুঝি যা সৃষ্টিজীবের রয়েছে; কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বোধগম্য ভাষাতেই তাঁর বাণী পাঠিয়েছেন, তবে এর উত্তর তিনভাবে দেওয়া যায়:

প্রথমত: যিনি বাণী পাঠিয়েছেন স্বয়ং তিনিই নিজ সম্পর্কে বলেছেন:

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١]

তাঁর মত কিছু নেই। (সূরা আশশুরা: ৪২: ১১)

অন্যত্র বলেছেন:

﴿ فَلَا تَضۡرِبُواْ لِلَّهِ ٱلۡأَمۡثَالَۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٧٤ ﴾ [النحل: ٧٤]

সুতরাং তোমরা আল্লাহর জন্য অন্যকোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না। (সূরা আন্- নাহল: ১৬: ৭৪)

তিনি অন্য এক আয়াতে বলেন:

﴿فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢]

সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। (সূরা আল বাকারা: ২: ২২)

আর আল্লাহ তা‘আলার সকল কথাই সত্য এবং একটি অন্যটিকে সমর্থন করে। অতএব এ ক্ষেত্রে কোনো বৈপরিত্ব নেই।

দ্বিতীয়ত: সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হবে: তুমি কি বুঝতে পার না যে আল্লাহ তা‘আলার একটি সত্তা রয়েছে যা অন্যান্য সত্তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়? উত্তরে সে বলবে, হ্যাঁ, বুঝতে পারি। এবার তাকে বলা হবে, তাহলে তুমি এটা কেন বুঝবে না যে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত রয়েছে যা অন্যসব সিফাত থেকে ভিন্ন। কারণ সত্তার ব্যাপারে যা প্রযোজ্য তা সিফাতেরও ব্যাপারেও প্রযোজ্য। আর যে ব্যক্তি সত্তা ও সিফাতের মধ্যে পার্থক্য করল সে বৈপরীত্যের আশ্রয় নিল।

তৃতীয়ত: সাদৃশ্যস্থাপনকারী ব্যক্তিকে বলা হবে, তুমি কি দেখ না যে মাখলুকাতের মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যার নাম অভিন্ন কিন্তু প্রকৃতি ও আকার-ধরনের বিবেচনায় একটি অন্যটি থেকে ভিন্ন? সে বলবে, হ্যাঁ দেখি। এরপর তাকে বলা হবে যদি তুমি মাখলুকাতের মধ্যে এ পার্থক্য মেনে নাও, তবে খালিক ও মাখলুকের মধ্যে পার্থক্য কেন মেনে নাও না। অথচ খালিক ও মাখলুকের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। বরং খালিক ও মাখলুকের মধ্যে সাদৃশতা একটি অসম্ভব ব্যাপার। সিফাত-বিষয়ক ষষ্ঠ মূলনীতিতে এ বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।

তৃতীয় দল: যারা বলে যে সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ বাতিল এবং তা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। বরং তা হলো তাশবীহ বা সাদৃশ্য স্থাপন। এরপর তারা বাহ্যিক অর্থকে আল্লাহর জন্য উপযোগী পদ্ধতিতে মেনে নেয়াকেও অস্বীকার করেন। এরা হলো আহলে তা‘তীল অর্থাৎ অর্থশূণ্যকারী সম্প্রদায়। তাদের এই অর্থশূণ্যকরণ প্রক্রিয়া নাম ও সিফাত উভয় ক্ষেত্রেই অথবা শুধু সিফাতের ক্ষেত্রে অথবা নাম ও সিফাত এ দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটির ক্ষেত্রে সেটা তারা করে থাকে। তারা নাম ও সিফাত সংবলিত এ টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ থেকে সরে এসে নিজদের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী সেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করেছে। তবে তারা এ অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত পথ অবলম্বন করেছে। তারা এটার নাম দিয়েছে তা’বিল বা ব্যাখ্যা, কিন্তু আসলে তা তাহরীফ বা বিকৃতি।

তাদের এ মতামত কয়েক কারণে বাতিল:

প্রথমত: এটা আল্লাহ ও তার রাসূলের বাণীর বিপক্ষে স্পর্ধা প্রদর্শন; কারণ তারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের বাণীর এমন অর্থ করেছে যা বাতিল এবং আল্লাহর জন্য অনুপযোগী, বরং আল্লাহর উদ্দেশের বিরুদ্ধে।

দ্বিতীয়ত: এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে স্পষ্ট আরবী ভাষায় খেতাব করেছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর কালামকে আরবী ভাষার দাবি অনুযায়ী বুঝতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলেছেন; অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীকে আরবী ভাষার বাহ্যিক অর্থ ও দাবি অনুযায়ী বুঝতে হবে। তবে আল্লাহর (সত্ত্বা, নাম ও গুণের) ক্ষেত্রে সে অর্থের আকার-প্রকৃতি, ধরণ ও তুলনা নির্ধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

তৃতীয়ত: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে বাহ্যিক অর্থে না নিয়ে এমন অর্থে নেওয়া যা বাহ্যিক অর্থের বিপরীত, নিশ্চয় একটি হারাম কাজ এবং অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলা যা তিনি বলেন নি। বিষয়টি যে হারাম তা নিম্নোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায়:

﴿ قُلۡ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَ وَٱلۡإِثۡمَ وَٱلۡبَغۡيَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَأَن تُشۡرِكُواْ بِٱللَّهِ مَا لَمۡ يُنَزِّلۡ بِهِۦ سُلۡطَٰنٗا وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٣ ﴾ [الاعراف: ٣٣]

বল, ‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’। (সূরা আল আরাফ: ৭: ৩৩)

﴿ وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ إِنَّ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡبَصَرَ وَٱلۡفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنۡهُ مَسۡ‍ُٔولٗا ٣٦ ﴾ [الاسراء: ٣٦]

“আর যে ব্যাপারে তোমার জ্ঞান নেই সেটার অনুসরণ করো না, নিশ্চয় কান, চোখ এবং অন্তর এসব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সূরা আল ইসরা: ১৭: ৩৬)

অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে বিপরীত কোনো অর্থে ব্যবহার করল সে এমন বিষয়ের অনুসরণ করল যার ব্যাপারে তার কোনো ইলম নেই এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলল যার ব্যাপারে তার কোনো জ্ঞান নেই; কারণ:

এক. সে ধারণা করল যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীর উদ্দেশ্য এরকম নয়, অথচ এরকমটাই বাণীর বাহ্যিক অর্থ।

দুই. সে ধারণা করল যে বাণীর উদ্দেশ্য অন্যটা; যা বাহ্যত বাণী থেকে বুঝা যাচ্ছে না।

আর এটা আমাদের জানা যে, আল কুরআনের কোনো শব্দের যদি দুটি অর্থ থাকে এবং উভয়টিই সমান সম্ভাবনাময় হয়, তাহলে এই দুই অর্থের মধ্যে একটিকে নির্ধারণ করে দেওয়া বৈধ নয়; কেননা এতে অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ওপর এমন কথা বলা হবে যা তিনি বলেননি। বিষয়টি যদি এমনই স্পর্শকাতর হয়ে থাকে, তাহলে আপনিই বলুন, যদি কেউ বাহ্যিক অর্থ বর্জন করে এমন অনগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অর্থকে নির্ধারিত করে দেয় যা তার বিপরীত, তাহলে সে কি ধরনের অন্যায়ের আশ্রয় নেয়?

এর উদাহরণ: ইবলীসকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ قَالَ يَٰٓإِبۡلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ﴾ [ص: ٧٥]

আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস, আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে তোমাকে বাধা দিল? (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)

এই আয়াতের অর্থ নির্ধারণে যদি কেউ বাহ্যিক অর্থ থেকে সরে গিয়ে বলে যে, এখানে দু‘হাত বলতে মূলত হাত বুঝানো হয়নি বরং এখানে হাত দ্বারা বুঝানো হয়েছে এই এই। তাহলে এই ব্যক্তিকে বলব যে আপনি যে বাহ্যিক অর্থকে নাকচ করে দিলেন এর পক্ষে আপনার দলিল কি? আর যে অর্থকে আপনি প্রমাণ করলেন তার সপক্ষে প্রমাণ কি? সে যদি দলিল নিয়ে আসতে পারে তো ভালো, কিন্তু সে দলিল পাবে কোথায়। অতএব সে যা নাকচ করল এবং যা প্রমাণ করল উভয় ক্ষেত্রেই সে ইলম ব্যতীত আল্লাহর ওপর এমন কথা বলল যা আল্লাহ তা‘আলা বলেননি।

চতুর্থত: আহলে তা‘তীল তথা ‘আল্লাহর নাম ও গুণের ভাষ্যসমূহকে অর্থশূণ্যকারী’ সম্প্রদায়ের কথা এজন্যও প্রত্যাখ্যাত যে সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামগণ যার ওপর ছিলেন তার বিরুদ্ধে যাওয়া। অতএব তা বাতিল। কেননা হক ও সত্য তো নিঃসন্দেহে তাই যার ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামগণ ছিলেন।

পঞ্চমত: এ ধরনের ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে বলা হবে, আল্লাহ তা‘আলা নিজ সম্পর্কে যতটুকু জানেন তুমি কি তার থেকেও বেশি জান? সে নিশ্চয় উত্তরে বলবে যে না, জানি না।

এবার তাকে প্রশ্ন করে বলা হবে: আল্লাহ তা‘আলা নিজ সম্পর্কে যা জানিয়েছেন তা কি হক ও সত্য? সে নিশ্চয় উত্তরে বলবে, হ্যাঁ, হক ও সত্য।

এরপর তাকে বলা হবে: আল্লাহ তা‘আলার বাণী যে বিশুদ্ধতম ও স্পষ্টতম বাণী, তা কি তুমি বিশ্বাস কর? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ, বিশ্বাস করি।

এরপর তাকে বলা হবে: তাহলে তুমি কি মনে কর যে, আল্লাহ তা‘আলা এই টেক্সটসমূহের অর্থ কি তা অস্পষ্ট আকারে রেখে দেবেন যাতে মানুষ তার বুদ্ধি-বিবেচনা ব্যবহার করে তা উদ্ধার করে নেয়। উত্তরে সে অবশ্যই বলবে: না।

এ গেল আল-কুরআনের টেক্সটসমূহের কথা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নায় সিফাত-বিষয়ক যেসব টেক্সট এসেছে তার ব্যাপারে একই ধরনের প্রশ্ন করা যায়। অতঃপর বলা যায় যে: তুমি কি আল্লাহর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও অধিক জান? সে বলবে, না, জানিনা।

এরপর তাকে বলা হবে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ সম্পর্কে যা বলেছেন তা কি হক ও সত্য? সে বলবে, হ্যাঁ, হক ও সত্য।

এরপর তাকে বলা হবে: তুমি কি এমন কাউকে জান যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী? উত্তরে সে অবশ্যই বলবে, না।

এরপর তাকে বলা হবে: তুমি কি এমন কাউকে জান যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে উম্মতের জন্য অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী? সে অবশ্যই বলবে, না।

এরপর তাকে বলা হবে: যদি তুমি উল্লিখিত কথাগুলো স্বীকার করে নাও, তাহলে কেন তোমার যথেষ্ট সাহস হয় না যে তুমি আল্লাহর জন্য ঠিক তা সাব্যস্ত করবে যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন, প্রকৃত ও আল্লাহর জন্য উপযোগী বাহ্যিক অর্থ হিসেবে। অথচ দেখা যায় যে প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থ নাকচ করে দেওয়া এবং এর স্থলে বিপরীত অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে তুমি বাহাদুরী দেখাও।

এতে তোমার কি ক্ষতি যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য তাঁর কিতাবে যা সাব্যস্ত করেছেন তুমিও তা তাঁর জন্য সাব্যস্ত করবে। অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাতে আল্লাহর জন্য উপযোগীভাবে যা সাব্যস্ত করেছেন তুমিও তা সাব্যস্ত করবে। অতএব কুরআন-সুন্নায় সাব্যস্ত করা ও অসাব্যস্ত করার বিষয়ে যা কিছু এসেছে তুমি তা মেনে নেবে। এটাইকি তোমার জন্য সঠিক ও নিরাপদ নয়? কারণ তোমাকে তো কিয়ামতের ময়দানেই জিজ্ঞাসা করা হবে:

﴿مَاذَآ أَجَبۡتُمُ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ٦٥ ﴾ [القصص: ٦٥]

‘তোমরা রাসূলদেরকে কী জবাব দিয়েছিলে?’ (সূরা আল কাসাস: ২৮: ৬৫)

তুমি যদি সিফাত-বিষয়ক বাণীসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে নিয়ে তার অন্যকোনো অর্থ কর, এটা কি তোমার জন্য বিপদের কারণ হবে না, কেননা হতে পারে যে তুমি যে অর্থ করেছ সেটা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হলো অন্যটা।

ষষ্ঠত: আহলে তা‘তীল তথা আল্লাহর নাম ও গুণের ভাষ্যসমূহকে অর্থশূণ্যকারীদের কথা এজন্যও অগ্রহণযোগ্য যে তা মেনে নিলে কিছু অযাচিত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। অতএব তা বাতিল। যেমন:

এক. আহলে তা‘তীল: সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে এ জন্যে সরিয়ে নেয় যে তারা মনে করে থাকে এগুলোর বাহ্যিক অর্থ এ অনুভূতি দেয় অথবা এ দাবি করে যে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজীব সদৃশ। অথচ আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টিজীব সদৃশ মনে করা কুফরি; কেননা তাতে আল কুরআনের ওই আয়াতকে অস্বীকার করা হয় যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١]

‘তাঁর মত কিছু নেই।’ (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)

নু‘আইম ইবনে হাম্মাদ আল-খুযা‘ঈ, যিনি ইমাম বুখারী র. এর একজন উস্তাদ ছিলেন, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করল সে কাফের হয়ে গেল। আর আল্লাহ তা‘আলা নিজকে যেভাবে গুণান্বিত করেছেন এবং তাঁর রাসূল তাঁকে যেভাবে গুণান্বিত করেছেন তাতে কোনো তাশবীহ তথা সাদৃশ্যকরণ নেই।’

আর এটা স্পষ্ট যে সবচেয়ে বড় বাতিল বিষয় হচ্ছে, মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর বাহ্যিক অর্থকে এমন মনে করা যে তাতে সৃষ্টিজীবের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া বাধ্য করে এবং তাতে কুফরি হওয়া আবশ্যক হয়ে যায় অথবা সেটাতে নিপতিত হওয়ার সন্দেহে পড়তে হয়।

দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার কিতাব যা তিনি নাযিল করেছেন সকল বিষয়ের বর্ণনা হিসেবে, মানুষের জন্য হিদায়েত হিসেবে, অন্তরে থাকা সকল ব্যাধির চিকিৎসা ও প্রস্ফুটিত আলো হিসেবে, হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসেবে, সে কিতাবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাম ও সিফাত সম্পর্কে কি ধরনের বিশ্বাস পোষণ করতে হবে তা স্পষ্টভাবে বলে দেবেন না বরং বিষয়টি মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেবেন যে, তারা যা ইচ্ছা তা সাব্যস্ত করবে এবং যা ইচ্ছা তা অসাব্যস্ত করবে, এটা কি করে সম্ভব! অতএব এ ধরনের বিশ্বাসই বরং বাতিল।

তৃতীয়ত: আহলে তা‘তীলের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, সালাফগণ এবং আয়েম্মায়ে কিরাম মহান আল্লাহর সিফাত-বিষয়ে যা জানার প্রয়োজন ছিল তা জানা এবং প্রচার করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন; কেননা আহলে তা‘তীল ‘তাবিল’ এর নামে যেসব কথা বলেছেন এসব কথার একটি অক্ষরও তাঁরা বলেননি।

অতএব হয়তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশেদা, সাহাবায়ে কেরাম, সালাফগণ এবং আয়েম্মায়ে কিরাম সিফাত-বিষয়ে যথার্থ জ্ঞানার্জন বিষয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন অথবা উম্মতের উদ্দেশে তা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। আর উভয় কথাই বাতিল।

চতুর্থত: আহলে তা‘তীলের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা সাব্যস্ত করেছেন তা নাকচ করে দেওয়া বৈধ। অর্থাৎ যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ وَجَآءَ رَبُّكَ﴾ [الفجر: ٢٢]

‘এবং তোমার রব আসবেন।’ (সূরা: আল ফাজর: ৮৯: ২২)

সেখানে বলা শুদ্ধ হবে যে, না, আল্লাহ তা‘আলা আসবেন না। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে বলেছেন যে,

«ينزل ربنا إلى السماء الدنيا»

‘আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতেই নিম্নাকাশে অবতরণ করেন’,

সেখানে বলা শুদ্ধ হবে যে, না, আল্লাহ তা‘আলা অবতরণ করেন না। কারণ তারা উল্লিখিত আয়াত এবং হাদীসের অর্থ করতে গিয়ে বলেন যে এখানে ‘আসা’ এবং ‘অবতরণ’ করাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা রূপক অর্থে, প্রকৃত অর্থে নয়। অর্থাৎ তাদের ধারণা মতে এখানে অর্থ হবে, ‘আল্লাহর নির্দেশ আসা’। রূপক অর্থের বড় আলামত হলো প্রকৃত অর্থকে নাকচ করে দেওয়া শুদ্ধ হওয়া। আর আল্লাহ এবং তার রাসূল যা সাব্যস্ত করেছেন তা নাকচ করে দেওয়া জঘন্যতম বাতিল বিষয়। অন্যকোনো অর্থে তাবিল করার দ্বারা এ বাতুলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না; কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীর কনটেক্সটে এমন কোনো ইশারা নেই যার দ্বারা বুঝা যাবে যে এখানে অর্থ হলো ‘নির্দেশ আসা’।