এ বাণীসমূহের প্রকাশ্য অর্থ কি তা আমাদের জ্ঞাত, কিন্তু এ অর্থের ‘কাইফিয়াত’ তথা আকার-প্রকৃতি বা ধরণ কি তা আমাদের অজ্ঞাত।
এ কথার পক্ষে দলিল হলো ওহী ও যুক্তি।
- ওহী থেকে দলিল:
আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীসমূহ এ ক্ষেত্রে ওহী-কেন্দ্রিক দলিল:
﴿ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩ ﴾ [ص: ٢٩]
আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা সাদ: ৩৮: ২৯)
অন্য এক আয়াতে এসেছে:
﴿ إِنَّا جَعَلۡنَٰهُ قُرۡءَٰنًا عَرَبِيّٗا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٣ ﴾ [الزخرف: ٣]
নিশ্চয় আমি তো একে আরবী কুরআন বানিয়েছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা আয্যুখরুফ: ৪৩: ৩)
আরো ইরশাদ হচ্ছে:
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤]
এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে। আর যাতে তারা চিন্তা করে। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৪৪)
আর চিন্তা-গবেষণা তো সেটাতেই চলে যাতে চিন্তা করলে তা বুঝে তা থেকে অন্যকে বুঝানো সম্ভব হয়।
আর কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার অর্থ তো যারা আরবী ভাষা জানে তারা যেন তা যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারে; এটা প্রমাণ করে যে এর অর্থ আমাদের জানা, নতুবা আরবী ভাষা ও অন্য ভাষায় নাযিল করার মধ্যে পার্থক্য হতো না।
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মানুষের জন্য কুরআনের বর্ণনা সেটা তার শব্দ ও অর্থ উভয়কেই যথাযথভাবে শামিল করে।
- যুক্তি: এটা অসম্ভব যে আল্লাহ তা‘আলা এমন কিতাব নাযিল করবেন এবং তাঁর রাসূলের কাছে এমন কথা পাঠাবেন যার উদ্দেশ্য হবে মানুষের হিদায়েত অথচ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে তা থাকবে অজ্ঞাত অর্থবোধক অথবা এমন খন্ডাক্ষরের ন্যায় যা থেকে কোনো কিছুই বোঝা যায় না। এরূপ হলে তা হবে আল্লাহ তা‘আলার হিকমতবিরুদ্ধ। আর তাইতো আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
﴿ الٓرۚ كِتَٰبٌ أُحۡكِمَتۡ ءَايَٰتُهُۥ ثُمَّ فُصِّلَتۡ مِن لَّدُنۡ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ١ ﴾ [هود: ١]
এটি কিতাব যার আয়াতসমূহ সুস্থিত করা হয়েছে, অতঃপর বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত সত্ত্বার পক্ষ থেকে। (সূরা হুদ: ১১: ১)
সিফাত-বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ যে আমাদের জানা, তার পক্ষে ওহী ও যুক্তিভিত্তিক দলিল ওপরে পেশ করা হলো।
আর আমরা যে সিফাত-বিষয়ক কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ জানা সত্ত্বেও তার বাস্তব আকার-প্রকৃতি বা ধরণ কি সে ব্যাপারে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই এ কথার পক্ষে ওহী ও যুক্তিভিত্তিক দলিল সিফাত-বিষয়ক ষষ্ঠ মূলনীতিতে উল্লিখিত হয়েছে।
এর দ্বারা বুঝা গেল যে ‘মুফাউয়েযা’ সম্প্রদায় যা বলে তা বাতিল। মুফাউয়েযা সম্প্রদায় হলো তারা যারা সিফাত-বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যসমূহের অর্থ আল্লাহর ইলমের কাছে সোপর্দ করেন। অর্থাৎ তারা বলেন, এসবের বাহ্যিক অর্থ আমাদের জানা নেই, বরং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই এসবের অর্থ সম্পর্কে ইলম রাখেন। তারা দাবি করেন যে এটাই হলো সালাফে সালেহীনদের মাযহাব। অথচ সালাফগণ এ জাতীয় চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। সালাফদের থেকে বরং অকাট্য বর্ণনা পরম্পরায় এসব টেক্সট বা ভাষ্যের অর্থ সাব্যস্ত করার কথা এসেছে। কখনো এজমালি অর্থ আবার কখনো বিস্তারিত অর্থ। তবে এ অর্থের বাস্তব আকার-প্রকৃতি কি, তা তারা আল্লাহ তা‘আলার ইলমের কাছে সমর্পণ করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ র. তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আকল ও নকল’ এর প্রথম খন্ডের ১১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলেন: ‘আর তাফওয়ীয (অর্থাৎ আল্লাহর ইলমের কাছে সমর্পণ করা) এর ব্যাপারে বলব, এটা স্পষ্ট যে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা, বুঝা ও তার অর্থোদ্ধারের জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব আল কুরআন বুঝা, আল কুরআন জানা এবং তার অর্থোদ্ধার করা থেকে বিমুখ হওয়া কীভাবে কাম্য হতে পারে? এরপর তিনি ১১৮ নং পৃষ্ঠায় বলেন: ‘কথা যদি এ রকমই হত, তাহলে বলতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনে নিজের সিফাত সম্পর্কে যা যা বলেছেন, অথবা এ ব্যাপারে অধিকাংশ বিষয় যা তিনি বলেছেন, তার অর্থ নবীগণও বুঝতেন না। বরং তারা এমন কথা বলতেন যার অর্থ তাদের কাছে বোধগম্য ছিল না। বলাবাহুল্য যে এটা আল কুরআন এবং নবীগণ উভয়কেই দোষারোপ করা; কারণ আল্লাহ তা‘আলা কুরআন নাযিল করেছেন এবং তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে তা তিনি হিদায়েত ও মানুষের জন্য বর্ণনাস্বরূপ নাযিল করেছেন। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন তা স্পষ্টাকারে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি যেন মানুষের জন্য স্পষ্টরূপে বয়ান করে দেন তাদের ওপর কি নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন, তিনি তা বুঝতে বলেছেন। এর পাশাপাশি আল কুরআনের সর্বোত্তম বিষয় হলো রাব্বুল আলামীন তাঁর সিফাত বিষয়ক যে বাণীগুলো নাযিল করেছেন। অতএব এটা কীভাবে বলা শুদ্ধ হতে পারে যে, এসবের অর্থ কেউ জানে না, এসব বোধগম্য নয়। এটা কি হতে পারে যে মানুষের জন্য যা নাযিল হয়েছে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে স্পষ্টভাবে পৌঁছাননি? অথচ এই ধারণার ওপর নির্ভর করেই প্রত্যেক মুলহিদ ও বিদআতপন্থী বলে যে, প্রকৃত সত্য হলো তা যার ইলম আমি নিজ মত ও বুদ্ধির মাধ্যমে পেয়েছি, আর কুরআন-সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যে আমার মতের বিপরীত কিছু নেই; কেননা ওইসব টেক্সট বা ভাষ্য দুর্বোধ্য, মুতাশাবিহ, কেউ তার অর্থ বোঝে না। আর যার অর্থ কেউ জানে না তা দ্বারা দলিল দেওয়া শুদ্ধ নয়। এ জাতীয় কথার অর্থ হলো নবীগণের পক্ষ থেকে যে হিদায়েত এসেছে তার দরজা বন্ধ করে দেওয়া এবং যারা তাদের বিরোধী তাদের দরজা উন্মুক্ত করা। এরূপ ব্যক্তি প্রকারান্তরে বলে যে হিদায়েত ও বয়ান আমাদের পথে, নবীগণের পথে নয়; কেননা আমরা যা বলি তার অর্থ আমরা জানি এবং মানুষের জন্য তা যুক্তিভিত্তিক দলিল দ্বারা বয়ান করি। আর নবীগণ যা বলতেন তার অর্থ তারা বুঝতেন না, অতএব মানুষের জন্য তা বয়ান করার তো প্রশ্নই আসে না।
এ আলোচনার দ্বারা বুঝা গেল যে আহলে তাফউয়ীয তথা এগুলো বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর কাছে সমর্পণকারী সম্প্রদায়, যারা সুন্নাতের অনুসারী এবং সালাফদের অনুসারী হিসেবে নিজেদের মনে করে, তাদের কথা ইলহাদ ও বিদআতপন্থীদের সকল কথার চেয়ে জঘন্য কথা।’
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ র. এর কথা এখানেই শেষ। তিনি সঠিক কথা বলেছেন যা পরিপক্ক চিন্তা থেকে উঠে এসেছে। এ কথার পর এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আর কিছু বলার থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর অঢেল রহমত বর্ষণ করুন এবং জান্নাতে আমাদেরকে তাঁর সঙ্গে একত্র করুন।