মাদ্রাসা নির্মাণ, কিতাব লিখন ও সংকলন করা বিদ‘আত নয়
  • কেউ কেউ এ বলে প্রশ্ন করতে পারে যে, এখানে কতক বিষয় আছে যা নব আবিষ্কৃত অথচ মুসলিমরা তা গ্রহণ করেছে এবং তার ওপর তারা আমল করছে অথচ এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে উপস্থিত ছিল না। যেমন, মাদ্রাসা নির্মাণ, কিতাব লিপিবদ্ধ করা ইত্যাদি। এ ধরনের বিদ‘আতকে মুসলিমরা বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করে না বরং তারা এ ধরনের কর্মকে ভালো মনে করেন, তদনুযায়ী আমল করেন এবং তারা মনে করেন এগুলো ভালো কর্ম ও গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। তাহলে কিভাবে এ কর্মসমূহ যা মুসলিমদের মাঝে ইজমার রূপ লাভ করছে এবং মুসলিমদের নেতা ও নবী এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে যিনি নবী তার কথা «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” এর মাঝে সামঞ্জস্য সাধন করবে?

উত্তর:

বাস্তবে এগুলো কোনো বিদ‘আত নয়; বরং এগুলো হলো শরী‘আতের ওপর আমল করা ও শরী‘আত সম্পর্কে জানার মাধ্যম। আর যেগুলো মাধ্যম বা অসীলা হয় সেগুলো সময় ও স্থানের ব্যবধানে প্রার্থক্য হয়ে থাকে। আর স্বীকৃত নিয়ম হলো, মাধ্যমগুলো বিধান আর উদ্দ্যেশের বিধান একই হয়ে থাকে। বৈধ বিধানের মাধ্যম বৈধ। আর যা অবৈধ তার মাধ্যমও অবৈধ; বরং হারাম কর্মের মাধ্যম হারাম এবং ভালো কর্ম যদি খারাপ কর্মের মাধ্যম হয়ে থাকে তখন তাও হারাম হয়ে যায়। আল্লাহর বাণীর দিকে মনোযোগ দাও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تَسُبُّواْ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ فَيَسُبُّواْ ٱللَّهَ عَدۡوَۢا بِغَيۡرِ عِلۡمٖۗ ١٠٨﴾ [الانعام: ١٠٨]

“আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১০৮]

মুশরিকদের ইলাহদের গালি দেওয়া শত্রুতা নয় বরং তা সত্য ও বাস্তব সম্মত; কিন্তু রাব্বুল আলামীনকে গালি দেওয়া অসঙ্গত, অবাস্তব, সীমালঙ্ঘন ও অন্যায়। কিন্তু মুশরিকদের ইলাহদের গালি দেওয়া ভালো কাজ হলেও যেহেতু তা আল্লাহকে গালি দেওয়ার কারণ বা অসীলা হয়ে থাকে তাই তা নিষিদ্ধ ও হারাম।

আমি এখানে মাধ্যম ও উদ্দেশ্যের বিধান এক হওয়ার দলীল টেনে ধরলাম। মাদ্রাসাসমূহ, ইলম সংকলন ও কিতাব লিখন ইত্যাদি যদিও যদি রাসূলের যুগে এ পদ্ধতিতে না থাকার কারণে তা বিদ‘আত কিন্তু এ সব কোনো কিছুই উদ্দেশ্য নয়। এগুলো সবই হলো মাধ্যম বা অসীলা। আর মাধ্যমের বিধান ও উদ্দেশ্যের বিধান এক। এ কারণেই যদি কোনো ব্যক্তি কোন হারাম শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি মাদ্রাসাহ নির্মাণ বা চালু করে তখন তার মাদ্রাসাহ নির্মাণ করা বা চালু করা হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি বৈধ শিক্ষা শেখানোর উদ্দেশ্যে হয়, তা হলে তার নির্মাণ বা চালু করা হবে বৈধ হবে।

  • আর যদি কেউ বলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা «من سن في الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها إلى يوم القيامة» “যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে একটি ভালো সুন্নত প্রচলন করল তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত তার আমলের সাওয়াব এবং যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী আমল করল তার সাওয়াব মিলবে”।[1] এর কি উত্তর দেবে?

এ প্রশ্নের উত্তর হলো, যিনি «من سن في الإسلام سنة حسنة» “যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে একটি ভালো সুন্নত প্রচলন করল” এ কথা তিনিই বলেছেন তিনি স্বয়ং «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” কথাটি বলেছেন। একজন মহা সত্যবাদী দ্বারা এমন কথা বলা কখনো সম্ভব নয় যে, তার একটি কথা অপর কথাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। রাসূলের কথায় কোনো প্রকার বৈপরীত্য থাকা কখনো সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি এ ধারণা করে যে, আল্লাহর কথা ও তার রাসূলের কথার মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে, তাকে অবশ্যই পূণরায় তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখতে হবে এবং আবার ভেবে দেখতে হবে। তার এ ধারণা হয়তো তার ঈমানী দুর্বলতার কারণে হতে পারে বা অলসতার কারণে হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলার কথা বা তার রাসূলের কথার মধ্যে বৈপরীত্য বা কোনো প্রকার দুর্বলতা পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। এ কথা স্পষ্ট হওয়ার পর উভয় হাদীস তথা «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” এবং «من سن في الإسلام سنة حسنة» “যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে একটি ভালো সুন্নত প্রচলন করল” বৈপরীত্ব না থাকা সুস্পষ্ট। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «من سن في الإسلام سنة حسنة» “যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে একটি ভালো সুন্নত প্রচলন করল” আর বিদ‘আত তো ইসলাম থেকে নয়। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «حسنة» হাসানাহ’। বিদ‘আত তো কখনো হাসানাহ হতে পারে না। আর তিনি السن ‘চালু করা’ এবং التبديع ‘আবিষ্কার করা’ উভয়ের মধ্যে প্রার্থক্য করেছেন।

এখানে আরও একটি উত্তর রয়েছে, আর তা হলো, এখানে «من سن» অর্থ, যে ব্যক্তি কোনো সুন্নাতকে জীবিত করল, অর্থাৎ সুন্নতটি পূর্বে ছিল পরবর্তীতে তা বিলীন হওয়ার পর আবার তা চালু করল। এ অর্থ অনুযায়ী একটি সুন্নত চালু করার অর্থ সূন্নাতটি পূর্বেই ছিল তা পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে তা আবার চালু করা। সুতরাং, চালু করা মানে নতুন আবিষ্কার নয়। এখানে এ প্রশ্নের আরো একটি উত্তর রয়েছে, যে উত্তরটি হাদীস অবতীর্ণের কারণ থেকে প্রতীয়মান। আর তা হলো, একদল লোক রাসূলের নিকট আসল। তাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য দান করতে আহ্বান করলেন, তখন একজন আনসারী লোক আসল, তার হাতে একটি রূপার থলে ছিল যার ওজনে তার হাত খুব ভারী মনে হলো, সে থলেটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রাখল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা আনন্দ ও খুশিতে চমকিতে লাগলো এবং তিনি বললেন, «من سن في الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها إلى يوم القيامة» “যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে একটি ভালো সুন্নত প্রচলন করল তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত তার আমলের সাওয়াব এবং যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী আমল করল তার সাওয়াব মিলবে”।[2] সুতরাং এখানে «السن» অর্থ, আমল বাস্তবায়ন করা আবিষ্কার করা নয়। ফলে «من سن في الإسلام سنة حسنة» “যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে একটি ভালো সুন্নত প্রচলন করল” এর অর্থ হলো, কোন আমল বাস্তবায়ন করা আবিষ্কার করা নয়। কারণ, আবিষ্কার করা নিষিদ্ধ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী”।

>
[1] বর্ণনায় সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়, হাদীস নং ১০১৭

[2][2] বর্ণনায় সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়, হাদীস নং ১০১৭