আর আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, এ মুসলিম জাতির অনেক দল ও গোষ্ঠী তাদের সামনে আসা প্রতিটি রীতিনীতি, প্রথা এবং বিশেষ ঐতিহ্য ও আনুষ্ঠানিকতাকে গ্রহণ করে নেয় সে ব্যাপারে শরী‘আত ও যুক্তির নিরিখে কোনোরূপ ইতস্তত ও চিন্তা-ভাবনা না করেই। অথচ তাদের দায়িত্ব হলো, তারা সেগুলোর ব্যাপারে খতিয়ে দেখবে যে, তা আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী কিনা? তারপর যখন সেগুলো আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী হবে, তখন তারা সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকবে, যেমনিভাবে সুস্থ শরীর রোগজীবাণুকে প্রত্যাখ্যান করে। অতঃপর তাদের যেসব মুসলিম ভাইগণ কোনো রকম চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই তাদের সমাজে এসব শরী‘আত বিরোধী কাজ উপস্থাপন ও আমদানি করেছে, তাদের মধ্য থেকে যে বা যারা এসব কাজে জড়িত হবে, তারা তাদেরকে উপদেশ দিবে। আর এটাই হলো মুমিনের প্রকৃত স্বরূপ যে, তিনি হবেন শক্তিশালী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অনুসরণীয়, অনুসরণকারী নয়। আবার তিনি হবেন সৎব্যক্তি, সংশোধনকারী, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তাভাবনাকারী। আর যখন আমাদের নিকট আসা এসব রীতিনীতি, প্রথা এবং বিশেষ ঐতিহ্য ও আনুষ্ঠানিকতা শরী‘আত বিরোধী না হবে, তখন আমাদের জন্য উচিত হবে, বর্তমানে, ভবিষ্যতে, নিকটতম ভবিষ্যতে ও সুদূর ভবিষ্যতে তার ফলাফল কী হবে, সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা। কারণ, কখনও কখনও বর্তমান কালে তার অনুভবযোগ্য (নেতিবাচক) প্রভাব থাকে না, কিন্তু ভবিষ্যতে তার অপেক্ষমান প্রভাব থাকতে পারে। আর যখন আমরা এ দৃষ্টিভঙ্গিটি চালু করব এবং এ লাইনে পথ চলব, তখন এর অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলার অনুমোদনক্রমে আমরা বুদ্ধিমত্তার ওপর ভিত্তি করে এবং সঠিক ও যথাযথ নির্দেশনা বা দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই পথ চলছি।

আর আপনি অনেক যুবতী নারীকে তার ঘর থেকে বাজারের উদ্দেশ্যে যৌন উত্তেজক আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করে বের হতে দেখতে পাবেন, হয় সে পোশাকটি খাট অথবা লম্বা, যার উপরে একটি খাট বা লম্বা আবা (ঢিলা জামা) ছাড়া আর কিছুই থাকে না, কখনও তা বাতাসে খুলে ফেলে, আবার কখনও কখনও সে নিজেই ইচ্ছা করে খুলে ফেলে। আবার দেখতে পাবেন, সে বের হয় এমন ওড়না পরিধান করে, যার দ্বারা সে তার চেহারাকে ঢেকে নেয়; কিন্তু সে ওড়নাটি কখনও কখনও এমন পাতলা হয়, যা তার চেহারার রং সম্পর্কে বলে দেয়, আবার কখনও কখনও সে ওড়নাটিকে তার চেহারার ওপর এমনভাবে শক্ত করে বেঁধে নেয়, যা তার নাক ও গালের মতো চেহারার উঁচু স্থানগুলোর পরিমাপ বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রকাশ করে দেয়। আবার কখনও বের হয় পরিধেয় স্বর্ণের অলংকার পরিধান করা অবস্থায়, অতঃপর সে তার বাহুদ্বয় উন্মুক্ত করে দেয়, যাতে অলংকার প্রকাশ হয়ে যায়, আর মনে হয় যেন সে জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলে: তোমরা আমার শরীরে বিদ্যমান দৃশ্য দেখতে থাক!

বড় ধরনের ফিতনা ও কঠিন পরীক্ষা: শক্তিশালী সুগন্ধযুক্ত সুগন্ধি ব্যবহার করে অনেক নারী বের হয়, যেসব পুরুষের অন্তরে ব্যাধি আছে এমন প্রতিটি ব্যক্তিই এর দ্বারা সম্মোহন ও উন্মত্ততার শিকার হবে অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وإِن المرأة إِذا استَعطَرَتْ فمرَّت بالمجلس فهي كذا وكذا يعني: زانية».

“আর নারী যখন সুগন্ধি ব্যবহার করবে, তারপর মাজলিস বা সমাবেশের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করবে, তখন সে এরকম এরকম, অর্থাৎ সে ব্যভিচারিনী।”[1]

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

«إِذَا خَرَجَتْ إِحْدَاكُنَّ إِلَى الْمسجدِ , فَلَا تَمَسَّ طِيبًا».

“যখন তোমাদের নারীদের মধ্য থেকে কেউ মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হবে, তখন সে যেন সুগন্ধি ব্যবহার না করে”।[2]

সে তার ঘর থেকে বের হয় এবং হাট-বাজারে তীব্র গতিতে হাঁটাহাঁটি করে, যেমনিভাবে অধিক শক্তিশালী বা অনুরূপ পুরুষগণ হাঁটাহাঁটি করে, মনে হয় যেন তার (ঐ নারীর) উদ্দেশ্য হলো, মানুষ তার শক্তি ও উদ্যম সম্পর্কে জানবে। আর সে তার বান্ধবীর সঙ্গে হাঁটে এমনভাবে, সে তার সাথে উচ্চস্বরে হাসি-ঠাট্টা করে এবং দৃশ্যমানভাবে সে তার সাথে ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কি করে, আর কেনাকাটা করার জন্য দোকানদারের নিকট এমনভাবে দাঁড়ায় যে, তার দুই হাত ও বাহুদ্বয় উন্মুক্ত থাকে, আবার কখনও কখনও সে দোকানদারের সাথে রসিকতা করে এবং দোকানদারও তার সাথে রসিকতা ও হাসি-ঠাট্টা করে। আর নারীদের একটি অংশ ইত্যাদি ধরনের যেসব আচরণ করে, সেগুলো ফিতনা, মহাবিপদ ও অস্বাভাবিক আচরণের অন্যতম কারণ, যা ইসলামের নির্দেশনা ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলিম জাতির নিয়ম-নীতির বহির্ভূত।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, অথচ তারা ছিলেন আদর্শের মূর্তপ্রতীক, তিনি বলেন:

﴿ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ ﴾ [الاحزاب: ٣٣]

“আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের প্রদর্শনীর মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«لَا تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللَّهِ مَسَاجِدَ اللَّهِ، وَبُيُوتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ».

“তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে আল্লাহর মাসজিদসমূহে যেতে বাধা প্রদান করো না, তবে তাদের জন্য তাদের ঘরসমূহে অবস্থান করাটাই অধিক উত্তম।”[3] (তাদের ঘরসমূহ) তাদের জন্য কিসের চেয়ে উত্তম? আল্লাহর মাসজিদসমূহ থেকে, সুতরাং বাজারের উদ্দেশ্যে তাদের বের হওয়ার বিষয়টি কেমন হবে? আর এ বিশুদ্ধ হাদীসটি অবশ্যই প্রমাণ করে যে, পুরুষ ব্যক্তির জন্য নারীকে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হওয়া থেকে নিষেধ করা বৈধ, এ ব্যাপারে নিষেধ করাতে তার কোনো গুনাহ হবে না এবং তাতে কোনো সমস্যাও নেই, তবে মসজিদ ছাড়া (অর্থাৎ মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া বৈধ হবে না)। আর তাকে সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ানো থেকে এবং বেপর্দায় চলাফেরা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা থেকে নিষেধ করার কাজটি তার জন্য ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) এবং তাকে এর জন্য কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে। কেননা, বৃদ্ধা নারীর জন্য যখন সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ানো নিষিদ্ধ, তখন যুবতী নারীর জন্য তা কিভাবে বৈধ হবে, যে নারী ফিতনার কেন্দ্রবিন্দু ...? আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَٱلۡقَوَٰعِدُ مِنَ ٱلنِّسَآءِ ٱلَّٰتِي لَا يَرۡجُونَ نِكَاحٗا فَلَيۡسَ عَلَيۡهِنَّ جُنَاحٌ أَن يَضَعۡنَ ثِيَابَهُنَّ غَيۡرَ مُتَبَرِّجَٰتِۢ بِزِينَةٖۖ وَأَن يَسۡتَعۡفِفۡنَ خَيۡرٞ لَّهُنَّۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٦٠﴾ [النور: ٦٠]

“আর বৃদ্ধা নারীরা, যারা বিয়ের আশা রাখে না, তাদের জন্য অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বহির্বাস খুলে রাখে। তবে এ থেকে তাদের বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। [সূরা আন-নুর, আয়াত: ৬০]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ﴾ [النور: ٣١]

“আর তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদচারণা না করে”। [সূরা আন-নুর, আয়াত: ৩১] আর তা হলো নূপুর জাতীয় অলঙ্কার, যা সে তার পায়ের মধ্যে পরিধান করে এবং তার কাপড় দিয়ে তা গোপন করে রাখে, অতঃপর যখন সে যমীনের ওপর তার পা দ্বারা সজোরে আঘাত করে, তখন তার আওয়াজ শুনা যায়। সুতরাং নারী কর্তৃক যখন এমন কাজ করা নিষিদ্ধ, যে কাজ করলে তার পায়ের গোপন সৌন্দর্য সম্পর্কে জানা যায়, তখন সে নারীর বিষয়টি কেমন হওয়া দরকার, যে তার বাহুকে উন্মুক্ত করে রাখে, যেখানে তার হাতের সৌন্দর্য প্রদর্শিত হয়?!

নিশ্চয় শোনার ফিতনার চেয়ে দেখার ফিতনার বিষয়টি অনেক ভয়ঙ্কর। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«صِنْفَانِ مِنْ أهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا: قَومٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأذْنَابِ البَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ ، رُؤُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ البُخْتِ المائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الجَنَّةَ، وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا، وإنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكذَا».

“জাহান্নামীদের এমন দু’টি দল রয়েছে, যাদেরকে আমি দেখি নি; তাদের এক দলের হাতে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তারা তা দিয়ে লোকদেরকে মারবে। আর এক দল হবে নারীদের, তাদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা সত্ত্বেও উলঙ্গ দেখাবে, গর্বের সাথে নৃত্যের ভঙ্গিতে বাহু দুলিয়ে পথ চলবে, বুখতী উটের উঁচু কুঁজের মতো করে খোপা বাঁধবে, এসব নারী কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না, জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না, অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ অনেক অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে।”[4]

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন যে, তারা হচ্ছে «كَاسِيَاتٌ» (পোশাক পরিহিতা), অর্থাৎ তাদের শরীরে পোশাক আছে; কিন্তু তারা «عَارِيَاتٌ» (উলঙ্গ)। কারণ, এ পোশাক শরীর ঢাকে না, হয় পাতলা হওয়ার কারণে অথবা সংকীর্ণ হওয়ার কারণে অথবা ছোট-খাট হওয়ার কারণে। «مَائِلاَتٌ» তারা সত্যের পথ থেকে বিচ্যূত, «مُمِيلاَتٌ» নিজের কুকর্মগুলো অন্য মানুষের নিকট প্রকাশকারিনী; «رُؤُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ البُخْتِ المائِلَةِ» অর্থাৎ তারা এমনভাবে তাদের চুল বা অন্য কিছু পেঁচিয়ে খোপা বাঁধে, যা শেষ পর্যন্ত দেখতে বুখতী উটের কুঁজের মতো বড় ও উঁচু মনে হয়।

>
[1] ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বলেছেন: ‘হাদীসটি হাসান সহীহ’।

[2] আবু শায়বাহ, মুসান্নাফ, হাদীস নং- ২৬৩৩৮ এবং ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. প্রায় অনুরূপ শব্দে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

[3] সহীহ বুখারী ও আবু দাউদ।

[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৫৭০৪